সব দিক থেকেই মনে হচ্ছে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো এক সন্ধিক্ষণে আছে। এই মুহূর্তে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোকে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের সুযোগ নিতে হবে। তা না হলে কেবল ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজই বাকি থাকবে। এক দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে এই অঞ্চলে তাদের বেশি শক্তি খরচের জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে মোড় ঘোরানো (পিভট টু এশিয়া) নীতির প্রবক্তা। এর পর থেকে প্রতিটি মার্কিন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবারই এই অঞ্চলে কোনো না কোনো সংকটে তারা আবার জড়িয়ে পড়েছে। অনেক সময় সেই সংকট তাদের তৈরি করা নয়। তা পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণেও ছিল না।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুতে কৌশলগতভাবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার একটা বাস্তব সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তাঁর প্রশাসন নব্য-রক্ষণশীল প্রভাব কমিয়ে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে জোর দেয়। এর মাধ্যমে উপসাগরীয় দেশগুলো একটি স্পষ্ট বার্তা পায় যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে যাচ্ছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ায় এই যে জায়গা খালি হবে, সেখানে এখন উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কেবল অর্থ জোগানদাতা হিসেবে নয়, বরং কৌশলপ্রণেতা হিসেবে উঠে আসার সময়।
কাতার, ওমান আর সৌদি আরব এই সুযোগ কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়েছিল। তারা ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে মিলে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে তেহরানের সঙ্গে নতুন এক কাঠামো গড়তে কাজ করছিল। একটি আঞ্চলিক মীমাংসার রূপরেখা তৈরি হচ্ছিল। উপসাগরীয় দেশগুলো মনে করেছিল, তারা আর শুধু পৃষ্ঠপোষক নয়, বরং এখন কৌশলপ্রণেতা। অর্থনৈতিক সংযুক্তি আর সমন্বিত পরিকল্পনার দিকে এগোচ্ছিল তারা। এভাবে এগোতে পারলে তা হতে পারত মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। যুদ্ধের বদলে জায়গা পেতে পারত পারস্পরিক নির্ভরতা আর অহিংস নেতৃত্ব।
কিন্তু এই স্বপ্ন এক গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছিল। সেটি হলো ইসরায়েল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর দীর্ঘদিনের কৌশল বদলে ফেলেন। তিনি হয়ে উঠলেন চূড়ান্ত উগ্র, একপেশে। গাজায় হিজবুল্লাহকে তারা কার্যত ঠেকিয়ে দিয়েছে। দুর্বল করেছে তাদের নেতৃত্বকে। এই আংশিক সাফল্যে আত্মবিশ্বাসী হয়ে নেতানিয়াহু এবার ইরানের গভীরে আঘাত হানছেন। তাঁর লক্ষ্য ইরানের বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন আর যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সমঝোতার সম্ভাবনা নষ্ট করা।
উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কূটনৈতিক উদ্যোগ এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ইরানবিরোধী শক্তি কোণঠাসা হচ্ছিল। নেতানিয়াহু নিজের প্রভাব হারাচ্ছিলেন। এখন যুদ্ধ শুরু করে নেতানিয়াহু আবার কেন্দ্রে ফিরেছেন। তিনি ট্রাম্পকে দীর্ঘস্থায়ী এক সংঘাতে টেনে এনেছেন, যা ভন্ডুল করে দিতে পারে ইরান চুক্তি।
উপসাগরীয় দেশগুলো এই অঞ্চল নিজেদের মতো করে বদলে ফেলতে পারে। তাদের হাতে উপায় আছে। আছে সময়ও। কিন্তু তারা ভুগছে দ্বিধায়। ১৯৭৩ সালের তেল-সংকটের মতো এক পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা। সেবার সৌদি আরব তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করেছিল। আজ উপসাগরীয় দেশগুলোর হাতে আরও বেশি অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক আর জ্বালানি-সম্পর্কিত সামর্থ্য আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করতে সেই ক্ষমতা এখনো ব্যবহার করতে চায় না তারা।
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে শুরু করে হুতি বা হামাসের ওপর প্রভাব পর্যন্ত সবই আছে। তবু তারা লেনদেনভিত্তিক কূটনীতি বেছে নিয়েছে। ট্রাম্পকে বিনিয়োগ বা জ্বালানি চুক্তি দিয়ে খুশি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইসরায়েলের শক্তি প্রদর্শনের পর এই কৌশল কাজ করছে না।
ইসরায়েল তার সব সামরিক প্রযুক্তি, গোয়েন্দা দক্ষতা ব্যবহার করছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে নিজেদের মতো করে গড়ে নিচ্ছে। এই নীতিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের পরিপন্থী। কিন্তু নেতানিয়াহুর তাতে কিছু এসে যায় না। যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিকভাবে জড়াতে পারলেই তাঁর লাভ।
ইরান কিন্তু ইরাক নয়। যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল কেউই সেখানে স্থলসেনা পাঠাবে না। বরং তারা একটু একটু করে ইরানকে দুর্বল করার নীতি নেবে। একেকটা হামলা করে ইরানকে ফাঁপা করে তোলা হবে। যদি সর্বোচ্চ নেতা খামেনি নিহত হন, তাহলে দীর্ঘ আর জটিল উত্তরাধিকার সংকট শুরু হবে। শেষমেশ হয়তো আইআরজিসি-নেতৃত্বাধীন সামরিক স্বৈরশাসন তৈরি হবে। অথবা ইরান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হবে। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর কাঁধে পড়বে সেই অস্থিরতার বোঝা। থাকবে এক বিধ্বস্ত প্রতিবেশী, ভাঙা সীমান্ত আর অসংখ্য সশস্ত্র নেটওয়ার্ক।
শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইরান বিপ্লবের আগেও ছিল। রাষ্ট্র ভেঙে গেলে তারা নতুনভাবে গড়ে উঠবে। হবে আরও বেপরোয়া। এক ভারসাম্যহীন মধ্যপ্রাচ্য তৈরি হবে। ইসরায়েল শত্রু ধ্বংস করতে পারবে, কিন্তু টেকসই কিছু তৈরি করতে পারবে না। আর উপসাগরীয় দেশগুলোকে ঘিরে থাকবে সশস্ত্র গোষ্ঠী—হিজবুল্লাহ, হুতি আর ইরানি মিলিশিয়া। মাঝেমধ্যে ইসরায়েল হামলা চালিয়ে এদের কিছুটা দমন করবে। কিন্তু স্থিতিশীলতা ফিরবে না। আর নেতানিয়াহুর অধীনে ইসরায়েল এখন যুদ্ধপ্রিয় মৌলবাদী ইহুদি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এমন রাষ্ট্র আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। এরা বিধ্বংসী শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
এই প্রেক্ষাপটে উপসাগরীয় দেশগুলোকে কৌশলগত ক্ষেত্রেও নিজেদের প্রভাব কাজে লাগাতে হবে। উচিত হবে ওয়াশিংটনে নতুনভাবে লবি গড়ে তোলা। ট্রাম্প প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যেন তারা সংঘাত নয়, কূটনীতি বেছে নেয়।
কাতার-ওমান এরই মধ্যে একধরনের সেতু গড়ছে তেহরান আর ট্রাম্পের মধ্যে। তাদের বহুমুখী অংশীদারত্বকেও কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ব এখন বহু মেরু। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংযুক্তি, রাশিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তা সংলাপ—সবই যুক্তরাষ্ট্রকে আরও চাপে ফেলবে। সবশেষে উপসাগরীয় দেশগুলোকে বুঝতে হবে, তাদের কোনো বিকল্প নেই। তাদের আছে শক্তি, আছে ক্ষমতা। এখন দরকার সেই ক্ষমতা ব্যবহারের সাহস।
● ড.
আন্দ্রেয়াস ক্রিগ কিংস কলেজ লন্ডনের ডিফেন্স স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ব যবহ র ইসর য় ল ক টন ত
এছাড়াও পড়ুন:
৪৯তম বিশেষ বিসিএসে আরবি বিভাগ না থাকার প্রতিবাদ
৪৯তম বিসিএসের (সাধারণ শিক্ষা) বিজ্ঞপ্তিতে ‘আরবি ও ইসলামি শিক্ষা’ না থাকায় এর প্রতিবাদে এবং বিভাগটি অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী।
সোমবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী ইবরাহীম নাফিস।
লিখিত বক্তব্যে ইবরাহীম নাফিস বলেন, শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক নিয়োগের জন্যই কেবল ৪৯তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সাধারণত সরকারি কলেজের প্রভাষক পদ বেশি শূন্য থাকলে বিশেষ বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত ৪০তম বিসিএসের পর থেকে আরবি ও ইসলামি শিক্ষা বিষয়ে কোনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
ইবরাহীম নাফিস বলেন, ‘দেশের ৬৬টি কলেজে আরবি ও ইসলামি শিক্ষা বিভাগ রয়েছে। ৪৯তম বিসিএসে কেবল সরকারি কলেজের প্রভাষক নিয়োগের জন্য দেওয়া হয়েছে বিধায় আমরা আশাবাদী ছিলাম যে বিজ্ঞপ্তিতে আরবি ও ইসলামি শিক্ষার প্রভাষক পদ শূন্য দেখানো হবে। কিন্তু আরবি ও ইসলামি শিক্ষার কোনো পদ শূন্য নেই দেখে আমরা চরম হতাশ হয়েছি।’
আরবি বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘যেসব কলেজে আরবি ও ইসলামি শিক্ষা বিভাগ রয়েছে, সেগুলোর শিক্ষকদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করে জানতে পারি, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরবি ও ইসলামি শিক্ষা বিষয়ে ৩৩টি প্রভাষক পদ শূন্য রয়েছে।’
ইবরাহীম নাফিস বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের দাবি জানিয়েছি। এ ছাড়া পিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) চেয়ারম্যানকেও মৌখিকভাবে আমাদের দাবিগুলো জানিয়েছি।’
সংবাদ সম্মেলন থেকে ৪৯তম বিসিএসে (বিশেষ) পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তিতে আরবি ও ইসলামি শিক্ষা বিভাগের শূন্য পদগুলো অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি জানানো। দাবি না মানা হলে আইনি সহায়তা গ্রহণসহ কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেন আরবি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।