ইরানের পর ইসরায়েলের নিশানা কি তুরস্ক
Published: 20th, June 2025 GMT
ইরানে গত শুক্রবার হামলা চালানোর ঠিক এক দিন আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পার্লামেন্টে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।
সেদিন পার্লামেন্টে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘আর্জেন্টিনা একসময় হাজারো ইহুদির জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল; যখন অর্থনৈতিক সংকট ও বিদ্বেষমূলক নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তাঁরা শুধু পূর্ব ইউরোপ নয়, অটোমান সাম্রাজ্য থেকেও পালিয়ে আশ্রয় খুঁজছিলেন। একটি সাম্রাজ্য (অটোমান সাম্রাজ্য) আর শিগগিরই পুনর্গঠিত হবে বলে আমার মনে হয় না, যদিও কিছু মানুষ আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।’
এ মন্তব্যগুলো স্পষ্টভাবে তুরস্ক ও দেশটির দীর্ঘ সময়ের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে লক্ষ্য করে করা এবং বিষয়টি আঙ্কারার কর্মকর্তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি।
‘আরব বসন্তের’ সময় ২০১০-এর দশক থেকে একটি ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে আসছে।
নতুন আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেও আঙ্কারার গুরুত্ব ক্রমে বেড়েছে। এ গুরুত্ব এতটাই বেড়েছে যে ইরানে ইসরায়েলের হামলার আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের যে গুটিকয় মিত্রকে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে আগাম তথ্য দেওয়া হয়েছিল, সেসবের একটি তুরস্ক।
এর কয়েক ঘণ্টা পর (শুক্রবার ভোরে) ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা শুরু এবং শীর্ষস্থানীয় নিরাপত্তা, গোয়েন্দা ও সামরিক কমান্ডারদের পাশাপাশি কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করে।
তুরস্ক এ উত্তেজনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের আক্রমণকে অপ্রয়োজনীয় বলে বর্ণনা করেছে, বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী ইরান সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না।ইসরায়েলের আক্রমণের নজিরবিহীন গতি দেখে তুরস্কের কর্মকর্তা ও জনগণ উভয়ই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
শুধু সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা নয়, ইসরায়েল ইরানের আবাসিক এলাকা ও বেসামরিক অবকাঠামোও লক্ষ্যবস্তু করেছে। হামলায় এখন পর্যন্ত কয়েক শ মানুষ নিহত এবং এক হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। হতাহতদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ।
হামলার জবাব দিতে ইসরায়েলের হাইফা, তেল আবিবসহ কয়েকটি বড় শহরে পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরান।
তুরস্ক এ উত্তেজনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের আক্রমণকে অপ্রয়োজনীয় বলে বর্ণনা করেছে, বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী ইরান সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না।
তবে আঙ্কারা শুধু ইসরায়েলের বর্তমান সামরিক সক্ষমতার কারণেই উদ্বিগ্ন নয়। পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা চলাকালে ইসরায়েল এ হামলা চালানোর পরও ইউরোপের দেশগুলোর এতে সমর্থন দেওয়ার ঘটনা দেশটিকে হতাশ করেছে।
যদিও এ উত্তেজনা বৃদ্ধিকে অনেকেই হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা হিসেবে দেখছেন, যা অনেক আঞ্চলিক রাষ্ট্রকে বিস্মিত করেছে।
আর্জেন্টিনা একসময় হাজারো ইহুদির জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল; যখন অর্থনৈতিক সংকট ও বিদ্বেষমূলক নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তাঁরা শুধু পূর্ব ইউরোপ নয়, অটোমান সাম্রাজ্য থেকেও পালিয়ে আশ্রয় খুঁজছিলেন। একটি সাম্রাজ্য (অটোমান সাম্রাজ্য) আর শিগগিরই পুনর্গঠিত হবে বলে আমার মনে হয় না, যদিও কিছু মানুষ আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।—বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীআঙ্কারা আগেই ইরানের ওপর ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার ঘটনায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গত সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল যখন লেবাননের হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে, তখন তুরস্কের কর্মকর্তারা ইসরায়েলের বড় ধরনের আক্রমণ ও এর জেরে সম্ভাব্য আঞ্চলিক সংঘাতের পরিণতির বিষয়টি পর্যালোচনা করেছে।
এ জন্য তুরস্ক বিকল্প পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে; যার মধ্যে শরণার্থীদের সম্ভাব্য ঢেউ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত আছে।
গত বছরের অক্টোবরে আঙ্কারা কারাবন্দী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করে; যাতে ইরান কিংবা ইসরায়েল, কোনো পক্ষই তাদের লড়াইয়ে পিকেকে যোদ্ধাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে।
তেহরান থেকে ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ইরানের নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র ত রস ক
এছাড়াও পড়ুন:
ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন
কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ।
এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।
একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।
দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।
পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।
ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।
এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।
বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।
এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”
যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।
বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”
তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।
প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।
এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।
ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”
শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
ঢাকা/এস