ইরানে গত শুক্রবার হামলা চালানোর ঠিক এক দিন আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পার্লামেন্টে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন।

সেদিন পার্লামেন্টে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘আর্জেন্টিনা একসময় হাজারো ইহুদির জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল; যখন অর্থনৈতিক সংকট ও বিদ্বেষমূলক নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তাঁরা শুধু পূর্ব ইউরোপ নয়, অটোমান সাম্রাজ্য থেকেও পালিয়ে আশ্রয় খুঁজছিলেন। একটি সাম্রাজ্য (অটোমান সাম্রাজ্য) আর শিগগিরই পুনর্গঠিত হবে বলে আমার মনে হয় না, যদিও কিছু মানুষ আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।’

এ মন্তব্যগুলো স্পষ্টভাবে তুরস্ক ও দেশটির দীর্ঘ সময়ের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে লক্ষ্য করে করা এবং বিষয়টি আঙ্কারার কর্মকর্তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি।

‘আরব বসন্তের’ সময় ২০১০-এর দশক থেকে একটি ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে আসছে।

নতুন আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেও আঙ্কারার গুরুত্ব ক্রমে বেড়েছে। এ গুরুত্ব এতটাই বেড়েছে যে ইরানে ইসরায়েলের হামলার আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের যে গুটিকয় মিত্রকে সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে আগাম তথ্য দেওয়া হয়েছিল, সেসবের একটি তুরস্ক।

এর কয়েক ঘণ্টা পর (শুক্রবার ভোরে) ইসরায়েল ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা শুরু এবং শীর্ষস্থানীয় নিরাপত্তা, গোয়েন্দা ও সামরিক কমান্ডারদের পাশাপাশি কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করে।

তুরস্ক এ উত্তেজনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের আক্রমণকে অপ্রয়োজনীয় বলে বর্ণনা করেছে, বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী ইরান সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না।

ইসরায়েলের আক্রমণের নজিরবিহীন গতি দেখে তুরস্কের কর্মকর্তা ও জনগণ উভয়ই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

শুধু সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনা নয়, ইসরায়েল ইরানের আবাসিক এলাকা ও বেসামরিক অবকাঠামোও লক্ষ্যবস্তু করেছে। হামলায় এখন পর্যন্ত কয়েক শ মানুষ নিহত এবং এক হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। হতাহতদের অধিকাংশই সাধারণ মানুষ।

হামলার জবাব দিতে ইসরায়েলের হাইফা, তেল আবিবসহ কয়েকটি বড় শহরে পাল্টা হামলা চালিয়েছে ইরান।

তুরস্ক এ উত্তেজনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরায়েলের আক্রমণকে অপ্রয়োজনীয় বলে বর্ণনা করেছে, বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী ইরান সক্রিয়ভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না।

তবে আঙ্কারা শুধু ইসরায়েলের বর্তমান সামরিক সক্ষমতার কারণেই উদ্বিগ্ন নয়। পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা চলাকালে ইসরায়েল এ হামলা চালানোর পরও ইউরোপের দেশগুলোর এতে সমর্থন দেওয়ার ঘটনা দেশটিকে হতাশ করেছে।

যদিও এ উত্তেজনা বৃদ্ধিকে অনেকেই হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা হিসেবে দেখছেন, যা অনেক আঞ্চলিক রাষ্ট্রকে বিস্মিত করেছে।

আর্জেন্টিনা একসময় হাজারো ইহুদির জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল; যখন অর্থনৈতিক সংকট ও বিদ্বেষমূলক নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তাঁরা শুধু পূর্ব ইউরোপ নয়, অটোমান সাম্রাজ্য থেকেও পালিয়ে আশ্রয় খুঁজছিলেন। একটি সাম্রাজ্য (অটোমান সাম্রাজ্য) আর শিগগিরই পুনর্গঠিত হবে বলে আমার মনে হয় না, যদিও কিছু মানুষ আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।—বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী

আঙ্কারা আগেই ইরানের ওপর ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার ঘটনায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গত সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল যখন লেবাননের হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে, তখন তুরস্কের কর্মকর্তারা ইসরায়েলের বড় ধরনের আক্রমণ ও এর জেরে সম্ভাব্য আঞ্চলিক সংঘাতের পরিণতির বিষয়টি পর্যালোচনা করেছে।

এ জন্য তুরস্ক বিকল্প পরিকল্পনা প্রস্তুত করে রেখেছে; যার মধ্যে শরণার্থীদের সম্ভাব্য ঢেউ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত আছে।

গত বছরের অক্টোবরে আঙ্কারা কারাবন্দী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) নেতা আবদুল্লাহ ওজালানের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করে; যাতে ইরান কিংবা ইসরায়েল, কোনো পক্ষই তাদের লড়াইয়ে পিকেকে যোদ্ধাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে।

তেহরান থেকে ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ইরানের নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র ত রস ক

এছাড়াও পড়ুন:

আমাদের ধনখড়েরাও অপমানিত হয়ে অপসারিত হয়েছিলেন

প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় এক কলামে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় কী পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেছেন, তার বিস্তারিত লিখেছেন। সৌম্য লিখেছেন, এভাবে অসম্মানিত অপসারণ আরও ভয়ংকরভাবে এই বার্তা ছড়িয়ে দিল, ‘কর্তার’ রোষানলে পড়লে কারও রেহাই নেই।

এই বার্তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক আগেই প্রচারিত হয়েছিল। আমাদের দেশেও ধনখড় ছিল। অনেকে হয়তো জানেন না বা ভুলে গেছেন, আমাদের ধনখড়দেরও অনেক অসম্মান করে বিদায় দেওয়া হয়েছিল। তবে ‘কর্তার’ ইচ্ছায় নয়; বরং দুই ‘কর্ত্রীর’ ইচ্ছায়। সেসব ঘটনা ভারতের ধনখড়ের চেয়েও চমকপ্রদ এবং রাজনীতির নাটকে ভরপুর।

ধনখড় একসময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন। সে সময়টায় রাজ্যের রাজনীতিতে তাঁর অতি সক্রিয়তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অতিষ্ঠ করে তোলে। নিয়তির কী উপহাস, মোদি তাঁকে উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণের একটা বড় কারণ ছিল ‘তাঁর অতি সক্রিয়তা’। অন্য বড় কারণটা ছিল ‘প্রটোকলের বিষয়ে স্পর্শকাতরতা’। আশ্চর্য এক মিল—বাংলাদেশের ধনখড়দের অপমান ও অপসারণের কারণও ছিল ঠিক এই দুটি।

বাংলাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ‘অতি সক্রিয়তা’ ও ‘প্রটোকলের বিষয়ে স্পর্শকাতরতা’ নিয়ে সুপ্রিম নেতাদের দেওয়া লাইনটা কিছুটা ‘অতিক্রম’ করেছিলেন। প্রতিক্রিয়া ছিল তৎক্ষণাৎ, তাঁদের অপমানিত হয়ে চাকরি হারিয়ে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। এই দুটি ঘটনা একসময় দেশের রাজনৈতিক আলোচনায় দারুণ ঝড় তুলেছিল।

২.

ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাবা কফিল উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন তুখোড় রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের একজন বরেণ্য নেতা। ১৯৭২ সালে বাবার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ চেয়েছিল বদরুদ্দোজা চৌধুরী বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করবেন। কিন্তু তিনি তা চাননি। তিনি একজন শীর্ষ স্থানীয় মেডিকেল শিক্ষাবিদ ও চিকিৎসক হিসেবে নিজে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। একসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁর উপস্থাপনায় অনুষ্ঠান ‘আপনার ডাক্তার’ ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়।

১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর তিনি জিয়ার উপদেষ্টা হন। পরে রাষ্ট্রপতি জিয়া যখন নিজের রাজনৈতিক দল গঠন করেন ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী হলেন দলের মহাসচিব। সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলেন। যে মানুষটা রাজনীতিকে এত কাছ থেকে দেখার পরও রাজনীতি থেকে এতটা বছর দূরে ছিলেন, হঠাৎ কেন রাজনীতিতে যোগ দিলেন?

খালেদা জিয়া হয়তো মনে করতেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বি চৌধুরী তাঁকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করতেন না। রাষ্ট্রপতির প্রটোকলের প্রতি অবিচল থাকায় চরম শাস্তি পেতে হলো বি চৌধুরীকে। তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেওয়া হয়নি, প্রধানমন্ত্রী একটিবার তাঁর সঙ্গে কথা বললেন না। এই অপমান ধনখড়ের অপমানের চেয়ে কম নয়।

রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে বি চৌধুরীর খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জিয়া খুব বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা করতেন বি চৌধুরীকে। জিয়ার মৃত্যুর পর একসময় খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। দলে ও খালেদা জিয়ার সরকারে বদরুদোজ্জা চৌধুরী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি তাঁকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আইন অনুযায়ী তিনি মন্ত্রিত্ব ও বিএনপির সব দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি নেন।

বঙ্গভবনে যাওয়ার পর বি চৌধুরী সরকার ও দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তিনি রাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্সিকে দলের ওপরে স্থান দিতেন এবং প্রেসিডেন্সির স্বাধীন সত্তা ও প্রটোকল বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। দলের ভেতরে এর মধ্যে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান, অলি আহমদ, মতিন চৌধুরী হয়ে ওঠেন খালেদা জিয়ার পরামর্শদাতা। তাঁরা দলের বাইরে বি চৌধুরীর স্বাধীন সত্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কান ভারী করতে থাকেন বলে আলোচনা আছে এবং দলের সংসদ সদস্যদেরও তাঁরা খেপিয়ে তোলেন। নিজের জন্য আলাদা ইমেজ গড়ে তোলার চেষ্টাই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আমাদের ধনখড়েরাও অপমানিত হয়ে অপসারিত হয়েছিলেন