এই ডিজিটাল যুগে আমাদের চারপাশের প্রতিটি জিনিসই ইন্টারনেটে যুক্ত হচ্ছে। গাড়িও তার ব্যতিক্রম নয়। স্মার্ট গাড়ি, সংযুক্ত গাড়ি, টেলিম্যাট্রিক্স , ওভার-দ্য-এয়ার আপডেট ইত্যাদি প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনই এনেছে নতুন নিরাপত্তা ঝুঁকি। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, কোটি কোটি গাড়ি রয়েছে ভয়াবহ রিমোট হ্যাকিংয়ের ঝুঁকিতে। অর্থাৎ, একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা দুর্বলতার ফলে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি গাড়ি দূর থেকে হ্যাকড হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে, যা শুধু ব্যক্তিগত গোপনীয়তাই নয়, বরং জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিসিএ সাইবার সিকিউরিটি সম্প্রতি ‘পারফেক্টব্লু’নামে একটি গুরুতর নিরাপত্তা দুর্বলতা আবিষ্কার করেছে, যা ওপেন সিনারজি ব্লুএসডিকে ব্লুটুথে বিদ্যমান। এই ব্লুটুথ স্ট্যাক অসংখ্য গাড়িতে ব্যবহৃত হয় এবং এর মাধ্যমে হ্যাকাররা দূর থেকে গাড়ির ইনফোটেইনমেন্ট সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারে। শুধু তা–ই নয়, ব্লুটুথের মাধ্যমে গাড়ির অবস্থান শনাক্ত করা, অডিও রেকর্ড, এমনকি ফোনবুকে প্রবেশ করাও সম্ভব।

পারফেক্টব্লু আক্রমণটি একাধিক ব্লুটুথ দুর্বলতাকে একত্র করে, যার ফলে হ্যাকাররা গাড়ির সঙ্গে জোড়া লাগানো এম্বেডেড যন্ত্রাংশের মাধ্যমে সহজেই ইনফোটেইনমেন্ট সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে মাত্র এক ক্লিকেই এই আক্রমণ বাস্তবায়ন সম্ভব। যদিও গবেষকেরা গাড়ির স্টিয়ারিং বা উইন্ডশিল্ড ওয়াইপার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সরাসরি দেখাননি, তবু তাত্ত্বিকভাবে এটি সম্ভব বলে জানিয়েছেন।

শুধু ব্লুটুথ নয়, গাড়ির নির্মাতাদের ওয়েব পোর্টাল ও এপিআইতেও রয়েছে ভয়াবহ সাইবার নিরাপত্তা ফাঁক। সম্প্রতি কিয়া, টয়োটা, হোন্ডা, ইনফিনিটি, বিএমডব্লিউ, ফেরারিসহ বহু ব্র্যান্ডের গাড়িতে এমন দুর্বলতা পাওয়া গেছে, যার মাধ্যমে শুধু গাড়ির লাইসেন্স প্লেট নম্বর জানলেই হ্যাকাররা—

* গাড়ির অবস্থান শনাক্ত করতে পারে

* দরজা খুলতে পারে

* ইঞ্জিন চালু করতে পারে

* হর্ন বাজাতে পারে

* এমনকি গাড়ির ক্যামেরা চালু করতে পারে (কিছু মডেলে)।

এই দুর্বলতার মাধ্যমে হ্যাকাররা গাড়ির মালিকের ব্যক্তিগত তথ্য যেমন নাম, ফোন নম্বর, ঠিকানা, এমনকি অতীতের ড্রাইভিং রুটও সংগ্রহ করতে পারে।

নিরাপত্তা গবেষক স্যাম কারি ও তাঁর দল কিয়ার ওয়েব পোর্টালে একটি ত্রুটি খুঁজে পান, যার মাধ্যমে তাঁরা কাস্টম অ্যাপ ব্যবহার করে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হন। তাঁরা দেখান, কেবল লাইসেন্স প্লেট নম্বর ও সংশ্লিষ্ট রাজ্যের তথ্য দিয়ে ভিআইএন (ভেহিকল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) বের করে, তারপর ‘আনলক’ বাটনে ক্লিক করলেই দরজা খুলে যায়।

এমনকি, ডিলার পোর্টালের এপিআইতেও ত্রুটি ছিল, যার মাধ্যমে হ্যাকাররা ‘ডিলার’ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে যেকোনো গাড়ি অন্য অ্যাকাউন্টে রি-অ্যাসাইন করতে পারতেন। ফলে, গাড়ির মালিকের অজান্তেই তাঁর গাড়ির নিয়ন্ত্রণ চলে যেতে পারত অন্য কারও হাতে।

গবেষকরা জানান, শুধু কিয়া নয়, হোন্ডা, ইনফিনিটি, নিসান, অ্যাকিউরা, মার্সিডিজ-বেঞ্জ, হুন্দাই, জেনেসিস, বিএমডব্লিউ, রোলস রয়েস, ফেরারিসহ সব ব্র্যান্ডেই একই ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। গাড়ি নির্মাতারা দ্রুত এসব দুর্বলতা ঠিক করার জন্য সফটওয়্যার হালনাগাদ দিয়েছে। তবে গবেষকেরা সতর্ক করেছেন যে একটি ত্রুটি পাওয়া মানে আরও অনেক ত্রুটি লুকিয়ে থাকতে পারে। তাই গাড়ির সফটওয়্যার নিয়মিত হালনাগাদ ইনস্টল করুন, অপরিচিত যন্ত্রের সঙ্গে ব্লুটুথ সংযোগ এড়িয়ে চলুন এবং গাড়ির ওয়েব পোর্টালে সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখলে দ্রুত উক্ত গাড়ির ওয়েবসাইট রিপোর্ট করুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গাড়ি নির্মাতাদের উচিত ডিজিটাল নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ওয়েব ও এপিআই নিরাপত্তা নিয়মিত পরীক্ষা করা।

আধুনিক গাড়ি শুধু পরিবহনের মাধ্যম নয়, বরং একেকটি মোবাইল কম্পিউটিং সিস্টেম। তাই, ডিজিটাল নিরাপত্তার গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। গাড়ির মালিক, ব্যবহারকারী, নির্মাতাসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। নইলে, প্রযুক্তির সুফল যেমন পাব, তেমনি এর অপব্যবহারও আমাদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

সূত্র: সাইবার সিকিউরিটি নিউজ, সিকিউরিটি উইক, দ্য হাকার নিউজ ও হ্যাকারস অনলাইন ক্লাব

শামীম আহমেদ: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: দ র বলত ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 

বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর মানচিত্রে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান নামের এই পাঁচটি দেশ ছিলো না।  মূলত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাষ্ট্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে চীনের সহায়তায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে পুনরুত্থান হয়েছে। এখন প্রশ্ন  করা যেতে পারে, চীন কেন আবারও  এই অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে?

ঐতিহাসিকভাবে মধ্য এশিয়া অঞ্চল সিল্করোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সভ্যতার সাথে যুক্ত করেছিলো।  বীজ গণিতের জনক আল খারিজমি, আবু সিনার মতো বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে এখানে। যাদের লেখা বই ইউরোপে শত শত বছর ধরে চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। চেঙ্গিস খানও এই অঞ্চলে তার সম্রাজ্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে আদিম যাযাবর জীবনের ঐতিহ্যও টিকে আছে এখানে। 

আরো পড়ুন:

রাশিয়ার ‍বিরুদ্ধে এবার রোমানিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ

রাশিয়ায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা 

রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলো রুশরা। উপনিবেশিক শাসন এমনভাবে চালু করেছিলো, যা অনেকটা ব্রিটিশ বা ফরাসি সম্রাজ্যের মতো দেখতে। 
রাজ্যগুলোকে শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি যাযাবর জাতিকে যুদ্ধ যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাযাবর জাতিকে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে কাজাখ জনগোষ্ঠীর চল্লিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর যে অর্থনীতি, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ সোভিয়েত আমলে কাজাখ যাযাবররা যে পশুপালন করতো তার নব্বই শতাংশই মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কাজাখদের যাযাবর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হয়। বলতে গেলে সোভিয়েত আমলে কাজাখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বেদনাদায়ক পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। 

১৯৯১ সালে সোভিয়েন ইউনিয়নের পতন হয়, সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি স্বাধীন দেশের। এই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলো নিজস্ব সীমানার মধ্যে এক অনন্য পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের ওপর বাইরের প্রভাবও রয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি আরও বেশি জানান দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত মিল আছে। এমনকি শিক্ষাগত কাঠামোতেও মিল রয়েছে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্য রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচিত। 

জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইঘুর বাস করেন। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। এদের নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উইঘুর পরিচয় মুছে ফেলতে তাদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগও আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। 

বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর চীন মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এই অঞ্চলটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছে, যা অনেকটা সিল্করুটের মতোই। 

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রাচীন সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার একটি সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এই রোড পুনরুজ্জীবিত হলে রাশিয়া আর চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা এই অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা বাড়বে-সেটাও সময় বলে দেবে।  

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের কাজ কি শুধু ভাইভা নেওয়া
  • কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 
  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-গ্রামবাসীতে বিদ্বেষ কেন
  • চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ড: ট্রাম্প কি দাঙ্গা–ফ্যাসাদকেই নীতি হিসেবে নিয়েছেন