দুটি ফেরির মৃত্যু ও কিছু মানুষের দীর্ঘশ্বাস
Published: 22nd, July 2025 GMT
সন্ধ্যা নামতে তখনো কিছু বাকি। খুলনার রূপসা ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছি। সাধারণত একটি বড় নদীর ঘাট যেমন হয়, রূপসা নদীর ঘাট দেখে তেমন মনে হলো না। তাই বলে ঘাটটি মরে গেছে, প্রাণহীন, নিস্তেজ হয়ে গেছে, ঠিক তা–ও নয়। দুই পাশে মৌসুমি ফলের দোকান, চায়ের ছোট কিছু টংদোকান, শ্রমিক সংগঠনের দপ্তর ছাড়াও সাধারণত একটা নৌঘাটে অন্য যেসব কাজকারবার থাকে, এর সবই রূপসা ঘাটে বিদ্যমান।
শ্রাবণ মাস। এই ঘাটে অনেক দিন পর বসে দেখলাম রূপসার সৌন্দর্য। নদীর পানিতে অস্ত যেতে থাকা সূর্যের আলো। ওপারে খুলনা মহানগরী।
যাত্রীরা খরস্রোতা রূপসা নদী পারাপার হচ্ছেন ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে। সাধারণ বইঠা–বাওয়া নৌকাও আছে। বয়স্ক, নারী, শিশু, তরুণ, যুবা—সব ধরনের মানুষ নৌকায় করে পারাপার হচ্ছেন। ঘাটে আসার পর যাত্রীদের, বিশেষ করে যাঁরা একটু বয়স্ক, তাঁদের চোখ-মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কতটা উদ্বেগ নিয়ে নৌকায় উঠেছিলেন তাঁরা। আর এপারে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। নৌকায় উঠতে গিয়ে কিংবা নৌকা থেকে পড়ে এই রূপসা ঘাটে প্রাণহানির খবর মাঝেমধ্যেই সংবাদপত্রে আসে।
রূপসা নদীর ঘাটে বেদিতে বসে দক্ষিণ দিকে তাকালে খানজাহান আলী সেতু চোখে পড়ে। এই ঘাট থেকে সেতুর দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারের কাছাকাছি। খুলনা থেকে বাগেরহাট কিংবা বরিশালের গণপরিবহনগুলো এই সেতু দিয়ে চলাচল করে। এই সেতু নিঃসন্দেহে দুপারের মানুষের যোগাযোগ সহজ করেছে। বিশেষ করে মোংলা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ সহজ করেছে এই সেতু।
কিন্তু খুলনার রূপসা, বাগেরহাটের ফকিরহাট, মোল্লাহাট উপজেলা এবং খুলনা শহরের যাঁরা রূপসার ঘাটসংলগ্ন এলাকায় বসবাস করেন, যাঁদের নানা প্রয়োজনে এপার–ওপার করতে হয়, তাঁদের জন্য খানজাহান আলী সেতু তেমন উপকারে আসে না। রূপসা ঘাটের নৌকাই তাঁদের ভরসা।
এই রূপসা ঘাটে একসময় ফেরি চলত। ২০০৫ সালে রূপসা নদীতে খানজাহান আলী সেতু চালু হওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় এই ফেরি।
আমার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মূলঘরে। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে গ্রাম ছেড়েছি বটে, কিন্তু গ্রাম আমাকে ছাড়েনি। সম্ভবত গ্রাম কাউকে ছাড়ে না। এলাকার মানুষ, তাঁদের নানা কথা, সমস্যা—এসব আমাকে এবং আমাদের ঘিরে রাখে। আর একেবারে ছোট্টবেলা থেকেই তো খুলনা শহরে যাচ্ছি এই ফেরিতে চড়ে।
‘যাত্রীরা খরস্রোতা রূপসা নদী পারাপার হচ্ছেন ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে।’.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মাঝরাতে সরকারি কর্মকাণ্ড কতটা স্বাভাবিক
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাতের কর্মকাণ্ড নিয়ে বোধকরি একটা মহাকাব্য লিখে ফেলা সম্ভব। তাঁরা যেভাবে গভীর কিংবা শেষ রাতে নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছেন; তাতে তো মনে হচ্ছে সরকারের কর্তা-ব্যক্তিরা দিনে কাজ না করে রাতেই মনে হয় বেশি কাজ করেন! কয়েকটা উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।
মাস কয়েক আগে যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ভাবে খারাপ হয়ে গেল, আমাদের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রাত তিনটার সময় সংবাদ সম্মেলন ডাকলেন! বাংলাদেশের ইতিহাসে রাত তিনটার সময় আর কোনো মন্ত্রী এ ধরনের সম্মেলনের আয়োজন করেছেন কি না, আমার অন্তত জানা নেই। আমরা সবাই ভাবলাম, তিনি হয়তো বড় কোনো ঘোষণা দেবেন। এরপর কী দেখলাম?
তিনি খুব সাধারণভাবে বললেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সরকার নিজেদের উদ্যোগকে কঠিন ও শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে।
সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ আকাশ থেকে একটি যুদ্ধবিমান ঢাকা শহরের উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল বিল্ডিংয়ে ভেঙে পড়ল। আগুনে দগ্ধ শিশুরা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে নিজেরা উঠে এসে হাঁটছে; এমন দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে। যে দৃশ্য দেখলে যে কেউ হয়তো ট্রমায় চলে যাবে। ওই স্কুলের এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা হয়তো সরাসরি সেই দৃশ্য দেখেছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকে—এইচএসসি পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া সময়ের দাবি ছিল। এ সিদ্ধান্ত সরকার দিনের বেলাতেই নিতে পারত। অথচ আমরা কী দেখলাম?
সরকারের পক্ষ থেকে রাত তিনটার দিকে ফেসবুকে এসে ঘোষণা করা হলো, পরের দিনের এইচএসসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছে।
যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।দিন দু-এক আগে এ সরকারকেই যাঁরা চাকরি দিয়েছেন, এ কথা বলছি কারণ, সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেই বলেছিলেন, ‘ছাত্ররা আমার নিয়োগকর্তা’—সেই ছাত্রদের সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা গভীর রাতে ফেসবুক এসে লাইভ করেন প্রায় আড়াই ঘণ্টা।
এই আড়াই ঘণ্টার লাইভে মূল যে বক্তব্য তিনি তুলে ধরেছেন, সারমর্ম করলে দাঁড়ায়: বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম মানি মেকিং মেশিনে পরিণত হয়েছে এবং অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত। তিনি এটাও বলেছেন, এই সংগঠনের সব সিদ্ধান্ত হেয়ার রোড থেকে আসে। অর্থাৎ উপদেষ্টারা যেখানে থাকেন।
এদিকে সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম একটা ফেসবুক পোস্ট করেছেন। যদিও ফেসবুক স্ট্যাটাসটি তিনি বেশ কয়েকবার এডিট করেছেন। তবে প্রথমে যা লিখেছেন, সেটা হচ্ছে, নতুন একটি দলের মহারথীদের কয়েকজন দুর্নীতিতে জড়িত। এ ছাড়া তিনি এটাও বলেছেন, একটা সার্কেলের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে তাঁদের কেন প্রশ্রয় দেওয়া হলো? আপনারা যদি জানেনই কিছু মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত। তাহলে সরকারের অংশ হিসেবে আপনাদের তো দায়িত্ব তাঁদের আইনের আওতায় আনা। সেটা না করে ফেসবুকে পোস্ট করতে হচ্ছে কেন? তা–ও আবার রাত তিনটায়!
এই সরকার কি মাঝরাতের ফেসবুকীয় সরকারে পরিণত হয়েছে? পরীক্ষা পেছানোর মতো সিদ্ধান্ত যখন মাঝরাতে নিতে হয়, সংবাদ সম্মেলন যখন রাত তিনটায় করতে হয়, তখন তো প্রশ্ন জাগতেই পারে। কারণ এটা তো স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।
যখনই আপনি সরকারের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করবেন কিংবা আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগবে; তখনই কিন্তু রাষ্ট্র ভালো আছে কি না; সেই প্রশ্নও সামনে আসবে।
রাষ্ট্র যদি ভালো না থাকে তবে তার মাত্রা কতটুকু, সেটা নির্ণয় এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
[email protected]