যুক্তরাষ্ট্রের গম আমদানিতে বাণিজ্যঘাটতি সামান্যই কমবে
Published: 23rd, July 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে সাত লাখ টন করে গম আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের কারণে বাণিজ্যঘাটতি কমাতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি কত কমবে, গম আমদানির বর্তমান উৎস দেশগুলো কী কী, এসব বিষয় সামনে এসেছে। গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনো গম আমদানি হয়নি। গত ২২ বছরে অনিয়মিতভাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ২২ লাখ টাকা গম আমদানি হয়েছে। অথচ গত অর্থবছরে; অর্থাৎ এক বছরেই বিভিন্ন দেশ থেকে ৫৯ লাখ টাকা গম আমদানি হয়।
গত রোববার যুক্তরাষ্ট্রের গম রপ্তানিকারক সমিতি বা ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে সরকার। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছর প্রতিবছর সরকারি পর্যায়ে দেশটি থেকে সাত লাখ টন করে গম প্রতিযোগিতামূলক দরে কেনা হবে।
প্রধান দুই খাদ্যশস্যের মধ্যে গম মূলত আমদানিনির্ভর। উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশই আমদানি করতে হয়। আমদানির বড় অংশই বেসরকারি খাত করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫৯ লাখ টন গম আমদানি হয়, যার ছয় শতাংশ সরকারি সংস্থা আমদানি করেছে। এখন সরকার বছরে সাত লাখ টন আমদানির উদ্যোগ নেওয়ায় সরকারি খাতে আমদানির হার বাড়বে।
কোন দেশ থেকে কত আমদানি
বিশ্ববাজারে দুই ধরনের গম পাওয়া যায়। একটি হলো সাধারণ আমিষযুক্ত, যা বিশ্ববাজারে দাম কম থাকে। আরেকটি হলো উচ্চ আমিষযুক্ত, যা তুলনামূলক দাম বেশি থাকে। বাংলাদেশে সাধারণ আমিষযুক্ত সস্তা গমই আমদানি হচ্ছে বেশি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, গত বছর সরকারি-বেসরকারি খাতে ১৬৩ কোটি ডলার ব্যয়ে (শুল্কায়ন মূল্য ২২ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা) ৫৯ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এই গম আমদানি হয়েছে বিশ্বের আটটি দেশ থেকে।
এনবিআরের এক দশকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সাধারণ আমিষযুক্ত সস্তা গম আমদানির বড় উৎস রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এরপরও গত অর্থবছরে গম আমদানির ৪৬ শতাংশ বা ২৭ লাখ টন আমদানি হয় রাশিয়া থেকে। ইউক্রেন থেকে আমদানি হয়েছে ১৮ শতাংশ; অর্থাৎ মোট গম আমদানির ৬৪ শতাংশ আসছে দেশ দুটি থেকে।
এ ছাড়া কানাডা থেকে ১৯ শতাংশ, আর্জেন্টিনা থেকে ৮ শতাংশ, বুলগেরিয়া ও রোমানিয়া থেকে ৩ শতাংশ করে, ব্রাজিল থেকে ২ শতাংশ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ১ শতাংশ আমদানি হয়।
বাংলাদেশে আমদানি হওয়া গমের প্রায় ৭০ শতাংশই সাধারণ আমিষযুক্ত। এ ধরনের গমের দাম তুলনামূলক কম থাকে। সাধারণ আমিষযুক্ত গম আসছে রাশিয়া-ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও ব্রাজিল থেকে। এসব দেশ থেকে আমদানি করা প্রতি টন গমের দাম পড়েছে ২৬৪ থেকে ২৭৫ ডলারের মধ্যে। সাধারণ আমিষযুক্ত গম দিয়ে রুটি ও সাধারণ মানের বেকারি পণ্য তৈরি হয়।
উচ্চ আমিষযুক্ত গম আমদানি হয়েছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। প্রতি টনের দাম পড়ছে ৩০০ থেকে ৩১৩ ডলার। আর্জেন্টিনা থেকে সাধারণ ও উচ্চ আমিষযুক্ত, দুই ধরনের গম আমদানি হচ্ছে। উচ্চ আমিষযুক্ত গম দিয়ে পরোটা, উন্নত মানের বিস্কুটসহ নানা খাদ্যপণ্য তৈরি করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির ইতিহাস
জানা গেছে, গত অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি হয়নি। গত ২২ বছরে দেশটি থেকে সোয়া ২২ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ১৭ লাখ টনের বেশি আমদানি হয়। সরকারি খাতে তিন লাখ টন আমদানি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই দশকে সবচেয়ে বেশি সাড়ে চার লাখ টন গম আমদানি হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে। বেসরকারি সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, নাবিল গ্রুপসহ কয়েকটি গ্রুপ এই গম আমদানি করে। সরকারি খাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বশেষ গম আমদানি হয় ২০১৭ সালে।
জানতে চাইলে ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্যঘাটতি কমাতে হলে বেসরকারি খাতে আমদানি বাড়ানোর বিকল্প নেই। তুলনামূলক দাম কিছুটা বেশি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের গমের মান ভালো। প্রতিযোগিতামূলক দাম ও সুবিধা পেলে দেশটি থেকে বেসরকারি খাতেও গম আমদানি বাড়তে পারে।
আমিরুল হক বলেন, গমের পাশাপাশি তুলা, এলপিজি, সয়াবিন ও ইস্পাত কারখানার কাঁচামাল স্ক্র্যাপ (লোহার টুকরা) এই চার পণ্যে চার বিলিয়ন ডলার আমদানির সুযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ জন্য সরকারের লজিস্টিকস খাতে নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল খ টন গম আমদ ন য ক তর ষ ট র থ ক য ক তর ষ ট র র গম আমদ ন র ন গম আমদ ন ব সরক র ম লক দ
এছাড়াও পড়ুন:
শেষে এসে ‘বিপদে’ ওয়াসা
একের পর এক জটিলতায় পড়ছে চট্টগ্রাম ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পটি। অর্থ বরাদ্দের সংকট, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বকেয়া নিয়ে বিরোধ, কাজের ধীরগতি—সব মিলিয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজ বর্ধিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
প্রায় ৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ২২টি ওয়ার্ডের ২০ লাখ মানুষের জন্য আধুনিক পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা রয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৭০ শতাংশ। এই সময়ে এসে নানা জটিলতায় ‘বিপদে’ পড়েছে ওয়াসা।
‘চট্টগ্রাম মহানগরের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এরপর প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। মেয়াদ বেড়েছে তিন দফা। ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি।
বর্তমানে অর্থ বরাদ্দের সংকট নিয়ে বিপাকে আছে ওয়াসা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্থাটি চেয়েছিল ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে ৭৪৪ কোটি। চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) দরকার ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৬৭৬ কোটি টাকা। প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত করা কাজের টাকা আমরা পাইনি। আগেও একই কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, পরে আশ্বাস পেয়ে শুরু করেছিলাম। এবারও সেই পরিস্থিতি।প্রকল্প পরিচালক, এসএ ইঞ্জিনিয়ারিংসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই নির্বাচনী মৌসুমে প্রকল্প বরাদ্দে আরও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। অর্থ না এলে প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়বে। ২০২৭ সালের শুরুতে এ প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। কাজ শেষ না হলে এই পরিকল্পনা পিছিয়ে যাবে।
জানতে চাইলে ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, গত বছরই অর্থ বরাদ্দের অভাবে অনেক কাজ আটকে ছিল। এ বছরও চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পেলে সময়সীমা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের বিষয়ে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
বর্তমানে অর্থ বরাদ্দের সংকট নিয়ে বিপাকে আছে ওয়াসা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্থাটি চেয়েছিল ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে ৭৪৪ কোটি। চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) দরকার ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৬৭৬ কোটি টাকা।প্রকল্পের নথিতে বলা হয়, দৈনিক ১০ কোটি লিটার পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পয়োশোধনাগার, দৈনিক ৩০০ ঘনমিটার পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সেপটিক ট্যাংকের বর্জ্য শোধনাগার, ২০০ কিলোমিটার পয়োনালা নির্মাণ করা হবে। এতে চট্টগ্রাম নগরের ২২টি ওয়ার্ডের ৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রকল্পের আওতায় আসবে। আর উন্নত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার সুফল পাবেন ২০ লাখ মানুষ।
এখনো কাজ বন্ধ, অর্থের টানাপোড়েন
প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ ১৫ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাইয়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড উপঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধ না করায় সাতটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান কাজ বন্ধ রেখেছে।
হালিশহর এলাকায় পাইপ বসানোর কাজ করছে মেসার্স নূর এন্টারপ্রাইজ, এসএ ইঞ্জিনিয়ারিং, জাহান এন্টারপ্রাইজ, দেশ কন্ট্রাক্টরস অ্যান্ড ডেভেলপার লিমিটেড, ইনাস এন্টারপ্রাইজ, পোর্ট হারবার ইন্টারন্যাশনাল ও পাওয়ার বাংলা করপোরেশন। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তাদের প্রায় ৪৬ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার তাইয়ং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় উপঠিকাদাররা দুটি শর্তে কাজ শুরুতে রাজি হয়েছেন—আগামী সোমবারের মধ্যে ৫০ শতাংশ বকেয়া পরিশোধ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি অর্থ নিষ্পত্তি।
জানতে চাইলে এসএ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রকল্প পরিচালক আহাদুজ্জামান বাতেন বলেন, ‘চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত করা কাজের টাকা আমরা পাইনি। আগেও একই কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, পরে আশ্বাস পেয়ে শুরু করেছিলাম। এবারও সেই পরিস্থিতি।’
আহাদুজ্জামান জানান, ‘মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনায় আমরা দুটি শর্ত দিয়েছি—সোমবারের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিল পরিশোধ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি অর্থ নিষ্পত্তি। এ দুই শর্তে কাজ আবার শুরু করছি।’