সকালে নিজেই স্কুলড্রেস পরে জুনায়েত হাসান। চুল আঁচড়ায়। গরম ভাত আর ডিমের তরকারি টিফিন বক্সে ভরে নেয়। এরপর বড় ভাইয়ের সঙ্গে বাবার মোটরসাইকেলে চড়ে স্কুলে যায়। স্কুলে পৌঁছানোর পর বাবা জানতে চান, স্কুলব্যাগ ভারী লাগছে কি না। মাথা নেড়ে ‘না’ বলেছিল। বাবা বেশি করে পানি খেতে বললে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে হাসি মুখে স্কুলে ঢুকে যায়।

রুটিন অনুযায়ী অন্য দিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরত জুনায়েত। তবে সোমবার স্কুল ছুটির পর আর তার বাড়ি ফেরা হয়নি। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত জুনায়েত। তিন মাস পর শিশুটির বয়স হতো ১১। 

মুখ, গলা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে দগদগে লাল হয়ে আছে। ছেলের মুখটা ঠিকই চেনা যাচ্ছে। স্কুলড্রেসের মধ্যে শুধু প্যান্টের কিছু অংশ শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। ছোট্ট দেহটায় ততক্ষণে প্রাণ নেই।

সাপ্তাহিক বা অন্য ছুটি না থাকলে জুনায়েত প্রতিদিন স্কুলের জন্য নিজেই তৈরি হতো। নিজের কাজ নিজেই করত। সোমবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তবে সেদিন ভিন্ন ‘ব্যতিক্রম’ যোগ হয় তার রুটিনে। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বিছানায় শুয়ে থাকা মাকে সালাম করে বিদায় নিয়েছিল জুনায়েত।

বাবা, মা ও অন্যরা তাকে স্কুলে গিয়ে দেড়-দুই ঘণ্টা হন্যে হয়ে খুঁজেছেন। পরে ফেসবুকে ছেলের স্কুলের আইডি কার্ড নিয়ে একজনের পোস্ট দেখে জানতে পারেন, জুনায়েত হাসপাতালে আছে। গিয়ে দেখেন, সকালে পরিপাটি করে আঁচড়ে যাওয়া চুলগুলো পুড়ে মাথার সঙ্গে লেপ্টে আছে। মুখ, গলা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে দগদগে লাল হয়ে আছে। ছেলের মুখটা ঠিকই চেনা যাচ্ছে। স্কুলড্রেসের মধ্যে শুধু প্যান্টের কিছু অংশ শরীরের সঙ্গে লেগে আছে। ছোট্ট দেহটায় ততক্ষণে প্রাণ নেই।

সোমবার দুপুরে বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বরের একটি দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত মোট ৩২ জন নিহত হয়েছেন। আহত ১৬৫ জন।

নিহতদের তালিকায় নাম উঠেছে জুনায়েতের। ফলে আর কোনো সকালে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে না তাকে। স্কুলের আইডি কার্ডে বাংলা মাধ্যমে পড়ুয়া জুনায়েতের কোড নম্বর ছিল ২০৬৬।

জুনায়েতের এই আইডি কার্ড বা পরিচয়পত্রের ছবি ও নিজের মুঠোফোন নম্বর দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন শেখ রমজান। জুবায়েতকে প্রথমে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে কেউ নিয়ে গিয়েছিলেন। শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেওয়ার কথা বলা হয়। তবে জুনায়েতের সঙ্গে পরিবারের কোনো সদস্য ছিল না। অ্যাম্বুলেন্সে করে আরেক শিশুর পরিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যাচ্ছিল। রমজান ওই পরিবারের সঙ্গে জুনায়েতকে নিয়ে রওনা দেন। অ্যাম্বুলেন্সে বসেই রমজান ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জানান, জুনায়েতকে বার্ন ইউনিটে নেওয়া হচ্ছে। তার অভিভাবক পাওয়া যায়নি। যদি কেউ জুনায়েতকে চিনতে পারে, তাহলে যেন রমজানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন।

বাচ্চাটির শরীর ঝলসে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সে বসেই বুঝতে পারি, বাচ্চাটা মারা যাচ্ছে। পরে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরাও জানান বাচ্চাটি মারা গেছে।শেখ রমজান

রমজানের এ পোস্ট ফেসবুকে উত্তরার বিভিন্ন গ্রুপসহ বিভিন্ন মানুষ শেয়ার দিতে শুরু করেন; ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে (ভাইরাল) পড়ে। আর রমজানকে সেদিন অনেক ফোন রিসিভ করতে হয়। রমজান কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের একজন কর্মী (আউটসোর্সিং)।

গতকাল দুপুরে রমজান টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চাটির শরীর ঝলসে গিয়েছিল। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সে বসেই বুঝতে পারি, বাচ্চাটা মারা যাচ্ছে। পরে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকেরাও জানান বাচ্চাটি মারা গেছে।’

রমজান জানান, গতকাল (সোমবার) জুনায়েতের পরিবারের সদস্যরাও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরিবারের সদস্যরা এলে সন্ধ্যার দিকে তিনি হাসপাতাল ছাড়েন। শিশুটিকে বাঁচাতে পারলেন না—সে আক্ষেপ তো আছেই। এরপরও শিশুটির লাশ পরিবারের সদস্যদের বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন, তাতেও একধরনের সান্ত্বনা খুঁজছেন রমজান।

জুনায়েতের বাবা মোহাম্মদ আসলাম চালের ব্যবসা করেন। ঢাকার তুরাগ থানার অধীনে নয়ানগরের স্থানীয় বাসিন্দা। তিনি জানান, তাঁর বড় ছেলে রাকিবুল হাসান মাইলস্টোন স্কুলেরই ছাত্র, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। একই ক্যাম্পাসে দুই ছেলের ক্লাস হতো আলাদা ভবনে। জুনায়েত যে ভবনে ক্লাস করত, সেটির সামনেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল।

প্রতিদিন সকাল সাড়ে সাতটায় দুই ছেলেকে মোটরসাইকেলে নিয়ে বের হতেন আসলাম। তাদের স্কুল ছুটি হতো বেলা একটায়। এরপর টিফিনের বিরতির পর শুরু হতো কোচিং। শেষ হতো বিকেল সাড়ে তিনটায়। স্কুল থেকে দুই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। সোমবার দুপুরে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেয়েই দ্রুত ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছান।

স্কুলে গিয়ে ছেলেকে খুঁজতে থাকেন, তখন চোখের সামনেই অনেক শিশুর লাশ দেখেছেন বলে জানালেন আসলাম। বললেন, একেকটা লাশ কয়লা হয়ে গেছে!

আসলাম বলেন, ‘বড় ছেলেকে সহজেই খুঁজে পাই। ঘণ্টা দেড়েক ছোটাছুটি করেও ছোট ছেলেকে পাই নাই। পরে ফেসবুক দেখে হাসপাতালে গিয়ে ছেলেকে আর জীবিত পাই নাই।’

ছেলেটা (জুনায়েত) নিজের কাজ নিজে করত। নিজের জুতা নিজেই কালি করত। মাকে নানান কাজে সাহায্য করত। মিশুক ছিল। কোনো বায়না বা মর্জি করত না—আসলাম এভাবেই ছেলের বর্ণনা করছিলেন।

স্কুলে গিয়ে ছেলেকে খুঁজতে থাকেন, তখন চোখের সামনেই অনেক শিশুর লাশ দেখেছেন বলে জানালেন আসলাম। বললেন, একেকটা লাশ কয়লা হয়ে গেছে!

আসলাম বলেন, ‘আমার কাছে স্কুলের কয়েকজন জানতে চায়, ছেলে কোন ক্লাসে পড়ত। উত্তরে তৃতীয় শ্রেণি শুনেই তারা চুপ করে যাচ্ছিল। তখনই বুঝে যাই হয়তো এই ক্লাসের বেশি বাচ্চা মারা গেছে!’

নয়ানগরে স্থানীয় কবরস্থানে জুনায়েতকে দাফন করা হয়েছে। পড়াশোনায় ভালো ছিল। আইডি কার্ড ছাড়া স্কুলব্যাগ, জুতা কিছুই পাওয়া যায়নি।

এই পরিবারের আরেক শিশুর প্রাণ গেছে সোমবারের দুর্ঘটনায়। সে-ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল, নাম সারিয়া আক্তার।

আসলামের চাচাতো ভাই মুস্তাকিম জানালেন, তাঁর আরেক মামাতো ভাইয়ের মেয়ে সারিয়া আক্তার। এ ছাড়া বড় ভাইয়ের এক নাতি, নিলয়, এখনো জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি আছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল র ব র ন ইউন ট পর ব র র স মব র র পর ব ফ সব ক আসল ম রমজ ন সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

ইউরোপে পাইলটদের বেতন কোন দেশে কত

ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বেতনের পেশার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে পাইলট। ফ্রান্সে এটি পঞ্চম সর্বোচ্চ মাসিক বেতনের পেশা। জার্মানিতে জটিল ভূমিকার পাইলটেরা মাসে ২৮ হাজার ৯৬ ইউরো উপার্জন করেন। যুক্তরাজ্যে পূর্ণকালীন পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা মধ্যম আয়ে পঞ্চম স্থানে। ডেনমার্কে ২০২৩ সালে মাসিক বেতন ১৩ হাজার ৫২৩ ইউরো, দেশটির হিসাবে সপ্তম সর্বোচ্চ বেতন।

অভিজ্ঞতা অনুযায়ী বেতনের বৈচিত্র্য

পাইলটদের বেতন দেশ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়। যুক্তরাজ্যে বেতন শুরু হয় বছরে ৫৪ হাজার ২৮৩ ইউরো (৪৭,০০০ পাউন্ড) থেকে, অভিজ্ঞ পাইলটদের জন্য এটি প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৪৩ ইউরো (১ ইউরো সমান ১৪১ টাকা ৭৭ পয়সা, ২২ অক্টোবর ২০২৫ হিসাবে) পর্যন্ত হতে পারে, জানিয়েছে ব্রিটিশ ন্যাশনাল ক্যারিয়ার্স সার্ভিস।

ইআরআই অর্থনৈতিক গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, আট বছরের বেশি অভিজ্ঞতার পাইলটরা এক থেকে তিন বছরের অভিজ্ঞ পাইলটের চেয়ে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ বেশি আয় করেন। অর্থাৎ অভিজ্ঞ পাইলটরা প্রায় তিন গুণ বেশি উপার্জন করেন।

আরও পড়ুনফ্রিল্যান্সিংয়ে নামার আগে এ পাঁচটি বিষয় ভাবুন১৯ অক্টোবর ২০২৫দেশভিত্তিক তথ্য

যুক্তরাজ্য

২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এএনএসের তথ্যানুসারে, পূর্ণকালীন ‘এয়ারক্রাফট পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার’-এর বার্ষিক আয় প্রায় ৯৫ হাজার ২৪০ ইউরো (৮০,৪১৪)। ইআরআইয়ের মতে, গড় বার্ষিক বেতন ৯০ হাজার ২৫৩ ইউরো (৭৮,১৪৬ পাউন্ড), লন্ডনের জন্য ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৬২ ইউরো (১০০,০৬০ পাউন্ড)।

জার্মানি

জার্মানির ফেডারেল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের তথ্যমতে, গড় মাসিক বেতন ১২ হাজার ৫৬৬ ইউরো (বার্ষিক ১,৫০,৭৯২ ইউরো)। মধ্যম আয় ১০ হাজার ২০৭ ইউরো (বার্ষিক ১,২২,৪৮৪ ইউরো), অভিজ্ঞ ও বিশেষায়িত পাইলটদের ক্ষেত্রে তা ৩ লাখ ৪২ হাজার ৭২ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। ইআরআইয়ের তথ্য অনুসারে, এক থেকে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পাইলটের গড় বেতন ৭৩,৭৮৫ ইউরো, আট বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পাইলটদের জন্য ১ লাখ ৩২ হাজার ১১৭ ইউরো।

ফ্রান্স

INSEE জানায়, ‘সিভিল এভিয়েশন টেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল ফ্লাইট অফিসার’দের গড় মাসিক বেতন ৯ হাজার ৩০০ ইউরো (বার্ষিক ১,১১,৬০০ ইউরো)। ERI অনুসারে, অভিজ্ঞ পাইলটদের জন্য গড় বেতন ১ লাখ ৯ হাজার ২৯২ ইউরো।

ছবি: এমিরেটসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

সম্পর্কিত নিবন্ধ