নবায়নযোগ্য জ্বালানির যুগ কড়া নাড়ছে দরজায়
Published: 29th, July 2025 GMT
জ্বালানিশক্তির হাত ধরেই মানবসভ্যতা এগিয়ে চলেছে। আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করা থেকে শুরু করে বাষ্পশক্তির ব্যবহার, পরমাণু বিভাজনের মতো মাইলফলক অর্জন—সবই জ্বালানিশক্তির অবদান।
আজ আমরা এক নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সামনে উঁকি দিচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির এক অপার সম্ভাবনা।
গত বছর নতুন করে যে বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে, তার প্রায় সবটাই এসেছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ দুই ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে যা জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে ৮০০ বিলিয়ন ডলার বেশি।
সৌর ও বায়ুশক্তি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিদ্যুতের উৎস, নবায়নযোগ্য খাতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান, ত্বরান্বিত হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন। অথচ জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য এখনো অনেক বেশি ভর্তুকি দেওয়া হয়।
যেসব দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি আঁকড়ে ধরে আছে, তারা তাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষা তো দিচ্ছেই না; বরং ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ, তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা হারাচ্ছে এবং একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো মানে জ্বালানি সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জীবাশ্ম জ্বালানির বাজারমূল্য অনিশ্চিত, এর সরবরাহে বিঘ্ন ঘটা এবং কিংবা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কবলেও পড়তে হতে পারে, যেমনটি আমরা দেখেছি রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনে আগ্রাসনের সময়; কিন্তু সূর্যালোকের বেলায় মূল্যবৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নেই, বাতাসের ওপরও কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায় না এবং প্রায় প্রতিটি দেশেই এত নবায়নযোগ্য সম্পদ আছে যে প্রত্যেকেই চাইলে জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে।
সর্বোপরি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে। বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত লাখোকোটি মানুষের কাছে দ্রুত, সাশ্রয়ী ও টেকসই বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। বিশেষত অফ-গ্রিড ও ছোট ছোট সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলগুলো এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারে।
সব মিলিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা এ মুহূর্তে অপ্রতিরোধ্য; কিন্তু এই রূপান্তর এখনো যথেষ্ট গতিশীল বা সবার জন্য সহজলভ্যও নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব ডেটা সেন্টারগুলোর সম্মিলিত বিদ্যুৎ খরচ পুরো জাপানের বর্তমান বিদ্যুৎ খরচের সমান হবে। কোম্পানিগুলোর উচিত এ ডেটা সেন্টারগুলোর পরিচালনায় নবায়নযোগ্য উৎস কাজে লাগানোর অঙ্গীকার করা।জ্বালানি খাতে এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির আধিপত্য বিরাজ করছে, এবং কার্বন নিঃসরণ এখনো তার ঊর্ধ্বগতি বজায় রেখেছে। অথচ জলবায়ু–সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি এড়াতে চাইলে এগুলো হ্রাস করা ছাড়া উপায় নেই। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে আমাদের ছয়টি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমত, রাষ্ট্রগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি–নির্ভর ভবিষ্যতের প্রতি পুরোপুরি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে, প্রতিটি দেশ নতুন জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনা জমা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যা জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) নামে পরিচিত।
এনডিসিতে পরবর্তী দশকের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে। এ পরিকল্পনাগুলো অবশ্যই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যেখানে সব ধরনের কার্বন নিঃসরণ ও সব খাতকে পর্যালোচনায় রাখতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট রূপরেখা হাজির করতে হবে।
জি–২০ দেশগুলো, যারা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী, তাদেরই এর গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের জ্বালানিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে। আধুনিক গ্রিড ও স্টোরেজ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি তার পূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত করতে পারবে না; কিন্তু নবায়নযোগ্য উৎসে বিনিয়োগ করা প্রতি ডলারের মধ্যে মাত্র ৬০ সেন্ট ব্যয় হয় গ্রিড ও স্টোরেজ বাবদ। এ অনুপাতটিকে ১/১-এ উন্নীত করতে হবে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্রগুলোকে অবশ্যই বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মেটানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকেও নিজ নিজ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব ডেটা সেন্টারগুলোর সম্মিলিত বিদ্যুৎ খরচ পুরো জাপানের বর্তমান বিদ্যুৎ খরচের সমান হবে। কোম্পানিগুলোর উচিত এ ডেটা সেন্টারগুলোর পরিচালনায় নবায়নযোগ্য উৎস কাজে লাগানোর অঙ্গীকার করা।
চতুর্থত, আমাদের জ্বালানি রূপান্তরে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এর অর্থ হলো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি–নির্ভর আগামীর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করা; এবং সেই সঙ্গে জরুরি খনিজ সরবরাহ-শৃঙ্খল সংস্কার করা।
এ মুহূর্তে এগুলো অধিকার হরণ ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে জর্জরিত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো মূল্য-শৃঙ্খলের তলানিতে বন্দী হয়ে আছে। অবশ্যই এর অবসান ঘটাতে হবে।
পঞ্চমত, আমাদের বাণিজ্যকে জ্বালানি রূপান্তরের সহায়ক হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগাতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের শৃঙ্খলটি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং এ মুহূর্তে বৈশ্বিক বাণিজ্য আর এককেন্দ্রিক থাকছে না। নতুন জ্বালানিব্যবস্থার যুগের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলোর উচিত সরবরাহে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করা, নবায়নযোগ্য উৎসের পণ্যে শুল্ক কমানো এবং বিনিয়োগ চুক্তি আধুনিকীকরণ করা যাতে তারা এই রূপান্তরকে এগিয়ে নিতে পারে।
ষষ্ঠত ও শেষত, আমাদের উচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া। আফ্রিকা গত বছর নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের মাত্র ২ শতাংশ পেয়েছে, যদিও বিশ্বের সেরা সৌর শক্তির ৬০ শতাংশ উৎস এ মহাদেশে রয়েছে। আমাদের কিছু আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে—যাতে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজেটে টান না পড়ে এবং বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলো যাতে তাদের ঋণদান ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে এবং অনেক বেশি বেসরকারি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারে।
আমাদের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো ও বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি মূল্যায়ন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে, যাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিশ্রুতি, জলবায়ু সংকটের ক্ষতিপূরণ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পদ বিকল হয়ে পড়ার ঝুঁকির আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হয়।
এক নতুন জ্বালানি সম্ভাবনার যুগ আমাদের হাতছানি দিচ্ছে—এমন এক যুগ যেখানে সাশ্রয়ী, নবায়নযোগ্য, প্রাচুর্যময় জ্বালানি এক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধিশালী পৃথিবীকে শক্তি জোগাবে, যেখানে রাষ্ট্রগুলোর জ্বালানি স্বয়ংসম্পূর্ণতার নিশ্চয়তা থাকবে এবং বিদ্যুৎসেবা থাকবে সব নাগরিকের হাতের মুঠোয়।
ঠিক এ মুহূর্ত আমরা চাইলেই বৈশ্বিকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে পারি। আসুন, আমরা এই সুযোগকে কাজে লাগাই।
আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের মহাসচিব
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন ট রগ ল র ব দ য ৎ খরচ ন শ চ ত কর র প ন তর সরবর হ র জন য আম দ র ত করত
এছাড়াও পড়ুন:
পায়রা বন্দরসহ দুই প্রকল্পের ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদন
পায়রা বন্দরের জন্য সংশ্লিষ্ট পরিসেবাসহ দুটি শিপ টু শোর ক্রেন সরবরাহ এবং নারায়ণগঞ্জের খানপুরে অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার এবং বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পে কাজের ক্রয় প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। প্রস্তাব দুটিতে ব্যয় হবে ৪৫০ কোটি ১১ লাখ ১০ হাজার ২৫৪ টাকা।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সচিবালয়ে মন্ত্রি পরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় কমিটির সদস্য ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভা সূত্রে জানা যায়, পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ (২য় সংশোধিত)’ প্রকল্পের আওতায় সংশ্লিষ্ট পরিসেবাসহ দুটি শিপ টু শোর ক্রেন সরবরাহ এবং স্থাপন কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে ৪টি প্রতিষ্ঠান দরপ্রস্তাব দাখিল করে। দরপত্রের সব প্রক্রিয়া শেষে টিইসি কর্তৃক সুপারিশকৃত রেসপনসিভ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে (১) এইচপি এবং (২) এনজে, চায়না প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এতে ব্যয় হবে ১৬২ কোটি ২ লাখ ১১ হাজার ৫৬৮ টাকা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ‘নারায়ণগঞ্জের খানপুরে অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার এবং বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণ (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্পের প্যাকেজ নম্বর দুইয়ের পূর্ত কাজের ক্রয় প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কমিটি। এ জন্য উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হলে ২টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। দরপত্রের সকল প্রক্রিয়া শেষে টিইসি কর্তৃক সুপারিশকৃত রেসপনসিভ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে (১) স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স এবং (২) এসএস রহমান ইন্টারন্যানাল লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। এতে ব্যয় হবে ২৮৮ কোটি ৮ লাখ ৯৮ হাজার ৬৮৬ টাকা।
ঢাকা/হাসনাত//