ব্যবসায়ীরা টিকিট ‘রিফান্ড’ আতঙ্কে, টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা
Published: 3rd, August 2025 GMT
উড়োজাহাজের অনলাইন টিকিট বুকিংয়ে দেশের অন্যতম প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ বন্ধের ঘটনায় বিপাকে পড়েছে দেশের বেশ কিছু ছোট ও মাঝারি টিকিট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান।
অন্তত ৬৯ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তাদের ২৭ কোটি টাকার বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এর বাইরেও ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধ হয় শনিবার। ছোট ও মাঝারি টিকিট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান বলছে, এদিন রাতেই ফ্লাইট এক্সপার্টের মাধ্যমে আগাম কেটে রাখা উড়োজাহাজের টিকিট রিফান্ড করা শুরু করে সোমা ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি বড় টিকিট বিক্রেতা এজেন্সি। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। টিকিটের দাম বাবদ ফ্লাইট এক্সপার্টকে পরিশোধ করা টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েও তারা অনিশ্চয়তায় রয়েছে।
আবুল হোসেন নামে একজন ভুক্তোভোগী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সোমা কেন গতকাল (শনিবার) রাতে অফিস বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে ভিতরে বসে সব পিএনআর (যাত্রীদের নামের রেকর্ড) রিফান্ড করছে? সেই জবাব ওপেন দিতে হবে। তারা কেন অপেক্ষা করল না? তারা কেন সবার সাহায্য চাইল না?’
আবুল হোসেন আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই স্ক্যামিংয়ের (ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধ হওয়া) বিষয়ে ওরা জানত। না হলে লুকিয়ে এসব কাজ করবে কেন?’
ফ্লাইট এক্সপার্ট দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইনসের টিকিট বুকিং, হোটেল রিজার্ভেশন (কক্ষ সংরক্ষণ), ট্যুর প্যাকেজ ও ভিসা প্রক্রিয়াকরণের মতো সেবা দিত। বিশেষ করে কম খরচে সহজে টিকিট বুকিংয়ের সুবিধার কারণে প্ল্যাটফর্মটি জনপ্রিয় ছিল। শনিবার প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়।
ফ্লাইট এক্সপার্টের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে মালিকপক্ষ দেশ ছেড়েছে। এতে গ্রাহক ও সরবরাহকারীদের কোটি কোটি টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
যদিও ফ্লাইট এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সালমান বিন রশিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, টাকা নিয়ে পালানোর অভিযোগ মিথ্যা। তিনি কর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শনিবার দেওয়া এক বার্তায় বলেছেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তিনি নিজেকে হুমকি ও অপবাদ থেকে রক্ষা করতেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিচ্ছেন এবং দেশ ছাড়ছেন।
ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধের খবরে শোরগোল তৈরি হয়। টিকিট বিক্রেতা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠানটির মতিঝিলের কার্যালয়ে ভিড় করে।
ভুক্তোভোগীরা জানিয়েছেন, আজ রোববার সকাল থেকে বিভিন্ন এয়ারলাইনসে কাটা অনেক টিকিট যাত্রীদের নামের রেকর্ডে (পিএনআর) তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন না। তাদের অভিযোগ, সোমা ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি এজেন্সি টিকিট রিফান্ড শুরু করেছে। হাজী এয়ার ট্রাভেলস আগামীকাল থেকে রিফান্ডের ঘোষণা দিয়েছে বলেও জানান তাঁরা।
পরে দুপুরে রাজধানীর পল্টনে সোমা ইন্টারন্যাশনালের কার্যালয়ে গিয়ে জানতে চাইলে সেখানকার কর্মকর্তারা বলেন, তাঁদের সিলেট কার্যালয় থেকে বিষয়টি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তাঁরা কিছু জানেন না।
সোমা ইন্টারন্যালের সিলেট কার্যালয়ের মুঠোফোনে বহুবার যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে আজ বিকেলে সোমা ইন্টারন্যাশনালের ঢাকা কার্যালয়ে যান ভুক্তোভোগী প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা। সেখানে তাঁরা রিফান্ড হওয়া টিকিটের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
ফ্লাইট এক্সপার্টের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক থাকা কোম্পনিগুলোর সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটি নিজেদের আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ) নম্বর ছাড়াও অন্য বেশ কয়েকটি কোম্পানির আইএটিএ নম্বর ব্যবহার করে টিকিট কাটত।
এর মধ্যে রয়েছে মক্কা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, সোমা ইন্টারন্যাশনাল, হাজী এয়ার ট্রাভেলস, প্রোমা প্রমুখ। ফ্লাইট এক্সপার্ট বন্ধ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে ওই কোম্পানিগুলোর কেউ কেউ টিকিট রিফান্ড করে টাকা তুলে নেওয়া শুরু করে। এতে বিপাকে পড়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি এজেন্সিগুলো, যারা গ্রাহককে টিকিটের নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের থেকে টিকিটের দাম সংগ্রহ করেছে এবং তা ফ্লাইট এক্সপার্টকে পরিশোধ করেছে।
কুমিল্লার ছোট একটি এজেন্সির মালিক মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন এয়ারলাইনস মিলিয়ে তাঁর মোট ৯টি টিকিট কাটা ছিল। যেগুলোর মূল্য ৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। রোববার সকালে সেগুলোর মধ্যে প্রায় এক লাখ টাকার দুটি টিকিট বাতিল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘বাকিগুলো নিয়েও শঙ্কায় আছি। ওগুলোও বাতিল হলে পথে বসা ছাড়া উপায় নেই।’
অবশ্য এজেন্সিগুলো যেন টিকিট রিফান্ড করতে না পারে, সে বিষয়ে আগামীকাল মন্ত্রণালয়ে একটি অনুরোধপত্র দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর সেটির মালিক যাত্রী। কেউ রিফান্ড করে থাকলে যাত্রী যদি অভিযোগ দেন, তাহলে সরকার সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিতে পারে। তিনি বলেন, ভুক্তভোগীদের কাছে তাঁরা তথ্য-উপাত্ত চেয়েছেন। সেগুলো একসঙ্গে করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এ ঘটনায় আটাবের পক্ষ থেকে ফ্লাইট এক্সপার্টের মালিককে কারণ দর্শানোরে নোটিশ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
আরও পড়ুনফ্লাইট এক্সপার্ট হঠাৎ বন্ধ, মালিক ও কর্মকর্তার পাল্টাপাল্টি অভিযোগ০২ আগস্ট ২০২৫৬৯ ব্যবসায়ীর প্রায় ২৭ কোটি টাকা ঝুঁকিতে
ফ্লাইট এক্সপার্টের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল এমন ৬৯টি টিকিট বুকিং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিজেদের তথ্য জানিয়েছে।
তাদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ৬৯ ব্যবসায়ীর ২৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে এর পাশাপাশি অগ্রিম টিকিট কাটার জন্য অনেক এজেন্সি ফ্লাইট এক্সপার্টের ‘ওয়ালেটে’ টাকা জমা রাখত। সেই টাকা ফেরত পাওয়া নিয়েও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
এমন একজন ভুক্তভোগী এফএ বিডি এজেন্সির মালিক লুতফুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা ফ্লাইট এক্সপার্টের ডিজিটাল ওয়ালেটে থেকে গেছে। এই টাকা ফেরত পাবেন কি না, তা তিনি জানেন না।
যাত্রীর নামে ইস্যু হওয়া টিকিট যাত্রীর অনুমতি ছাড়া রিফান্ড কেন হলো, এমন প্রশ্ন তোলেন ফ্লাইট ইওরস ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গিয়াস ইউ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আপৎকালে সবগুলো এয়ারলাইনসকে বাধ্য করা উচিত কোনো যাত্রীর অনুমতি ছাড়া তাঁর টিকিট বাতিল বা কোনো পরিবর্তন যেন না আনা হয়।
গ্রেপ্তার তিনজন কারাগারে
রাজধানীর মতিঝিল থানায় শনিবার রাতে ফ্লাইট এক্সপার্টের বিরুদ্ধে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেন এক ভুক্তভোগী। রাতেই ফ্লাইট এক্সপার্টের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গ্রেপ্তার তিনজন হলেন এজেন্সির হেড অব ফিন্যান্স সাকিব হোসেন (৩২), চিফ কমার্শিয়াল অফিসার সাঈদ আহমেদ (৪০) ও চিফ অপারেটিং অফিসার এ কে এম সাদাত হোসেন (৩২)।
আজ তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, বিপুল সরকার নামের এক গ্রাহক গতকাল শনিবার রাতে মতিঝিল থানায় মামলাটি করেন। এতে পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।
বাকি দুজন আসামি হলেন ফ্লাইট এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সালমান বিন রাশিদ শাহ সাঈম ও তাঁর বাবা এম এ রাশিদ। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন ওসি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক র ফ ন ড কর কর মকর ত ট র ভ লস ন ফ ল ইট ব যবস থ ব যবস য় মত ঝ ল গ র হক
এছাড়াও পড়ুন:
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজিদকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়
ছবি: সংগৃহীত