চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ড: ট্রাম্প কি দাঙ্গা–ফ্যাসাদকেই নীতি হিসেবে নিয়েছেন
Published: 15th, September 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রে কয়েক দিন আগে কট্টর ডানপন্থী নেতা চার্লি কার্ককে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় দেশের দুই রাজনৈতিক শিবির (ডানপন্থী ও বামপন্থী) শান্তভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালেও এটি আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ভারসাম্য নেই। কারণ, ডানপন্থী অনেক নেতা, এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও খুনির পরিচয় বা উদ্দেশ্য না জেনেই সরাসরি বামপন্থীদের দোষারোপ করেছেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ডাক দিয়েছেন।
ট্রাম্প প্রায় এক দশক ধরে ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন, তাঁর সমর্থকদের রাজনৈতিক সহিংসতা মেনে নেওয়া যায় এবং কখনো কখনো এমন সহিংসতা পুরস্কৃতও হতে পারে। এর অনেক উদাহরণ আছে।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেস ভবনে হামলার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত বহু সহিংস অপরাধীকে ট্রাম্প ক্ষমা করে দিয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, ট্রাম্প ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা এসব কর্মকাণ্ডকে সহিংসতা না বলে এগুলোকে বৈধ, এমনকি দেশপ্রেমিকদের আত্মরক্ষার কাজ হিসেবে দেখিয়েছেন। তাঁরা নিজেদের এমনভাবে ভুক্তভোগী হিসেবে তুলে ধরে আসছেন, ঠিক যেমন অন্য ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদীরাও নিজেদের সব সময় ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন করেন।
চার্লি কার্ক হত্যার পর কিছু বামপন্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশোভন মন্তব্য করেছেন। তাঁরা বিদ্রূপ করে বলেছেন, কার্ক নিজেই বলেছিলেন, বন্দুক হামলায় মৃত্যু মানা যেতে পারে। কারণ, এটি অস্ত্র রাখার অধিকার নিশ্চিত করার মূল্য। কিন্তু সামগ্রিকভাবে দেখা গেছে, উদারপন্থী লেখক ও সমালোচকেরা শুধু সহিংসতাকে নিন্দা করেননি; বরং কার্ককে একজন সৎ বিতর্ককারী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিপরীতে ডানপন্থী অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি দমননীতির ডাক দিয়েছেন। কেউ কেউ সরাসরি ‘যুদ্ধের’ কথাও বলেছেন। এমনকি এফবিআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা জে এডগার হুভারের বেআইনি কৌশল অনুসরণ করতে হবে, এমন বক্তব্যও দিয়েছেন।
আরও উদ্বেগজনক হলো ট্রাম্প নিজেই এ হত্যাকাণ্ডকে নিজের অপছন্দের সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোর ওপর আক্রমণের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছেন। তাঁর প্রশাসনের কয়েকজন সদস্য আগেই ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ‘দেশীয় সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে ঘোষণা করেছিলেন। ট্রাম্প আগেও দেখিয়েছেন, তিনি ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে যেকোনো ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে যেতে দ্বিধা করেন না। তাই বিরোধীদের বিচারের হুমকি শুধুই ডেমোক্র্যাটদের জন্য নয়, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সবার জন্যই ভয়ংকর সংকেত।
অনেকে আশা করেন, ট্রাম্প একদিন রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ঐক্যের পথ ধরবেন। কিন্তু কার্ক হত্যার রাতের ঘটনা দেখাচ্ছে, ট্রাম্পের বিভাজনমূলক কৌশল চলতে থাকবে। দুর্ভাগ্য হলো, এখন তাঁর প্রশাসন ‘মতবিরোধের স্বাদ’ নয়; বরং ‘নিষ্ঠুরতার স্বাদ’ প্রচলিত করছে। আর কিছু মানুষ সেটিকেই গ্রহণ করছে।ট্রাম্প শুধু আইন অমান্য করেননি, বারবার রাজনৈতিক সহিংসতাকে উসকিয়েছেন। ফিফথ অ্যাভিনিউয়ে কাউকে গুলি করার কল্পনা করা, সমর্থকদের বিরোধীদের মারধর করানোর আহ্বান, ভার্জিনিয়ার শার্লটসভিলে সহিংস শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের ‘ভালো মানুষ’ বলা, এমনকি ৬ জানুয়ারি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে ফাঁসিতে ঝোলানোর হুমকি দেখেও আপত্তি না করা—সবই এর প্রমাণ। এসব উসকানি দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকাই তাঁর লক্ষ্য ছিল।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ ছিল নিষ্ঠুরতার বড় প্রদর্শনী। এবার তাঁর প্রশাসন সরাসরি সহিংসতার বন্দনা করছে। ভেনেজুয়েলার উপকূলে ১১ জনকে কোনো আইনি কারণ ছাড়াই হত্যা করা হয়েছে এবং সে খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনন্দের সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি নিয়মিতভাবে এমন ছবি ছড়াচ্ছে, যেখানে প্রিয়জনদের জোর করে তুলে নেওয়ার পর তাঁদের পরিবারের মানুষদের কষ্ট দেখানো হচ্ছে। এক পোস্টে দেখা গেছে, আইসিইয়ের কর্মীরা নাৎসি হেলমেট পরে ছবি তুলছেন। ট্রাম্প হয়তো এবার তাঁর অনুসারীদের জন্য সব বাঁধন খুলে দিচ্ছেন। কারণ, তিনি নিজেই আইন ও নিয়মকে অগ্রাহ্য করে চলেছেন।
আরও পড়ুনট্রাম্প ও নেতানিয়াহু মূলত ‘জেনোসাইড পুরস্কারের’ যোগ্য ২৭ আগস্ট ২০২৫দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প নিজেকে অপরাধী না বলে ভুক্তভোগী হিসেবে দেখাচ্ছেন। তাঁর পেছনে পুরো এক ‘অভিযোগ ইন্ডাস্ট্রি’ কাজ করছে। ফক্স নিউজ থেকে শুরু করে টক-রেডিও—সব জায়গায় প্রচারকেরা বলছেন, ট্রাম্পপন্থীদের রাগ হওয়া স্বাভাবিক। এই ভুক্তভোগিতাকেই এখন সহিংসতার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে এর মানে এই নয় যে যুক্তরাষ্ট্র গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। কিছু লোক হয়তো তা চাইছে বা তার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু জরিপ দেখাচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক সহিংসতার বিপক্ষে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ট্রাম্পের ওপর হামলার পরও সহিংসতার প্রতি সমর্থন কমেছে।
অনেকে আশা করেন, ট্রাম্প একদিন রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ঐক্যের পথ ধরবেন। কিন্তু কার্ক হত্যার রাতের ঘটনা দেখাচ্ছে, ট্রাম্পের বিভাজনমূলক কৌশল চলতে থাকবে। দুর্ভাগ্য হলো, এখন তাঁর প্রশাসন ‘মতবিরোধের স্বাদ’ নয়; বরং ‘নিষ্ঠুরতার স্বাদ’ প্রচলিত করছে। আর কিছু মানুষ সেটিকেই গ্রহণ করছে।
● জ্যঁ ভার্নার ম্যুলার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক র ক হত য র র জন ত র জন ত ক ড নপন থ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস
বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর মানচিত্রে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান নামের এই পাঁচটি দেশ ছিলো না। মূলত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাষ্ট্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে চীনের সহায়তায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে পুনরুত্থান হয়েছে। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, চীন কেন আবারও এই অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে?
ঐতিহাসিকভাবে মধ্য এশিয়া অঞ্চল সিল্করোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সভ্যতার সাথে যুক্ত করেছিলো। বীজ গণিতের জনক আল খারিজমি, আবু সিনার মতো বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে এখানে। যাদের লেখা বই ইউরোপে শত শত বছর ধরে চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। চেঙ্গিস খানও এই অঞ্চলে তার সম্রাজ্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে আদিম যাযাবর জীবনের ঐতিহ্যও টিকে আছে এখানে।
আরো পড়ুন:
রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবার রোমানিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ
রাশিয়ায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা
রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলো রুশরা। উপনিবেশিক শাসন এমনভাবে চালু করেছিলো, যা অনেকটা ব্রিটিশ বা ফরাসি সম্রাজ্যের মতো দেখতে।
রাজ্যগুলোকে শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি যাযাবর জাতিকে যুদ্ধ যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাযাবর জাতিকে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে কাজাখ জনগোষ্ঠীর চল্লিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর যে অর্থনীতি, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ সোভিয়েত আমলে কাজাখ যাযাবররা যে পশুপালন করতো তার নব্বই শতাংশই মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কাজাখদের যাযাবর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হয়। বলতে গেলে সোভিয়েত আমলে কাজাখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বেদনাদায়ক পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েন ইউনিয়নের পতন হয়, সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি স্বাধীন দেশের। এই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলো নিজস্ব সীমানার মধ্যে এক অনন্য পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের ওপর বাইরের প্রভাবও রয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি আরও বেশি জানান দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত মিল আছে। এমনকি শিক্ষাগত কাঠামোতেও মিল রয়েছে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্য রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচিত।
জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইঘুর বাস করেন। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। এদের নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উইঘুর পরিচয় মুছে ফেলতে তাদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগও আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর চীন মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এই অঞ্চলটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছে, যা অনেকটা সিল্করুটের মতোই।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রাচীন সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার একটি সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এই রোড পুনরুজ্জীবিত হলে রাশিয়া আর চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা এই অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা বাড়বে-সেটাও সময় বলে দেবে।
ঢাকা/লিপি