রাঙামাটির মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬৫০ শিক্ষকের পদ শূন্য, কারণ কী
Published: 1st, December 2025 GMT
রাঙামাটি সদর উপজেলার মাচ্ছ্যাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ রয়েছে ১২টি। তবে এর বিপরীতে কর্মরত মাত্র ৭ জন। বাকি ৫টি পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য পড়ে আছে। এতে বিদ্যালয়টিতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান। মাচ্ছ্যাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ২৬৫ জন। ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় বিদ্যালয়টি থেকে পাস করেছে মাত্র ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
কেবল এই বিদ্যালয় নয়, রাঙামাটিতে সরকারি ও এমপিওভুক্ত প্রায় সব কটি বিদ্যালয়েই রয়েছে এমন শিক্ষকসংকট, যার প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ফলাফলে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটিতে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১। এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১০৬টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষকের পদ প্রায় ১ হাজার ৭০০। তবে এর মধ্যে ৬৫৭ পদে শিক্ষক নেই।
শিক্ষকসংকটের কারণে একজন শিক্ষককে ৪ থেকে ৫টি করে ক্লাস নিতে হয়। অনেক সময় পূর্বনির্ধারিত ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না।মো.তাজুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।
মাচ্ছ্যাপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুবাস বসু চাকমা বলেন, ‘শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো ক্লাস নেওয়া যায় না। শিক্ষকসংকট নিরসনের জন্য আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়ে আসছি।’
জেলা সদরের রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মো. তাজুল ইসলাম জানান, তাঁদের বিদ্যালয়ে ৫৩ জন শিক্ষকের পদ থাকলেও কর্মরত মাত্র ২৯ জন, ২৪টি পদ খালি রয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ রয়েছে ১০টি, তবে মাত্র ২ জন কর্মরত। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের ২টি পদ খালি পড়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘শিক্ষকসংকটের কারণে একজন শিক্ষককে ৪ থেকে ৫টি করে ক্লাস নিতে হয়। অনেক সময় পূর্বনির্ধারিত ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না।’
এসএসসি পরীক্ষায় রাঙামাটিতে ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৭১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তবে ২০২৫ সালে পাসের হার ৫৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে নেমে আসে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শূন্য ৬৫৭টি পদের মধ্যে ৫৫৪টি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বাকি শূন্য পদগুলো ১১টি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে।
শিক্ষকসংকট নিরসন ও শিক্ষার্থীদের আবাসনসংকট দূর করতে জেলা প্রশাসক সম্মেলনকে সামনে রেখে বেশ কিছু প্রস্তাব ও সুপারিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর এসব প্রস্তাব পাঠানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে রাঙামাটি জেলার লংগদু, জুরাছড়ি ও রাজস্থলী উপজেলার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়গুলোয় ৫৩ জন সহকারী শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করা; বিভিন্ন উপজেলায় বিদ্যালয়গুলোয় শূন্য পদে জনবল পদায়ন ও শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা; বিদ্যালয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা।সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জুরাছড়ি ভুবনজয় সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ২০টি, রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ১৯টি, রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে ২৪টি, রাজস্থলী তাইতংপাড়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ৮টি, কাউখালী পোড়াপাড়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ১টি, কাপ্তাই নাড়ানগিরি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ২০টি, নানিয়ারচর সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ে ২টি, বাঘাইছড়ি কাচালং সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ২টি, বরকল সরকারি মডেল উচ্চবিদ্যালয়ে ১টি, লংগদু সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ৪টি, বিলাইছড়ি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ২টি পদ শূন্য রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়।
এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ের মধ্যে লংগদুতে ৯৭টি, কাউখালীতে ৮৬টি, বরকলে ৫৩টি, জুরাছড়িতে ১৩টি, বিলাইছড়িতে ৪টি, নানিয়ারচরে ৩১টি, কাপ্তাইয়ে ৭৮টি, বাঘাইছড়িতে ৬৯টি, রাজস্থলীতে ২৩টি, রাঙামাটি সদরে ১০০টি শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনআরটিসিএ) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়।
রাঙামাটি জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়। সম্প্রতি তোলাউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
হল–মার্কের দেখানো পথেই চলে পরের দেড় দশক
বহুল আলোচিত হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তানভীর মাহমুদের মৃত্যুতে যেন একটি যুগের পরিসমাপ্তি ঘটল। এই সেই তানভীর মাহমুদ, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সূচনা হয়েছিল বড় আকারের দুর্নীতির যাত্রা; যা ‘হল-মার্ক কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত। ২০১১-১২ সালে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখা থেকে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের এই ঘটনা তখন দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি করে। কারণ, তখন দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় এটা ছিল সবচেয়ে বড় আর্থিক অপরাধ।
একটি ব্যাংক থেকে এভাবে টাকা তুলে নেওয়ার ঘটনা শুধু একটি আর্থিক অপরাধ ছিল না, এটি ছিল দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা ও প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতার এক কালো অধ্যায়; যা পরবর্তীকালে আরও বহু ব্যাংক লুট ও দখলের পথকে উসকে দেয়। এরপর ঘটে একের পর এক ব্যাংক দখল, লুটপাট ও অর্থ পাচার; যার ফলে এখন কয়েকটি ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা টাকা তুলতে পারছেন না, কর্মীদের বেতন পেতেও সমস্যা হচ্ছে। সেই পাঁচ ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ৩৬ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে, খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়ে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা।
বহুল আলোচিত হল–মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তানভীর মাহমুদ গত শনিবার রাতে মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জেলে ছিলেন। অসুস্থ হলে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তিনি সেখানে কারা হেফাজতে ছিলেন।
যেভাবে অর্থ বের করে হল-মার্কসোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই হল-মার্ককে প্রথম ঋণ দিয়েছিল। এই সুযোগ নিয়ে রূপসী বাংলা শাখা নিয়মিতভাবে হল-মার্ক গ্রুপকে জালিয়াতি করতে সব ধরনের সহায়তা দেয়। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ কর্মকর্তা এই জালিয়াতির সুযোগ করে দেন বলে অভিযোগ ওঠে। জালিয়াতির ঘটনা যাতে উদ্ঘাটিত না হয়, সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। হাতে গোনা কয়েকজন কর্মকর্তা জালিয়াতির কথা জানতে পেরে তা উদ্ঘাটনের ব্যবস্থা নিলে তাঁদের বদলি করা হয় এক দিনের নোটিশে। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালীদের পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একাধিক উপদেষ্টা ও একজন প্রতিমন্ত্রীর নামও পাওয়া গিয়েছিল।
হল-মার্ক গ্রুপের এমডি ছিলেন তানভীর মাহমুদ আর চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর স্ত্রী জেসমিন ইসলাম। এক যুগ আগের এই ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় করা এক মামলায় ২০২৪ সালের মার্চে তানভীর মাহমুদ, জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক আবুল কাসেম। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলো মনে করেন, তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত বলে আদালত মনে করেন। তবে সংশ্লিষ্ট আইনে এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন, তাই তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।
কীভাবে এই কারসাজি হয়, তা নিয়ে ২০১৬ সালে প্রথম আলোতে একটি বিশেষ লেখা প্রকাশ হয়। বলা হয়, ব্যাংক থেকে হল-মার্কের নেওয়া পৌনে তিন হাজার কোটি টাকার মধ্যে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও চলতি মূলধনজাতীয় ঋণও আছে। তবে এ অর্থের ৮০-৮৫ ভাগই নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে স্থানীয় ঋণপত্র (এলসি) খুলে বের করে নেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়।
যেমন ২০১১ সালের দিকে হল-মার্ক গ্রুপ রূপসী বাংলা শাখায় সুতা কিনতে আনোয়ারা স্পিনিং মিলস, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস ও স্টার স্পিনিং মিলসের অনুকূলে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থানীয় ঋণপত্র খোলে। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান তিনটিও একই শাখার গ্রাহক। একই দিনে এই এলসির অর্থ পরিশোধে নিশ্চয়তা (অ্যাকসেপটেন্স) দেয় হল-মার্ক। তার বিপরীতে একই শাখা তিন প্রতিষ্ঠানের (অ্যাকসেপটেন্স বিল কিনে নিয়ে) হিসাবে টাকা জমাও করে দিয়েছে। এলসির প্রক্রিয়াটি ছিল কাগজপত্রে। কিন্তু নির্ধারিত অংশ জমা রেখে (মার্জিন) ব্যাংক তিন কোম্পানির হিসাবেই টাকা জমা করে দেয়।
এর কয়েক দিন পরই এই প্রতিষ্ঠান তিনটি ওই পুরো টাকা হল-মার্ককে দিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা দেয় ব্যাংককে। ব্যাংক যথারীতি এই তিন প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে অর্থ কেটে হল-মার্কের হিসাবে জমা করে নতুন নজির তৈরি করে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরে হল-মার্কের হিসাব থেকে সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের নামে খোলা একটি চলতি হিসাবে টাকা স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকে টাকাগুলো ‘সুচতুরভাবে’ বের করে নেয় হল-মার্ক গোষ্ঠী। আনোয়ারা স্পিনিং মিলস, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস ও স্টার স্পিনিং মিলস এবং সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের নামে খোলা চলতি হিসাবগুলো অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান। এগুলো প্রকৃত অর্থে হল-মার্কের বেনামি প্রতিষ্ঠান বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নেওয়ার ক্ষেত্রে হল-মার্ক ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে। প্রাথমিকভাবে এগুলো ভুয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল এমন ৮৪টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের তথ্য পেয়েছিল। সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদনে এর মধ্যে গোটা বিশেক প্রতিষ্ঠানকে ‘নিশ্চিত ভুয়া’ বলা হয়।
কেলেঙ্কারির পথ দেখায় হল–মার্কহল-মার্ক কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের ব্যাংক দুর্নীতির ইতিহাসে এক টার্নিং পয়েন্ট। একটি স্বল্প পরিচিত ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান রাতারাতি হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নেয় রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক থেকে। তা–ও আবার ব্যাংকের ভেতরের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে।
এই ঘটনা ব্যাংক লুটেরাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে কীভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানার দুর্বল ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব খাটিয়ে এবং ব্যাংকের ভেতরের সুরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে, দেশের জনগণের আমানতকে সহজে আত্মসাৎ করা যায়। হল-মার্কের লুটের মডেলটিই পরবর্তীকালের ব্যাংক খেকোদের কাছে একধরনের ‘ম্যানুয়াল’ বা নির্দেশিকা হয়ে দাঁড়ায়। পরে আরও অভিনব কৌশল করা হয়।
হল–মার্কের দেখানো পথে অন্যরাহল-মার্কের ঘটনা স্পষ্ট হওয়ার পরই একের পর এক বড় আকারের ব্যাংক জালিয়াতি ও লুটের ঘটনা সামনে আসে। ছিল প্রকাশ্যে ব্যাংক দখল করে লুটপাটের ঘটনাও। হল–মার্কের রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয় বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ বিতরণ করা হয়, যেখানে চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। তখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। একসময়ের ভালো এই ব্যাংক এর মাধ্যমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেওয়া হয়। সোনালী ব্যাংকের হল–মার্ক কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় অভিযুক্তরা আটক হলেও বেসিক ব্যাংকের সবাই পার পেয়ে যায়। ফলে এখন পর্যন্ত কারও বিচার হয়নি।
একই সময়ে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ বিধিবহির্ভূতভাবে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি বের করে নেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ একাই নেয় ২৩ হাজার কোটি টাকা।
২০১৭ সালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা–ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ শুরু করে ব্যাংক দখল। প্রথমে কমার্স ব্যাংক, এরপর ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল করে নেয়। পাশাপাশি ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামীও তার নিয়ন্ত্রণে যায়। এস আলম একাই তুলে নেয় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। সরকার পরিবর্তনের পর এখন বিষয় প্রকাশ্যে আসছে।
খেলাপি ঋণ, ব্যাংক একীভূতকরণ ও আইন পরিবর্তনব্যাংক কেলেঙ্কারির এই লাগামহীন ধারাবাহিকতার চরম পরিণতি হিসেবে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছরই খেলাপি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড ভাঙছে, যার বড় জালিয়াতির মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া। বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত না আসায় ব্যাংকগুলোর মূলধনঘাটতি তৈরি হয়েছে এবং সাধারণ গ্রাহকের আমানত ঝুঁকিতে পড়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক আইন, ব্যাংক কোম্পানি আইনসহ নানা আইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য উন্নতি না হওয়ায় ব্যাংক একীভূতকরণের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একীভূত হতে যাওয়া ওই পাঁচ ব্যাংক হলো ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো তারল্যসংকটের কারণে গ্রাহকেরা টাকা তুলতে সমস্যায় পড়ছেন, কর্মীদের বেতন দিতেও হিমশিম খাচ্ছে।
হল–মার্ক কেলেঙ্কারি ছিল একটি সতর্কতা সংকেত। এই কেলেঙ্কারির পর সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিলে হয়তো পরবর্তী লুটপাটগুলো ঠেকানো যেত। কিন্তু তা না হওয়ায় এক যুগ ধরে চলা এই লুটপাট দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড দুর্বল করে দিয়েছে। লুটেরাদের সাহস ও প্রভাব বাড়ার কারণে আজ ব্যাংকিং খাত এক চরম আস্থার সংকটে ভুগছে। মো. তানভীর মাহমুদের মৃত্যুতে হয়তো হল–মার্কের একটি অধ্যায় শেষ হলো, কিন্তু এর রেখে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আজও গভীর হয়ে থাকল।