সরবরাহ বাড়ছে শীতের আগাম ফুলকপি ও বাঁধাকপির, কমছে দাম
Published: 16th, November 2025 GMT
শীতের আগাম সবজি হিসেবে বাজারে এসেছে ফুলকপি ও বাঁধাকপি। মৌসুমের শুরুতে দাম স্বাভাবিকভাবে কিছুটা বেশি থাকলেও সরবরাহ বাড়ছে। ফলে দাম ইতিমধ্যে কিছুটা কমেছে। খুচরা পর্যায়ে দুই সপ্তাহ আগেও প্রতি পিছ ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা ৪০ থেকে ৬০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।
সরবরাহ বাড়তে থাকায় বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এসব সবজির দাম আরও কমবে। ভরা মৌসুমে খুচরা পর্যায়ে ফুলকপি ও বাঁধাকপির দাম কমে ১০ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে নেমে আসে।
সরকারি তথ্য বলছে, দেশে গত তিন বছরে ফুলকপির উৎপাদন বেড়েছে ১৪ শতাংশ এবং বাঁধাকপির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। উৎপাদন বাড়লেও মৌসুমের শুরুতে সবজির দাম কিছুটা বেশি থাকে। প্রথম দিকে যেসব ফসল আসে, সেগুলো সাধারণত আকারে ছোট হয়। তবে বাজারে সরবরাহও তুলনামূলকভাবে কম থাকা এবং আগাম সবজির বিষয়ে মানুষের আগ্রহ থাকায় দাম বাড়তি থাকে।
ফুলকপি শীতের অন্যতম জনপ্রিয় সবজি। রান্না তরকারি, ভাজি, স্যুপ, হালকা সেদ্ধ কিংবা সালাদ হিসেবে এটি খাওয়া যায়। বাঁধাকপিও ভাজি, স্যুপ ও সালাদ হিসেবে খাওয়া যায়। শীত মৌসুমে স্বাদের দিক থেকেও এ দুটি সবজি অনেকেরই পছন্দ।
উৎপাদন কেমনকৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০২২–২৩ অর্থবছরে দেশে ১৩ লাখ ১২ হাজার টন ফুলকপি উৎপাদন হয়েছিল। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে ১৪ লাখ ৮৫ হাজার টন হয়। সর্বশেষ ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ফুলকপি উৎপাদন আরও বেড়ে ১৫ লাখ টনে ওঠে।
অন্যদিকে ২০২২–২৩ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৮০ হাজার টন বাধাঁকপি উৎপাদন হয়। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে ১৪ লাখ ২৫ হাজার টন হয়। গত অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ১৪ লাখ ৩৩ হাজার টন হয়েছে। অর্থাৎ গত কয়েক বছর ধরে টানা ফুলকপি ও বাঁধাকপির উৎপাদন বাড়ছে।
বাঁধাকপির চেয়ে বেশি জমিতে ফুলকপি চাষ হয়। যেমন, গত অর্থবছরে ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলকপি চাষ হয়েছিল, যেখানে বাধাঁকপি চাষ হয়েছিল ৪৪ হাজার হেক্টরে। উৎপাদনের দিক থেকেও ফুলকপি এগিয়ে।
ফুলকপি-বাঁধাকপি চাষ ও ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে গত দুই বছরে ভালো দাম পাওয়ায় এ বছর তাঁরা আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে এই সবজি দুটির চারা লাগিয়েছেন। তাঁদের প্রত্যাশা, এ বছর শীত মৌসুমেও ভালো ফলন ও দাম পাওয়া যাবে।
এখন আসছে আগাম ফলনকৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সম্প্রসারণ) এইচ এম মনিরুজ্জামান জানান, সাধারণত আগস্টের শেষ কিংবা সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে বারি (শীতকালীন) ফুলকপি ও বাঁধাকপির চাষ শুরু হয়। প্রথমে বীজ বপন করে চারা গাছ তৈরি করা হয়। ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর সেই চারা রোপণ করা হয়। সাধারণত চারা লাগানোর পরে তা বিক্রির উপযোগী হতে ৮০ থেকে ৯০ দিন সময় লাগে। অনেক সময় বাজারে দাম বাড়তি থাকলে ১৫ থেকে ২০ দিন আগেও (ছোট অবস্থায়) ফসল তুলে বিক্রি করেন কৃষকেরা।
আগস্টের শেষ কিংবা সেপ্টেম্বরে যে ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ করা হয়, সেগুলো হচ্ছে আগাম ফসল। বর্তমানে এই আগাম ফুলকপি ও বাঁধাকপি বাজারে আসছে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এসব আগাম সবজি বাজারে আসবে। এরপর মৌসুমের মূল সবজি আসা শুরু করবে।
সাধারণত মৌসুমের শুরুতে কোনো সবজি এলে (আগাম) সেগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। এতে কৃষক, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ী—সবাই লাভবান হন। গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবারও কৃষকেরা আগাম ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষ করেছেন।
আগাম ফুলকপি ও বাঁধাকপি আকারে কিছুটা ছোট হয়। বড় হওয়ার আগেই কৃষকেরা এগুলো তুলে বাজারে আনেন। যেমন, বর্তমানে যেসব ফুলকপি বাজারে আসছে, সেগুলোর ওজন ৪০০ থেকে ৮০০ গ্রামের মধ্যে। ভরা মৌসুমে এক থেকে দেড় কেজি কিংবা তারও বেশি ওজনের ফুলকপি বাজারে আসে। বর্তমানে যেসব বাঁধাকপি আসছে, সেগুলোর ওজন ৮০০ থেকে ৯০০ গ্রামের মধ্যে। পরবর্তী সময়ে দেড়–দুই কেজি আকারের বাঁধাকপি বাজারে আসবে।
চাষ কোথায় বেশিকৃষক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহসহ খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের কয়েকটি জেলা থেকে ফুলকপি ও বাঁধাকপির সরবরাহ বেশি আসছে। ভরা মৌসুমে এসব এলাকার পাশাপাশি মানিকগঞ্জ ও সাভারসহ ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও সবজি দুটির সরবরাহ আসবে।
বিভিন্ন প্রজাতির ফুলকপি ও বাঁধাকপি বাজারে পাওয়া যায়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ফুলকপির ভালো জাতগুলোর মধ্যে বারি ফুলকপি-১ (রুপা), বারি ফুলকপি-২, ৩ ও স্নো হোয়াইট উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া হোয়াইট ফ্লাশ ২০২০ ও অটাম জায়ান্ট হাইব্রিড জাতও রয়েছে। বাঁধাকপির জাতের মধ্যে আছে বারি বাঁধাকপি-১ ও বারি বাঁধাকপি-২ (অগ্রদূত)। আইপিএসএ বাঁধাকপি-১ গ্রীষ্মকালেও চাষ হয়।
ঢাকায় সরবরাহ ও পাইকারি দামগত শুক্র ও শনিবার রাতে কারওয়ান বাজারে ঘুরে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাকে করে ফুলকপি ও বাঁধাকপি আসছে।
কারওয়ানবাজারের আড়তদার আবদুল কাদির ভূইয়া প্রতিবছর শীত মৌসুমে ফুলকপির ব্যবসা করেন। তিনি জানান, বর্তমানে ব্যাপারীর কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ টাকা দরে প্রতি পিছ ফুলকপি কিনছেন তাঁরা। এরপর সেগুলো ২৫ থেকে ৩৫ টাকা দরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন। এই ফুলকপি আরও এক-দুই হাত ঘুরে খুচরায় ৪০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাঁধাকপির দামও অনেকটা এমন।
অবশ্য অনেক কৃষক সরাসরি ঢাকায় ফুলকপি ও বাঁধাকপি নিয়ে আসছেন। যেমন, যশোর সদরের নোঙ্গরপুর গ্রামের কৃষক আবদুস সাত্তার এ বছর সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে বাঁধাকপি চাষ করেছেন। ইতিমধ্যে দেড় বিঘা জমির আগাম বাঁধাকপি কেটে বিক্রি করেছেন। ব্যাপারীদের মাধ্যমে বিক্রি করলে দাম পাওয়া যায় কম। সে কারণে গত মঙ্গলবার নিজেই ট্রাক ভাড়া করে বাঁধাকপি কারওয়ান বাজারে নিয়ে আসেন।
আবদুস সাত্তার বলেন, কারওয়ান বাজারে প্রতি পিছ বাঁধাকপি ৩৩ টাকা করে বিক্রি করেছি। এর সঙ্গে ট্রাক ভাড়া, শ্রমিক মজুরি যোগ হবে। তবে ব্যাপারীদের মাধ্যমে বিক্রি করলে দাম পাওয়া যেত মাত্র ১৫ থেকে ২০ টাকা। সব মিলিয়ে আগাম বাঁধাকপি বিক্রি করে এখন ভালো দাম পাচ্ছেন তিনি। তাঁর আশা, ভরা মৌসুমেও মোটামুটি ভালো দাম থাকলে এ বছর মুনাফা করতে পারবেন; না হয় চাষের খরচ উঠে আয়-ব্যয় সমান সমান থাকবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরবর হ ব হ জ র টন স ধ রণত ক রওয় ন চ ষ হয় এ বছর ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে
দেশে সব সময় ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে চাঁদাবাজি নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়ে থাকে ব্যবসায়ী মহলে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা তৈরি হলেও সে আশার গুড়ে বালিই ঘটেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা না আসায় ব্যবসা-বাণিজ্য একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্য বিষফোড়া হিসেবে চাঁদাবাজি ব্যবসায়ীদের চরমভাবে ভুক্তভোগী করছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারকে কঠোর হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মতবিনিময় সভায় চাঁদাবাজি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সভায় ব্যবসায়ী নেতারা যে সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন, তার সারসংক্ষেপ হলো বাজারের অস্থিরতার মূল কারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নয়, বরং কিছু করপোরেট গ্রুপের সিন্ডিকেট এবং পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে খালাস পর্যন্ত চলমান ভয়াবহ চাঁদাবাজি।
মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলার বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘বাজার তদারকিতে যতক্ষণ পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর থেকে দৃষ্টি না সরাবেন, ততক্ষণ সমস্যার সমাধান হবে না। কারওয়ান বাজারের চুনোপুঁটি ব্যবসায়ীর কাছে না গিয়ে রাঘববোয়ালের কাছে যান।’ চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো অপরিহার্য পণ্য সরবরাহের জন্য মুষ্টিমেয় সাতটি গ্রুপের ওপর গোটা দেশের নির্ভরতা এই সিন্ডিকেট-নির্ভরতার বিপদকে প্রকট করে তোলে।
পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিনের অভিযোগ আরও গুরুতর। তিনি সরাসরি করপোরেট ব্যবসায়ীদের ‘শকুনের মতো শোষণকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং ৩ টাকার মোড়ক দিয়ে ৪০ টাকা দাম বাড়ানোর মতো কারসাজির কথা তুলে ধরেছেন। সংকটের সময় মিলগুলো নিয়মিত পাইকারদের তেল না দিয়ে বিশেষ শ্রেণির পরিবেশকদের সুবিধা দেওয়ায় বাজার আরও অস্থির হয় বলে অভিযোগ। এসব করপোরেট কারসাজির ওপর সরকারের কার্যকর নজরদারি না থাকলে রমজানের সময় মূল্য সহনীয় রাখা অসম্ভব।
ব্যবসায়ী নেতারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, নিত্যপণ্য পরিবহন ও সরবরাহের পথে গুরুতরভাবে চাঁদাবাজি চলছে। পণ্য ট্রাকে ওঠানো-নামানো—সর্বত্রই চাঁদা দিতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গেও চাঁদাবাজদের ‘দহরম-মহরম’ থাকার অভিযোগ তো নতুন নয়। চাঁদাবাজমুক্ত পরিবেশ তৈরি না হলে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে না এবং বাজার স্থিতিশীল হবে না—এই কঠোর সত্যটি সরকারকে অনুধাবন করতে হবে। এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক কেবল ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ অন্যান্য সংস্থাকে অনুরোধ করা হবে’ বলে দায় সারলে এই সমস্যার সমাধান হবে না, দরকার কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
পেঁয়াজ বা খেজুরের মতো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরকারের ভুল শুল্কনীতি এবং আমদানির সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা বড় ভূমিকা রাখে। পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি এসেও সামান্য ১০ শতাংশ ঘাটতির জন্য দামের ‘সেঞ্চুরি’ হওয়ার পর সরকারের আমদানির প্রয়োজন বোধ করা সময়োচিত নয়। অন্যদিকে খেজুরের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে এটিকে বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। ফল আমদানিকারকেরা অবিলম্বে শুল্ক যৌক্তিক করার দাবি জানিয়েছেন। রমজানে চাহিদা মেটাতে সরকার যদি নিজেই নির্দিষ্ট পরিমাণ চিনি ও ভোজ্যতেল আমদানি করে মজুত রাখে, তবে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ কমবে এবং সংস্থার হয়রানিও বন্ধ হবে—এমন প্রস্তাব সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
গত বছরের রমজানে সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক সিদ্ধান্তের ফলে বাজারের পরিস্থিতি ছিল তুলনামূলক সন্তোষজনক। আমরা আশা করব, সরকার আসন্ন রমজানের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আগাম প্রস্তুতি নেবে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী হবে, সেটিই কাম্য।