প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহার দাবি ব্যবসায়ীদের
Published: 16th, January 2025 GMT
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবকে ভোক্তার স্বার্থবিরোধী উল্লেখ করে অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতের ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের মতে, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের উপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপানো হলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের শ্রমজীবী, প্রান্তিক কৃষক ও নিম্ন আয়ের মানুষ। যে হারে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য বিস্কুট, কেক, জুসসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। আর ভোক্তারা ক্রয়ক্ষমতা হারালে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সদস্যরা এসব উদ্বেগের কথা জানান।
তারা বলেন, ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে এরই মধ্যে এ খাতে সরাসরি কাজ করা প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিকের কাজ হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে পুরো খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। পরিচালন ব্যয় বেড়ে গেলে রপ্তানিতে বাজার হারানোর শঙ্কা তৈরি রয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর যে উদ্দেশ্যে সেটি হিতে বিপরীত হতে পারে বলে মনে করছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
পাশাপাশি সরকারকে আগামী সাত দিনের মধ্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন তারা। যদি এ সময়ের মধ্যে আরোপিত ভ্যাট ও শুল্কের সাথে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব থেকে সরকার সরে না আসে তবে স্বেচ্ছায় কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ এবং সচিবালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটির।
এছাড়া এ ইস্যুতে সরাসরি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চেয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
বাপার নেতৃবৃন্দ মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টাকে সরাসরি এর প্রভাবগুলো তুলে ধরতে পারলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সহযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। সেখানে মেশিনে প্রস্তুতকৃত বিস্কুট, কেক, আচার, চাটনি, টমেটো পেস্ট, টমেটো কেচাপ, টমেটো সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প ইত্যাদি পণ্যসমূহের উপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া ফলের রস ও ফ্রুট ড্রিংকস এর উপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল/ ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস (নন-কার্বোনেটেড) পণ্যের উপর সম্পূরক শুল্ক শূন্য শতাংশ ছিল এবং বর্তমানে তা ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি ব্যবসায়ী পর্যায়ে পূর্বে ৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপ ছিল যা বাড়িয়ে ৭.
সংবাদ সম্মেলনে বাপার সভাপতি এম এ হাশেম বলেন, আমরা এমন একটি খাত নিয়ে ব্যবসা করি যার সাথে সরাসরি শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে প্রান্তিক কৃষক জড়িত। সরকার থেকে বলা হচ্ছে, এতে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। দেশের মানুষের সংস্কৃতি যদি দেখি, চায়ের দোকান থেকে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ সকালে এক কাপ চা, একটি বিস্কুট কিংবা কেক খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এখন যদি বিস্কুট ও কেকের উপর ভ্যাট বাড়ানোর সাথে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পায় তবে ৫ টাকার একটি বিস্কুট আর তৈরি করা সম্ভব হবে না। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষটি সহজে ক্ষুধা নিবারণের পথটি হারাবেন।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী আহসান খান চৌধুরী বলেন, আমরা প্রান্তিক কৃষকের আম, টমেটো, আনারস, কলাসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাত করে জুস, ড্রিংকস, আচার, সস তৈরি করি। টমেটো, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প ইত্যাদি পণ্যসমূহের উপর মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক চাষিরা। এখন যদি ভ্যাট ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যায় তবে অনেকেই এসব পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকবেন। এছাড়া এর প্রভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে প্রচুর শ্রমিকের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে আসবে। তাই সরকারকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক প্রত্যাহার এবং গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহবান জানাচ্ছি।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণের উচ্চ সুদ হার, ঋণপত্রে জটিলতা, ডলার বাজারে অস্থিরতা, ২০২৪ এর সাধারণ নির্বাচন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান এবং সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি নিয়ে যখন ব্যবসায়ীদের কঠিন অবস্থা সামাল দিতে হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ভ্যাট বৃদ্ধির উদ্যোগে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও আতঙ্কিত।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ এ খাতে নিযুক্ত। কৃষি-খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অবদান জিডিপিতে এখন ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে বাপার প্রায় ৪০০ সক্রিয় সদস্য রয়েছেন। এর বাইরেও প্রায় পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাদপণ্য উৎপাদন করছেন যেখানে ৫ লাখের অধিক শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। পাশাপাশি কাঁচামাল সরবরাহকারী, খুচরা বিক্রেতাসহ পরোক্ষভাবে প্রচুর লোক এ খাতে যুক্ত রয়েছেন। বর্তমান কঠিন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ এ ধরনের উদ্যোগে সবাই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বক্তারা বলেন, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য-পণ্য দেশের শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি খাতের একটি। আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের সুপার-শপেও এখন ‘বাংলাদেশে তৈরি’ প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের সরবরাহ প্রচুর বেড়েছে। এসব বাজারে জুস, ড্রিংকস, বিস্কুট, সস, জেলিসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বিশাল বাজার তৈরি হচ্ছে। এ খাতে রপ্তানি এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ যদি বর্ধিত ভ্যাট আরোপ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি করা হয় তবে রপ্তানি খাত মুখ থুবড়ে পড়বে। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের কাছে বাজার হারাতে হবে। এছাড়া দেশীয় পণ্যের দামের সাথে আমদানিকৃত খাদ্যপণ্যের দামের ব্যবধান কমে আসলে স্থানীয় শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই দ্রুত বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহার ও প্রস্তাবিত গ্যাসের দাম না বাড়ানোর জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
সংবাদ সম্মেলনে এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ইকতাদুল হক, এসিআই এগ্রো বিজনেসের প্রেসিডেন্ট ড. এফ এইচ আনসারি, এসএমসি এন্টারপ্রাইজ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ নাসির, বাংলাদেশ বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভুঁইয়া, আকিজ ফুডস এন্ড বেভারেজ এর পরিচালক সৈয়দ জহুরুল আলম, স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ এর চিফ অপারেটিং অফিসার পারভেজ সাইফুল ইসলাম, কিশোয়ান ও বনফুল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল ইসলামসহ কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাতের বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন ম ন আয় র ম ন ষ ব যবস য় র র ব যবস সরক র র উপর
এছাড়াও পড়ুন:
সন্দ্বীপ চ্যানেলে মাঝপথে জ্বালানি শেষ স্পিডবোটের, ২৭ যাত্রী নিয়ে ভেসে ছিল আড়াই ঘণ্টা
সন্দ্বীপ চ্যানেলে দুর্ঘটনায় পড়া একটি স্পিডবোট আড়াই ঘণ্টা সাগরে ভেসে থাকার পর কূলে পৌঁছেছে। বোটটিতে ৩ শিশু, ২ নারীসহ মোট ২৭ জন যাত্রী ছিলেন।
আজ সোমবার দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসা বোটটি বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার ছোট কুমিরা উপকূলে পৌঁছায়। বোট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানটি হলো সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিস।
বোটের কয়েকজন যাত্রী প্রথম আলোকে জানান, কুমিরা ঘাটের কাছাকাছি আসতেই বোটটির গতি কমে যায়। এরপর প্রবল ঢেউ ও স্রোতের মুখে বারবার পানিতে আছড়ে পড়তে থাকে। চালক তখন যাত্রীদের জানান, বোটের জ্বালানি শেষ হয়ে গেছে। এর মধ্যে বোটের সামনের অংশে পানি ঢুকতে দেখা যায়। আতঙ্কিত যাত্রীরা তখন চিৎকার করতে থাকেন। পরে বোটটি ভাসতে ভাসতে কূলে পৌঁছায়।
বোটে থাকা যাত্রী ফুয়াদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোটের তলা ফেটে পানি ঢুকছে আর আমরা এক কিলোমিটার দূরে উত্তাল সাগরে ভাসছি। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল বেঁচে ফিরতে পারব না, এমনকি সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার কথাও ভাবছিলাম। কিন্তু ভাগ্য ভালো, শেষ পর্যন্ত কূলে পৌঁছাতে পেরেছি।’
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সবাই নিরাপদে কূলে নামতে সক্ষম হন বলে জানান ফুয়াদ।
বিকেলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্পিডবোট ডুবে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রাণহানির আশঙ্কায় অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বিষয়টির কারণ জানতে বিভিন্ন মন্তব্য করেন।
জানতে চাইলে বোট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান সন্দ্বীপ মেরিন সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘বোটের জ্বালানি শেষ হয়নি। তীব্র স্রোতের কারণে বোটটি কুমিরা ঘাট থেকে উত্তরে সরে গিয়ে তীরের কংক্রিট ব্লকে ধাক্কা খায়। এতে বোটের নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু যাত্রীরা সবাই নিরাপদে কূলে পৌঁছাতে সক্ষম হন।’
বৈরী আবহাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বোট চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের সার্ভিস বন্ধ ছিল। তবে বিদেশগামী কয়েকজন যাত্রীর অনুরোধে এই একটি ট্রিপ চালু করতে হয়েছে।’
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে এই সময়ে বোট চলাচলের অনুমতি ছিল না। তিনি বলেন, মাঝ সাগরে জ্বালানি শেষ হওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তার দায় চালক ও মালিকের। ইতিমধ্যে স্বত্বাধিকারীদের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে। চালকের লাইসেন্স স্থগিত করে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।