ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন, নিউইয়র্ক টাইমসের পররাষ্ট্রবিষয়ক কলাম লেখক ও প্রাচ্যবিদ টমাস ফ্রিডম্যান কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, আপনি সাহসী হলে মধ্যপ্রাচ্য পুনর্নির্মাণ করতে পারেন।’ ট্রাম্প যেন এখন ফ্রিডম্যানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন এবং একে সম্পূর্ণ নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন। মঙ্গলবার তিনি ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকার ‘অধিগ্রহণ’ ও ‘মালিকানা’ নেবে, যেখানে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে দাপ্তরিক হিসাব অনুযায়ী ইসরায়েল প্রায় ৬২ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, যদিও বাস্তবে তা আরও বেশি। গাজার বেশির ভাগই ধ্বংসস্তূপে পরিণত।

যাই হোক, বিশ্ব মানচিত্রে গাজার অবস্থান সম্পর্কে ট্রাম্পের ধারণা অস্পষ্ট বলে মনে হচ্ছে। যেমন হাস্যকরভাবে তাঁর এই বিভ্রান্তিকর দাবিটি তা-ই প্রমাণ করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন গাজায় গণহত্যার প্রধান হোতা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তাঁর সঙ্গে বৈঠকের পর হোয়াইট হাউসে বক্তৃতাকালে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকা দখল করবে এবং আমরা এ ব্যাপারে একটা কাজ হাতে নেব। আমরা এটির মালিক হবো।’

ট্রাম্পের মতে, বিধ্বস্ত উপকূলীয় ছিটমহলের ওপর এই ‘দীর্ঘমেয়াদি মালিকানা’ মূলত ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার বেশির ভাগ বাসিন্দাকে ‘মানবতাবাদী ডাকে সাড়া দেওয়ার সঙ্গে আগ্রহী অন্যান্য দেশে’ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করতে বাধ্য করবে, যাতে গাজা ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’য় রূপান্তরিত হতে পারে। ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধভাবে একটি অঞ্চল দখল করার আশঙ্কা নিয়ে কারও প্রশ্নের ব্যাপারে আশ্বস্ত করে ট্রাম্প শ্রোতাদের বলেন, ‘আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, প্রত্যেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই জমির মালিকানা, উন্নয়ন ও সেখানে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টির ধারণা পছন্দ করছেন। এটি হবে দুর্দান্ত।’ যাই হোক, জাতিগত নিধন মহৎ ছিল না, কে বলেছিলেন? আর যদি এমন লোকেরা থাকেন, যারা অন্য কিছু ভাবেন, তাহলে ভালো। ট্রাম্প পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মার্কিন সেনা মোতায়েনের আশঙ্কা বাতিল করেননি। ‘যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি গাজাসংশ্লিষ্ট, আমরা যা প্রয়োজন তা করব। প্রয়োজনে আমরা তা করব।’

অবশ্যই একজন বিলিয়নেয়ার, সাবেক রিয়েল এস্টেট টাইকুন, নিউইয়র্ক সিটির আইকনিক ট্রাম্প টাওয়ারের অধিপতির লাভজনক ব্যবসায় সুযোগ চিহ্নিত করার ব্যাপারটি বিশেষত চমকপ্রদ কিছু নয়, যা মনোরম ভূমধ্যসাগরীয় সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। অঞ্চলটি ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেনের কাছ থেকে নিবেদিতচিত্তে সহায়তা পেয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সুবিধাজনকভাবে সমতল করেছে। সম্ভবত গাজা শহর এক দিন তাঁর নিজস্ব ট্রাম্প টাওয়ারকে অনুসরণ করতে পারে? এরই মধ্যে গাজার প্রতি ট্রাম্পের অত্যাচারী দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর বর্বর অহংবোধের সঙ্গে যুক্ত, যা তিনি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও বিস্তৃত করেছেন। 

স্পষ্টতই এখানে এটি বলা হচ্ছে না, বাইডেন ও তাঁর সহকর্মী ডেমোক্র্যাটরা তাদের নিজেদের দানবীয় নীতি অনুসরণ করেননি। কিন্তু গাজায় ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ভূমি দখল প্রাচ্যবাদী মনোবিকারের এক ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পুনরায় আঁকার তৎপরতা। অন্তত জেনোসাইড কনভেনশনের গণহত্যার সংজ্ঞা অনুসারে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভেরা’য় জায়গা করে নিতে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতকে কেবল গণহত্যামূলক আচরণের ধারাবাহিকতা বলে মনে হয়। 

২০২৩ সালের অক্টোবরে সর্বাত্মক গণহত্যা শুরু হওয়ার আগেও যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ইসরায়েলের নিয়মিত গণহত্যা, সন্ত্রাসবাদ ও সাধারণ নিপীড়নের সুবিধার্থে কয়েক দশক ধরে ব্যয় করেছে। এখন ট্রাম্প ইসরায়েলে কিছু ভারী বোমা সরবরাহের ব্যাপারে বাইডেনের অতিমাত্রায় স্থগিতাদেশ উল্টে দিয়েছেন, যা ‘নরক’ উপশম করার ক্ষেত্রে খুব বেশি কাজে দেবে না।

ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, তিনি গাজাকে ‘শুধু পরিষ্কার’ করতে চান। এটি এমন এক মিশন, যার মনোমুগ্ধকর ফ্যাসিবাদী বলয় নেতানিয়াহু ও তাঁর লোকদের কানে সংগীত শোনায়। আর ট্রাম্প যেভাবে বিশ্ব মানচিত্রকে এক ধাক্কায় পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন, এতে তাঁর স্ব-সংজ্ঞায়িত ‘খুব স্থিতিশীল প্রতিভা’ থেকে এর চেয়ে কম কিছু আশা করা উচিত ছিল না। 

বেলেন ফার্নান্দেজ: কলাম লেখক; আলজাজিরা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণহত য কর ছ ন ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল

ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।

শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’

এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’

এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।

অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।

ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি

ইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।

উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।

গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:

‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’

এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।

বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।

গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্য

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।

আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।

ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তি

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।

টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।

জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।

ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।

*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ভালো উদ্যোগ নিলেও বিরোধিতা আসে
  • যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
  • তেহরানে ইসরায়েলের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল