জার্মানিতে ডানপন্থীদের জয় পশ্চিমকে কী বার্তা দিচ্ছে
Published: 26th, February 2025 GMT
জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম পুরোনো রাজনৈতিক দল। দলটি দীর্ঘদিন ধরে সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, নাৎসিবাদের বিরোধিতা করেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানির আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে বর্তমানে এসপিডির সেই শক্তিশালী অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক নির্বাচনে দলটি মাত্র ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে, যা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ/সিএসইউ) ও চরম ডানপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) চেয়ে অনেক কম।
এসপিডির এই ভরাডুবির পেছনে কী কারণ রয়েছে এবং এটি পশ্চিমা বামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যতের জন্য কী বার্তা বহন করে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার।
আসলে এসপিডির জনপ্রিয়তা ২০০০ সালের পর থেকে নাটকীয়ভাবে কমতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে প্রায় ৪১ শতাংশ ভোট পেলেও ২০০৫ সালের নির্বাচনে তা কমে ৩৪ দশমিক ২ শতাংশে নেমে আসে। এরপর ২০০৯ সালের নির্বাচনে আরও বড় ধাক্কা খেয়ে তারা মাত্র ২৩ শতাংশ ভোট পায়।
জনপ্রিয়তার এই ব্যাপক পতনের মূল কারণ ছিল দলের তৎকালীন নেতা ও জার্মান চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডারের ‘এজেন্ডা টু থাউজেন্ড টেন’ ও হার্জ সংস্কার, যা শ্রমবাজারকে আরও মুক্ত করে দিয়েছিল এবং জনকল্যাণমূলক সুবিধা সংকুচিত করেছিল। এতে শ্রমজীবী মানুষ (যারা ঐতিহ্যগতভাবে দলটির মূলভিত্তি ছিল) দলটির ওপর আস্থা হারায়। জনপ্রিয়তা হারালেও এসপিডি ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়েছিল। কারণ, তারা আঙ্গেলা ম্যার্কেলের নেতৃত্বাধীন ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (সিডিইউ/সিএসইউ) সঙ্গে জোট গঠন করে সরকারে ছিল। ম্যার্কেল দীর্ঘ ১৬ বছর জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এই সময়ে এসপিডি ছোট জোটসঙ্গী হিসেবে টিকে থাকতে পারলেও নিজেদের স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারেনি।
২০২১ সালের নির্বাচনে ম্যার্কেল রাজনীতি থেকে অবসর নিলে এসপিডি এক-চতুর্থাংশ ভোট পেয়ে জিতে যায় এবং দলীয় নেতা ওলাফ শলৎজ চ্যান্সেলর হন। তবে সরকার গঠনের জন্য সে সময় তাঁকে গ্রিন পার্টি ও মুক্তবাজারপন্থী ফ্রি ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে জোট বাঁধতে হয়। এই জোট সরকারের নীতি ছিল পরস্পরবিরোধী।
সাম্প্রতিক নির্বাচনের আগে জনগণের প্রধান উদ্বেগ কী, তা এসপিডি ঠিকমতো ধরতে পারেনি। জরিপ বলছে, ৩৭ শতাংশ ভোটারের কাছে অভিবাসন প্রধান সমস্যা ছিল। কিন্তু দলটি এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেনি।
২০১৫ সালে দলটি আঙ্গেলা ম্যার্কেলের উন্মুক্ত অভিবাসননীতিকে সমর্থন করেছিল। এর ফলে ১০ লাখের বেশি শরণার্থী জার্মানিতে প্রবেশ করেছিল। পরে যখন নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ ইস্যু সামনে আসে, তখন শলৎজ কিছু কঠোর নীতি নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এবং গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সিরিয়া ও আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এতে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এবং অভিবাসনবিরোধী এএফডি তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করে।
অর্থনীতিও ছিল আরেকটি বড় ইস্যু, যা ৩৪ শতাংশ ভোটারের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়েছে। ২০২৪ সালে জার্মানির অর্থনীতি টানা দ্বিতীয় বছরের মতো সংকুচিত হয়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে এবং শিল্প খাতে কর্মসংস্থান কমেছে। ভোক্তাদের আস্থা তলানিতে পৌঁছেছে। এটি বর্তমান সরকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
২০২৪ সালের নির্বাচনের ভোট বিশ্লেষণে দেখা যায়, শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে এসপিডির সমর্থন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অনেক শ্রমিক উগ্র রক্ষণশীল এএফডির দিকে ঝুঁকেছে। কারণ, এএফডি অভিবাসন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিয়ে আরও স্পষ্ট ও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও শলৎজের সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
এই নির্বাচনী পরাজয় অনেকাংশে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টির ২০২৪ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের সঙ্গে তুলনীয়। দুই দলই শ্রমিক শ্রেণির আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, অভিবাসন ইস্যুতে সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেনি এবং বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে পারেনি। পরিবর্তে তারা মূলত সংস্কৃতিগত উদারনৈতিক নীতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, যা সমাজের ধনী ও সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির কাছে জনপ্রিয় হলেও সাধারণ মানুষের উদ্বেগের জায়গা থেকে অনেক দূরে ছিল।
অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ার ভয়ই চরম ডানপন্থী শক্তিগুলোর প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়েছেন, জার্মানিতেও এএফডি এই কৌশল নিয়েছে। বামপন্থী দলগুলো যদি শ্রমজীবী জনগণের সমস্যাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে না নেয়, তাহলে চরম ডানপন্থীদের উত্থান আরও শক্তিশালী হবে।
যদি সামাজিক গণতান্ত্রিক দলগুলো আবারও প্রাসঙ্গিক হতে চায়, তাহলে তাদের শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করতে হবে এবং শিল্পায়ন, স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির প্রসার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে শ্রমবাজারে যে পরিবর্তন আসছে, তার মোকাবিলা করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে তারা আরও বড় সংকটে পড়বে।
বার্তোজ এম রিডলিনস্কি ওয়ারশর কার্ডিনাল স্টেফান উইসজিনস্কি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ড নপন থ এসপ ড র অবস থ ন জনপ র য় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ