সরকার এখনও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি: তারেক রহমান
Published: 27th, February 2025 GMT
জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল সংলগ্ন মাঠে বিএনপির বর্ধিত সভা শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় এই বর্ধিত সভা শুরু হয়। এতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সরকার যেখানে দেশের বাজার পরিস্থিতি কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে কাঙ্খিত সফলতা অর্জন করতে পারছে না সেখানে জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘স্থানীয় নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের নামে কেন দেশের পরিস্থিতি আরেও ঘোলাটে করতে চাইছে এটি জনগনের কাছে বোধগম্য নয়।
তারেক রহমান বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির বর্ধিত সভা দীর্ঘ ৭ বছর পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর আগে বিএনপির সর্বশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মাদার অফ ডেমোক্রেসি বেগম খালেদা জিয়া। ফ্যাসিবাদী শাসনকালে এরপর আর বিএনপির বর্ধিত সভা কিংবা কাউন্সিল অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি।
‘চিকিৎসাধীন থাকায় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। তবে তিনি এই সভার সাফল্য কামনা করেছেন। তিনি আপনাদের কাছে দোয়া চেয়েছেন। দেশনেত্রীর শারীরিক সুস্থতার জন্য আমরা আল্লাহর দরবারে দোয়া কামনা করছি। মাদার অব ডেমোক্রেসি বেগম খালেদা জিয়ার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব আর সুদক্ষ নেতৃত্ব বিএনপিকে পৌঁছে দিয়েছিলো সারাদেশের প্রতিটি গ্রামে প্রতিটি ঘরে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, আজকের এই বর্ধিত সভার শুরুতেই আমি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে স্মরণ করতে চাই। তিনি একদলীয় অভিশপ্ত বাকশালের অন্ধকারাচ্ছন্ন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আলো জ্বালিয়েছিলেন। জনগণের ভালোবাসায় ধন্য বিএনপির হাতে গণতন্ত্রের ঝান্ডা তুলে দিয়েছিলেন।
বিএনপির জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং স্বৈরাচার বিরোধী ধারাবাহিক আন্দোলনে, যারা শহীদ হয়েছেন আহত হয়েছেন
সন্তান স্বজন হারিয়ে যেসব পরিবার নিদারুন দুঃখ কষ্টের মুখোমুখি হয়েছেন, যাদের শ্রম ঘাম মেধায় বিএনপি আজ আপামর জনগণের কাছে দেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, আজকের বর্ধিত সভার শুরুতে আমি তাদের প্রত্যেকের অবদানকেও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই।
তিনি বলেন, সর্বোপরি ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদ দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ধারাবাহিক সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন, ২০২৪ সালে জুলাই-আগস্টে তাবেদার অপশক্তির বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধের সাহসী বীর আবু সাইয়ীদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম রিয়া গোপ, আব্দুল আহাদ এবং বিএনপির পাঁচ শতাধিকসহ হাজারও শহীদ এবং আহত যোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
‘হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতাপ্রিয় বীর জনতার রক্তক্ষয়ী গণ অভুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর দেশে গণতন্ত্রকামী মানুষের সামনে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের এক অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। এই সুযোগ এবং সম্ভাবনা নস্যাৎ করার জন্য এরইমধ্যে নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। সুকৌশলে রক্তপিচ্ছিল রাজপথে গড়ে ওঠা 'জাতীয় ঐক্য' এবং জাতীয় নির্বাচনে'র পরিবেশ বিনষ্টের অপচেষ্টা চলছে।’
তারেক রহমান বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের পর দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খার প্রতিফলন ১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠা এসবই ছিল, রাষ্ট্র রাজনীতির ময়দানে যুগান্তকারী সংস্কার। এছাড়াও বিভিন্ন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালে বিএনপি সরকার স্কুল কলেজে বিনা বেতনে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি, রাষ্ট্র ও সমাজে মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, বিশ্বের তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে প্রস্তুত রাখতে বিজ্ঞান এবং তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এগুলোও ছিল রাষ্ট্র ও সরকারে কয়েকটি গুরুত্বপুর্ণ সংস্কার।এ ধরণের আর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
তিনি বলেন, তবে ষড়যন্ত্রের পথ ধরে পলাতক স্বৈরাচার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর সংস্কারের সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। বাংলাদেশকে চিরতরে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করে রাখতে গত দেড় দশকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নাজুক করে তুলেছিল।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, টাকাপাচার আর লুটপাট চালিয়ে দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর করে দিয়েছিল। অকার্যকর করে দেয়া হয়েছিল দেশের সকল সাংবিধানিক এবং বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন করে দিয়ে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তুলেছিল।
তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র সরকার এবং রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের লক্ষ্যে মাদার অফ ডেমোক্রেসি বেগম খালেদা জিয়া ২০১৭ সালে ভিশন ২০৩০ দিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে বিএনপি ২৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। পরবর্তীতে গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের পর ঘোষণা করা হয় ৩১ দফা কর্মসূচি। এই ৩১ দফা নিয়ে বর্তমানে বিএনপির উদ্যোগে সারাদেশে জনগণের সঙ্গে সংলাপ চলছে।
রাতেক রহমান বলেন, রাষ্ট্র -সরকার-রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল মেরামতের জন্য দফা ৩১টি হলেও এর চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি। সেটি হলো 'একটি নিরাপদ গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ। ঠিক তেমনি উদ্দেশ্যও একটি। সেটি হলো 'রাষ্ট্র ও সমাজে জনগণের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা'। এটি নিশ্চিত করা না গেলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব-গণতন্ত্র-নিরাপত্তা-সমৃদ্ধি কোনটিই টেকসই হবে না।
রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার জন্য জনগণের রাজনৈতিক
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, রাষ্ট্র এবং সমাজে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার পূর্ব শর্ত হলো প্রতিটি নাগরিকের ভোট প্রয়োগের অধিকার বাস্তবায়ন। এবং এ লক্ষ্যেই একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বারবার জনগণের ভোটে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানায়।
তিনি বলেন, একজন রাজনৈতিক কর্মী আমি বিশ্বাস করি আজ এবং আগামী দিনের রাজনীতিতে বিএনপির এই ৩১ দফা হচ্ছে, একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সনদ। তবে এই ৩১ দফাই শেষ কথা নয় সময়ের প্রয়োজনে রাষ্ট্র সরকার- রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের সংস্কারের জন্য এই ৩১ দফাতেও সংযোজন-বিযোজনের সুযোগ রয়েছে। এমনকি বিএনপির ৩১ দফার সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার প্রস্তাবনার খুব বেশি ইস্যুতে মৌলিক বিরোধ নেই।
তারেক রহমান বলেন, বিভিন্ন সময়ে ‘জাতীয় নির্বাচন’ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য জনমনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করলেও ‘জাতীয় নির্বাচন’ নিয়ে কোনো কোনো উপদেষ্টার বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য মন্তব্য স্বাধীনতাপ্রিয় গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য হতাশার কারণ হয়ে উঠছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের নিঃশর্ত সমর্থন থাকলেও সরকার এখনো তাদের কর্মপরিকল্পনায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে পারছেনা।
তিনি বলেন, সারাদেশে খুন হত্যা ধর্ষণ চুরি ছিনতাই রাহাজানি বেড়েই চলেছে। বাজার সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, সরকার যেখানে দেশের বাজার পরিস্থিতি কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে কাঙ্খিত সফলতা অর্জন করতে পারছে না সেখানে জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘স্থানীয় নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের নামে কেন দেশের পরিস্থিতি আরেও ঘোলাটে করতে চাইছে এটি জনগনের কাছে বোধগম্য নয়।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রকামী জনগণ মনে করে, স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেটি হবে সারাদেশে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসনের একটি প্রক্রিয়া যা সরাসরি গণ অভ্যুত্থানের আকাঙ্খা বিরোধী। গণ হত্যাকারী টাকাপাচারকারী দুর্নীতিবাজ মাফিয়া চক্রকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার এই ফাঁদে বিএনপি পা দেবেনা।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বিএনপি জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জন রায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে গণহত্যাকারী-মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান, সারাদেশে গণ হত্যাকারীদের দোসর মাফিয়া চক্রকে পুনর্বাসনের ‘স্থানীয় নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাথেকে সরে আসুন। অবিলম্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগামী দিনের সুনির্দিষ্ট ‘কর্ম পরিকল্পনার রোডম্যাপ’ ঘোষণা করুন।
তিনি বলেন, মাফিয়া প্রধান হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর এ পর্যন্ত ১৬/১৭টি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিএনপি সকল নতুন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে স্বাগত জানায়। তবে নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রহণ কিংবা বর্জনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে জনগণ। সুতরাং, প্রতিটি দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু 'জাতীয় নির্বাচন' অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সবার আগে নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুত রাখতে হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, দেশে একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষতাই হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় পুঁজি। কিন্তু সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে ইতোমধ্যেই জনমনে সন্দেহ সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে আমি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আরেও সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানাই।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ত র ক রহম ন ব এনপ ত র ক রহম ন গণতন ত র র ব গম খ ল দ র র জন ত ক ন শ চ ত কর র পর স থ ত অন ষ ঠ ন র জনগণ র ত র জন ন র জন র জন য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লুলার প্রতিবাদে অন্যরাও শামিল হোক
বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বিশ্বের কাছে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রধান রক্ষক ও মডেল হিসেবে তুলে ধরেছে। তবে বাস্তবে এই মূল্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রে দেশটি সব সময় সফল হয়নি। বিশেষ করে স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের নানা প্রান্তে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলোকে সরিয়ে দিয়েছে। গ্রিস, ইরান, চিলি ইত্যাদি দেশে তারা সামরিক শাসকদের সমর্থন দিয়েছে, যাতে সেসব দেশে সমাজতন্ত্র বিস্তার লাভ করতে না পারে। আবার নিজেদের দেশেও যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে আফ্রিকান-আমেরিকানদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আর এখন সুপ্রিম কোর্ট এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যা জাতিগত বৈষম্য দূর করার প্রচেষ্টাকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
সত্যি বলতে কি, যুক্তরাষ্ট্র অতীতে যে আদর্শ প্রচার করেছে, তা সে সব সময় নিজেই মানেনি। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই আদর্শিক বিচ্যুতি স্পষ্ট ও প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। তিনি কেবল ওই মূল্যবোধগুলোকে উপেক্ষা করেননি; বরং সেগুলোর বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প আইনের শাসনের প্রতি কোনো সম্মান দেখাননি। তাঁর শাসনামলের সবচেয়ে ভয়ানক দৃষ্টান্ত হলো, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবনে (ক্যাপিটল) তাঁর সমর্থকদের হামলা। ওই হামলার উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের ফল বদলে দেওয়া এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি জিতেছেন, যদিও প্রকৃত ফলাফলে জো বাইডেন প্রায় ৭০ লাখ ভোট বেশি পেয়ে জয়ী হন। ৬০টির বেশি আদালত এ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও বৈধতা নিশ্চিত করেছেন।
ট্রাম্পকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা হয়তো তাঁর এমন আচরণে অবাক হননি। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হলো, এখনো ৭০ শতাংশ রিপাবলিকান সমর্থক বিশ্বাস করেন, নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছিল। অনেক মার্কিন আজ মিথ্যা তথ্য, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ও বিকৃত বাস্তবতার জগতে বাস করছেন, যেখানে গণতন্ত্র বা আইনের শাসনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তথাকথিত ‘মার্কিন জীবনধারা’ রক্ষা করা। এই ‘জীবনধারা’ আসলে একধরনের শ্রেষ্ঠত্ববাদ। বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ, পুরুষ, খ্রিষ্টানদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখাকেই তাঁরা ‘মার্কিন জীবনধারা’ বলে মনে করছেন।
এই বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র এখন এমন এক দেশে পরিণত হয়েছে, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে এবং একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা মাথাচাড়া দিচ্ছে। বিশ্বে অনেক স্বৈরশাসক এই পরিস্থিতি দেখে উৎসাহিত হচ্ছেন। যেমন ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো যুক্তরাষ্ট্রের ৬ জানুয়ারির ঘটনার অনুকরণে ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ায় একই ধরনের এক হামলা ঘটাতে চেয়েছিলেন, যাতে নির্বাচনের ফল বদলানো যায়। তবে সৌভাগ্যক্রমে ব্রাজিলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শেষ পর্যন্ত টিকে গেছে এবং এখন বলসোনারোর বিচার চলছে।
ব্রাজিলের এই বিচারিক পদক্ষেপের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিচার ঠেকাতে তাঁর দল নানা চেষ্টা করছে। ট্রাম্প আবারও প্রেসিডেন্ট হতে চান এবং তিনি প্রকাশ্যে বলছেন, তিনি আইনের শাসনের চেয়ে নিজের ইচ্ছাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন। তিনি বাণিজ্য চুক্তি ভেঙেছেন এবং বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখন তিনি হুমকি দিচ্ছেন, ব্রাজিল যদি বলসোনারোর বিচার না থামায়, তাহলে ব্রাজিলের রপ্তানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসাবেন।
বিশ্বে এখন এমন এক সময় চলছে, যখন ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এমন সময়েই ব্রাজিল আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি নিজেদের দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। লুলার সরকার বিশ্বকে দেখাচ্ছে, একটি রাষ্ট্র কীভাবে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে বিচারবহির্ভূত চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট একা শুল্ক বসানোর ক্ষমতা রাখেন না। এই ক্ষমতা আছে শুধু কংগ্রেসের। অর্থাৎ ট্রাম্প কেবল নিজ দেশের আইন লঙ্ঘন করছেন না, তিনি অন্য দেশকেও তাঁদের বিচারব্যবস্থা থামাতে বাধ্য করতে চাইছেন। অথচ ব্রাজিল যা করছে, তা সংবিধান মেনেই করছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাবেক প্রেসিডেন্টকেও বিচারের আওতায় আনা যেতে পারে, যদি তিনি অপরাধে জড়িত থাকেন।
যা ব্রাজিল করছে, তা যুক্তরাষ্ট্রে যা হয়েছে, তার থেকে একদম আলাদা।
যুক্তরাষ্ট্রে ৬ জানুয়ারির পার্লামেন্ট হামলায় যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের বিচারপ্রক্রিয়া ধীরে হলেও সঠিক পথে এগোচ্ছিল। কিন্তু ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে সবাইকে ক্ষমা করে দেন। এমনকি যাঁরা সবচেয়ে বেশি সহিংস ছিলেন, তাঁদেরও। তিনি এমন লোকদেরও ক্ষমা করে দেন, যাঁরা একটি হামলায় জড়িত ছিলেন। ওই হামলায় পাঁচজন মারা যান এবং ১০০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য আহত হন। ট্রাম্পের চোখে এই অপরাধ কোনো অপরাধই ছিল না।
এমন অবস্থায় ব্রাজিলের বর্তমান প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা ট্রাম্পের হুমকিকে জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো বিদেশি প্রেসিডেন্ট আমাকে বলে দিতে পারেন না, কী করতে হবে।’ তিনি স্পষ্টভাবে ট্রাম্পের বাণিজ্য হুমকিকে ‘অযাচিত ব্ল্যাকমেল’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
লুলা শুধু বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই নয়, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মার্কিন নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধেও সোচ্চার। তিনি মনে করেন, ব্রাজিলের ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন চালু থাকা উচিত। কারণ, মার্কিন টেক কোম্পানিগুলো অনেক সময় মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয় এবং বিদেশি রাজনীতিতে প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে।
বিশ্বে এখন এমন এক সময় চলছে, যখন ট্রাম্প আবার প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এমন সময়েই ব্রাজিল আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি নিজেদের দৃঢ়তা দেখাচ্ছে। লুলার সরকার বিশ্বকে দেখাচ্ছে, একটি রাষ্ট্র কীভাবে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে বিচারবহির্ভূত চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।
এ দৃষ্টান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ট্রাম্প কেবল যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ধ্বংস করছেন না, তিনি বিশ্বের অন্যান্য দেশেও স্বৈরাচার ও অনিয়মকে উৎসাহিত করছেন। তাঁকে বিশ্বজুড়ে এই কাজ করতে দেওয়া উচিত নয়। ব্রাজিল যেভাবে প্রতিবাদ করেছে, অন্য দেশগুলোকেও সেই সাহসিকতা দেখাতে হবে।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী। তিনি বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ