স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী
Published: 25th, March 2025 GMT
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদি শোষণ, বৈষম্য এবং দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম। এ যুদ্ধে সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বাঙালি সেনাসদস্য, পুলিশ, আনসার ও ইপিআর (পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস) প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
২৫ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনারা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ঢাকায় বর্বর হামলা চালালে বাঙালি সেনারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিদ্রোহী বাঙালি সেনাসদস্যদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল সামরিক বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তানে থাকা বিভিন্ন সেনা, পুলিশ, ইপিআর ও আনসার সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। বাঙালি সেনারা স্থানীয় জনগণকে সংগঠিত করে বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম আরও কার্যকর করার জন্য বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়, যেখানে প্রতিটি সেক্টরে একজন সেক্টর কমান্ডার দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখযোগ্য সেক্টর কমান্ডাররা হলেন– মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, মেজর মীর শওকত আলী, উইং কমান্ডার বাশার, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর জলিল, কর্নেল তাহের প্রমুখ। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকে আরও গতিশীল ও আক্রমণাত্মক করার লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনীর তিনটি ব্রিগেড (জেড ফোর্স, কে ফোর্স, এস ফোর্স) গঠন করা হয়, যারা সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। এই সেক্টরভিত্তিক সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করে। সেক্টর কমান্ডাররা বিভিন্ন আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক কর্মকৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সফলতা অর্জন করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের সমন্বয়ে গেরিলা কৌশল অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখে। রেললাইন ও ব্রিজ ধ্বংস এবং শত্রুর রসদ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত করে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে দুর্বল করাই ছিল গেরিলা যুদ্ধের মূল লক্ষ্য।
বিভিন্ন সেক্টরে পুরো দেশকে ভাগ করার উদ্দেশ্যই ছিল শত্রুকে আলাদাভাবে দুর্বল করে প্রতিহত করা। সেক্টর কমান্ডারদের দক্ষ নেতৃত্ব, যুদ্ধের কৌশল ও সামরিক পারদর্শিতা সেনাসহ সবার মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল, যা অতি দ্রুত যুদ্ধে সফলতা এনেছিল। মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ফেনী নদী থেকে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি এবং ফেনী পর্যন্ত ছিল ১ নম্বর সেক্টর। ঢাকা, কুমিল্লা, আখাউড়া-ভৈরব, নোয়াখালী ও ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল ২ নম্বর সেক্টর, যেখানে নেতৃত্বে ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। মেজর কেএম সফিউল্লাহ হবিগঞ্জ, আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে পূর্বদিকে কুমিল্লা জেলার অংশবিশেষ ও কিশোরগঞ্জ এবং ঢাকার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ৩ নম্বর সেক্টরে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। সিলেট জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ৪ নম্বর সেক্টর মেজর সিআর দত্তের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল। ৫ নম্বর সেক্টর ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং সিলেট জেলার অংশবিশেষ নিয়ে, দায়িত্বে ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। ৬ নম্বর সেক্টর ছিল দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁও মহকুমা ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী অঞ্চল ব্যতীত সমগ্র রংপুর নিয়ে; নেতৃত্বে ছিলেন উইং কমান্ডার এম কে বাশার। রাজশাহী, পাবনা, ব্রহ্মপুত্র নদ-তীরবর্তী এলাকা ব্যতীত সমগ্র বগুড়া, দিনাজপুরের দক্ষিণাঞ্চল এবং রংপুরের কিছু অংশ ছিল সেক্টর ৭-এর অন্তর্ভুক্ত। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর নাজমুল হক, সুবেদার মেজর এ রব ও মেজর (পরে লে.
সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুধু সামরিক যুদ্ধই পরিচালনা করেননি; তারা সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত ও প্রশিক্ষিত করেছিলেন। মুক্তিবাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনারা গ্রামের তরুণ-তরুণীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের উপযোগী করে তোলেন। সেনারা জনগণের সঙ্গে মিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের প্রতিরোধ গড়ে স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অসীম বীরত্ব ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য সম্মুখ যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন। বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত সাতজনের মধ্যে তিনজন ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্য; যেমন– ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, সিপাহি মোস্তফা কামাল ও সিপাহি হামিদুর রহমান।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সামরিক আত্মসমর্পণ। সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা, কৌশল এবং দৃঢ় মনোবল এই বিজয়ের অন্যতম মূল নিয়ামক।
লে. কর্নেল কামরুজ্জামান পাভেল, পিএসসি: সেনা কর্মকর্তা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র কম ন ড র স ব ধ নত র রহম ন র সদস য কর ন ল
এছাড়াও পড়ুন:
মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন
জাতীয় নির্বাচনে পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতির দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলন প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, “মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে।”
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর গুলশানের নিজ বাসায় সমসাময়িক ইস্যুতে কথা বলার সময় তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন।
আরো পড়ুন:
বাগেরহাটে হরতাল প্রত্যাহার, নির্বাচন অফিস ঘেরাওয়ের ঘোষণা
নড়াইলে বিএনপি নেতা বহিষ্কার
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে বা কিছু আসন বেশি পাওয়ার লোভে জাতীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে কেউ যদি পিআর চায় সেটা ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনবে।”
তিনি আরো বলেন, “উচ্চ-নিম্ন সবক্ষেত্রেই আমরা পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে। তারা ইশতেহার নিয়ে জনগণের কাছে যাক, ম্যান্ডেট নিয়ে তারা তাদের ভাবনা বাস্তবায়ন করুক।”
জামায়াতসহ কয়েকটি দলের আন্দোলনের প্রস্তুতি সম্পর্কে বিএনপির এই নেতা বলেন,“যারা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তাদের দাবি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি আলোচনাধীন। এমন সময় আন্দোলন করা কতটা উচিত, সেটা জনগণ দেখবে।”
স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, “নির্বাহী আদেশে নয়, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সমাধান হোক।”
নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পরিণাম ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর চর্চায় রূপ নিবে জানিয়ে তিনি বলেন, “নির্বাহী আদেশে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করতে গেলে স্বৈরাচারের সঙ্গে যুক্ত ২৮টি দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্বাচন কাদের নিয়ে হবে? এটার উদ্দেশ্য এমন হতে পারে যে, নিজেদের অতিরিক্ত সুবিধা নিতে আন্দোলনকারীরা আরো দলের নিষিদ্ধের দাবি জানাতে পারে। এতে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে। এ সূত্র ধরে পতিত শক্তি সুযোগ নেবে।”
স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে না পারলে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে আঞ্চলিক নিরাপত্তাও হুমকিতে পড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
ঢাকা/রায়হান/সাইফ