ঈদুল ফিতরে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ভোটকেন্দ্রিক গণসংযোগে থাকছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। ঈদের পর রাষ্ট্রের সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার চিন্তা করছে দলটি। পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থান হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগের বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচন—এই তিন বিষয় কেন্দ্র করে আসতে পারে ধারাবাহিক কর্মসূচিও৷

এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। তরুণদের নতুন এই দলের নেতারা বলছেন, বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি যেভাবে সংস্কার প্রশ্নে অনেকটা বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, সেটি তাঁদের ভাবিয়ে তুলছে। সে জন্য ঈদের পরে সংস্কার নিয়ে আলোচনাকে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। এনসিপির সংস্কার সমন্বয় কমিটি এ বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করবে।

আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ না দেওয়ার প্রশ্নে এনসিপি কঠোর অবস্থানে আছে। তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পক্ষে। কিন্তু নির্বাহী আদেশের বদলে সেটি তারা চায় বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে আপাতত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল চায় এনসিপি।

বিচার চলাকালে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো যাতে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে না পারে, সেটিও চায় এনসিপি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের যেকোনো চেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে দলটি। ঈদের পরে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি এনসিপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে থাকবে বলে দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন৷

সংস্কার নিয়ে আলোচনার চিন্তা

সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ পাঁচটি কমিশনের সুপারিশের ওপর নিজেদের দলীয় মতামত ২৩ মার্চ লিখিতভাবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দিয়েছে বিএনপি। একই দিন এনসিপিও তাদের দলীয় মতামত জমা দিয়েছে।

বিএনপির মতামতের সঙ্গে এনসিপির মতামতের বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য দেখা গেছে৷ যেমন বিএনপি সংবিধানের মূলনীতির বদল চায় না; কিন্তু এনসিপি চায়৷ বিএনপি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর বহাল রাখার পক্ষে আর এনসিপি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী চার বছর করার পক্ষে। এ ছাড়া একই ব্যক্তির রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা না হওয়ার সুপারিশে বিএনপি ভিন্নমত জানিয়েছে। এনসিপির মতামত এর উল্টো।

সম্প্রতি বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সংস্কারের প্রশ্নে নেতিবাচক সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন। যেমন ২৮ মার্চ চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘সরি, এটা আপনাদের দায়িত্ব নয়। আগামী দিনে বাংলাদেশের মানুষ যাঁদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠাবে, এটা তাঁদের দায়িত্ব। আপনাদের দায়িত্ব না। এটা ভুলে যাবেন না৷’

সংস্কার নিয়ে বিএনপির এমন অবস্থান নিয়ে এনসিপির নীতিনির্ধারকদের মনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। একাধিক নেতা বলেছেন, বড় দল হওয়ার কারণে বিএনপির আপত্তিতে সংস্কারের প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে৷ এর ফলে রাষ্ট্রে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না৷ এতে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা হারিয়ে যাবে। কিন্তু সামর্থ্য ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন দল এনসিপি বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বিরোধেও জড়াতে চায় না৷ সে জন্য তাঁরা আলোচনায় আগ্রহী।

এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের দুজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের পরে সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করবে এনসিপি। আলোচনার মাধ্যমে সংস্কারের বিষয়ে এনসিপির পক্ষ থেকে একটি ঐকমত্য সৃষ্টির চেষ্টা করা হবে। এই আলোচনাগুলো করবে মূলত দলের সংস্কার সমন্বয় কমিটি৷

কী ধরনের কর্মসূচি আসতে পারে

ঈদের পরে এনসিপির দলীয় ঘোষণাপত্র ও মৌলিক কর্মসূচি প্রকাশ করা হবে। জুলাই গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগের বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচন—এই তিন বিষয় দলটির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গুরুত্ব পাবে। আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টিকেও সামনে রাখা হবে।

দলটির শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা জানান, ঈদের পরে দল গোছানোর ওপর মনোনিবেশ করবে এনসিপি। তৃণমূল পর্যায়ে দলকে সংগঠিত করতে সাংগঠনিক কমিটি গঠন এবং দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কার্যালয় নেওয়ার কাজে মনোযোগ দেওয়া হবে। দুই মাসের মধ্যে সাংগঠনিক কমিটি গঠনের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা কাজ করছেন।

ঈদের পর দলের সাংগঠনিক বিভাগে সমাবেশ এবং জেলায় জেলায় সমাবেশের মতো ধারাবাহিক কর্মসূচি থাকতে পারে বলে এনসিপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিচার, সংস্কার ও গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে এসব কর্মসূচি করা হবে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের দাবিটিকেও সামনে রাখা হবে। ইসির কাছেও এ ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হতে পারে।

এসব কর্মসূচিতে জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার, আহত, এনসিপির নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে চায় এনসিপি। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখনো কর্মসূচি ঠিক করেননি। ঈদের পরপরই কর্মসূচি ঠিক করা হতে পারে।

নিবন্ধন প্রসঙ্গ

নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করে ১০ মার্চ গণবিজ্ঞপ্তি দেয় ইসি। এতে ২০ এপ্রিলের মধ্যে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার আহ্বান জানানো হয়; কিন্তু ইসির গণবিজ্ঞপ্তির বৈধতা নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম ১৬ মার্চ হাইকোর্টে রিট করেন।

১৮ মার্চ ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত রুলসহ আদেশ দেন। রিটকারী পক্ষের কৌঁসুলি আইনজীবী আবেদা গুলরুখ সেদিন সাংবাদিকদের বলেন, হাইকোর্ট গণবিজ্ঞপ্তির কার্যকারিতা স্থগিতের পাশাপাশি রুল জারি করেছেন। তবে এই স্থগিতাদেশ শুধু রিট আবেদনকারীর (রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে৷

এনসিপির যাত্রা শুরু হয়েছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। ইসিতে নিবন্ধনের জন্য দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সক্রিয় কেন্দ্রীয় অফিস থাকা, অনূর্ধ্ব এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় জেলা অফিস এবং অন্যূন ১০০টি উপজেলা বা ক্ষেত্রমতে মেট্রোপলিটন থানায় অফিস (যার প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে ন্যূনতম ২০০ ভোটারের তালিকাভুক্তি হতে হবে) থাকতে হয়। কিন্তু নতুন দল এনসিপির পক্ষে ২০ এপ্রিলের মধ্যে এতকিছু করে ওঠা সম্ভব নয় বলে মনে করেন দলটির নেতারা৷

এনসিপির একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিবন্ধন ইস্যুতে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের মতো আমরাও ঈদের পরে আদালতে যেতে পারি।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক র জন ত ক ঈদ র পর অবস থ ন ব এনপ র এনস প র পর য য় মত মত দলট র আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

করিডোরের জন্য দু’দেশের সম্মতি লাগবে: জাতিসংঘ 

রাখাইন রাজ্যের বেসামরিক নাগরিকের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠাতে করিডোরের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সম্মতি প্রয়োজন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। 

ঢাকার জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় সমকালকে এক বিবৃতিতে জানায়, বাংলাদেশে জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা।

জাতিসংঘ অন্য অংশীদারকে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন জোরদার করবে। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে যে কোনো মানবিক সহায়তা বা সরবরাহের জন্য প্রথমে দুই সরকারের মধ্যে সম্মতি প্রয়োজন। সীমান্ত অতিক্রম করে সহায়তা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর অনুমতি নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটি ছাড়া জাতিসংঘের সরাসরি ভূমিকা সীমিত।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত রোববার এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোরের ব্যাপারে সম্মত। কারণ এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ 

এ খবর চাউর হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নের শঙ্কা করছে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া সরকার কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

তথাকথিত মানবিক করিডোর স্থাপন নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা হয়নি বলে দাবি করছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

গত অক্টোবরে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে ১২ পাতার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে রাখাইনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির কথা উল্লেখ করা হয়। রাখাইনের পণ্য প্রবেশের জন্য আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সীমান্ত বন্ধ রয়েছে, আয়ের কোনো উৎস নেই। ভয়াবহ মূল্যস্থিতি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদনে ধস, জরুরি সেবা এবং সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে সেখানে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা করছে জাতিসংঘ। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ