নেত্রকোনার মতো একটি প্রান্তিক শহরে বাস করেও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। কারণ এই শহরে যতীন সরকারের মতো চিন্তক, তাত্ত্বিক ও শিক্ষাবিদের সান্নিধ্য অর্জনের সুযোগ পেয়েছি। খুব কাছে থেকে দেখেছি তাঁর জীবনাচরণ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি তাঁর কথা। নানা প্রসঙ্গ নিয়ে তাঁর সঙ্গে করেছি আলোচনা ও বিতর্ক। আর এসব করে তাঁর আদর্শের কতটুকু ধারণ করতে পেরেছি, সেটা ঠিক বলতে না পারলেও অন্তত এটুকু বলতে পারি, এই ঋষির সান্নিধ্যে প্রত্যেকেই কম-বেশি ঋদ্ধ হয়েছি। অনুপ্রাণিত হয়েছি। জীবনকে বিশ্লেষণ করতে শিখেছি। সমাজ নিয়ে কিছু না কিছু ভাবতে শিখেছি।
কবে, কখন যতীন স্যারকে প্রথম দেখেছি মনে নেই। শুধু এটুকু মনে আছে, তখন নেত্রকোনা সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ি। শহরে প্রায়ই নানা অনুষ্ঠান হয়। মাঝেমধ্যে ময়মনসিংহ থেকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক প্রাজ্ঞ-পিণ্ডত এসে যোগ দেন, দরাজ গলায় বক্তৃতা করেন। প্রধান বা বিশেষ অতিথির আসন অলঙ্কৃত করে যারা অনুষ্ঠানের শোভা বর্ধন করেন, তারাও তাঁর বক্তৃতার পর কথার খেই হারিয়ে ফেলেন। এমনও দেখেছি, এই পণ্ডিতের বক্তৃতার আগে দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ন্ত। আবার তাঁর বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা আসন। তথাকথিত সেই প্রধান বা বিশেষ অতিথির আসনে থাকা হর্তা-কর্তাদের বক্তৃতা কাউকে এতটা টানে না, যতটা বিমোহিত করে এই পণ্ডিতের বক্তৃতা। তখন থেকেই মনে মনে এই ঋষির ভক্ত বনে যাই। তিনি আসবেন শুনলে আগেভাগেই হাজির হই।
নাসিরাবাদ কলেজের অধ্যাপনা শেষ করে তিনি যখন ময়মনসিংহ ছেড়ে নেত্রকোনা শহরের বানপ্রস্থে (যতীন সরকারের বাসা) থিতু হন, তখন আমাদের সামনে যেন অবারিত সুযোগ এসে ধরা দেয়। শহরের ছোটো-বড়ো সব অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে ওঠেন তিনি। ততদিনে আমি পুরোদস্তুর সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী। কাজেই ঘনিষ্ঠ হতে বেশি দিন লাগেনি। অনেক অনুষ্ঠানে নিজেও থাকতাম আয়োজক দলের কর্মী হিসেবে।
স্যার জানতেন, আমি লেখালেখি, বিশেষত সাংবাদিকতা করি। কিন্তু ইচ্ছে করেই এসব নিয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো আলোচনায় যেতাম না। কারণ তাঁর পাণ্ডিত্যের কাছে আমি বা আমরা ছিলাম নস্যি। অনেক সময় তাঁর প্রশ্নে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না আমাদের। কাজেই আমরা কেবল শুনতাম। আর তিনি মাস্টারের মতো শুধু বলে যেতেন। নিজেই আবার গর্ব করে বলতেন, ‘মাস্টারিটা ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলাম। তাই সারাজীবন শুধু মাস্টারিই করেছি। গলাবাজিটা ভালোই পারি। হা হা!’
একবার স্যার আথ্রাইটিসের যন্ত্রণায় বিছানাশায়ী হয়ে পড়লেন। দাঁড়াতে-বসতে পারতেন না। দীর্ঘদিন এভাবেই বিছানায় থাকতে হয়। সে কারণে লেখালেখি বন্ধ হবার উপক্রম। কিন্তু পত্র-পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকরা নতুন লেখা চান। তাই নিজেই একটা বিহিত বের করলেন। তিনি বলে যাবেন, আরেকজন শুনে শুনে কাগজে লিখে দিবেন। বিষয়টি নিয়ে তাঁর বন্ধু কবি ও সাংবাদিক আল্-আজাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। জানতে চাইলেন, হাতের লেখা মোটামুটি সুন্দর এবং ঠিকমতো বাংলা বানান জানে, এমন কেউ আছে কি না? আল্-আজাদ ভাই কী মনে করে আমার কথা বলে আসলেন। কিছুক্ষণ পরই স্যার ফোন করলেন, ‘বিকেলে একটু বাসায় এসো’। আমি জড়সড় হয়ে হাজির হলাম। স্যার তাঁর উদ্দেশ্য জানিয়ে একটি প্রবন্ধ বলতে শুরু করলেন। আমি কাগজে লিখতে থাকলাম। তাৎক্ষণিক শুনে শুনে লিখতে গিয়ে কিছুটা কাটাছেঁড়া হলো। প্রবন্ধ বলা শেষ করে স্যার বললেন, ‘বাসায় গিয়ে এটা সুন্দর ও নির্ভুলভাবে লিখবা। এরপর আগামীকাল সকালে আমাকে দিয়ে যাবা। একটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার জন্য পাঠাতে হবে।’
শুরু হলো পরীক্ষা দেওয়ার পালা। হাতের লেখা সুন্দর হতে হবে। বানান ভুল করা যাবে না। বাসায় এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম। ছোটো বোন বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শিল্পীকে বললাম, প্রবন্ধটি পড়ে যেতে। আর আমি কম্পোজ করে গেলাম। দুজনই খুব সতর্ক থাকলাম বানানের ব্যাপারে। কম্পোজ শেষে বারবার পড়লাম। ভুল বানান ঠিক করলাম। রাত তিনটার ওপর বেজে গেল। পরদিন সকালে প্রিন্ট করে হাজির হলাম স্যারের বাসায়। মনে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস কোনো বানান ভুল হয়নি নিশ্চিত। আবার এটিও ভাবি, ভুল হলে আজাদ ভাই ছোটো হবেন, নিজেও বিরাট লজ্জা পাবো। কিন্তু আশ্চর্য্য, স্যার চার পৃষ্ঠার লেখাটা হাতে নিয়ে বড়জোর দুই মিনিট চোখ বুলালেন। এরই মধ্যেই দুই-তিনটা বানান আন্ডারলাইন করলেন। ‘ণ’ এর জায়গায় ‘ন’। স্যত্যি কথা বলতে কী, আমি তখন ণত্ব বিধান ও ষত্ব বিধান সম্পর্কে জানতাম না। সেই যে স্যারের কাছে পাঠ নিয়েছিলাম, আজঅবধি ওই ধরনের বানান লিখতে গিয়ে সতর্ক থাকার চেষ্টা করি।
‘নেত্রকোনার লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি’ বইটির পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে ইচ্ছে হলো স্যারকে একটু দেখাই। স্যার যদি অনুমতি দেন, তবেই প্রকাশককে দেবো। পাশাপাশি স্যারকে অনুরোধ করব একটা ভূমিকা লিখে দিতে। কিন্তু কিছুতেই স্যারের সামনে গিয়ে বলার মতো সাহস পাচ্ছিলাম না। সহকর্মী সাংবাদিক পল্লব চক্রবর্তীর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। পল্লব বলল, ‘বিকেলে চলেন, আমিই স্যারকে বলব।’ এক বিকেলে পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে স্যারের কাছে গেলাম। উদ্দেশ্য বলার সঙ্গে সঙ্গে স্যার পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে বললেন, ‘এখন চলে যাও। এখন আমি পারব না।’ আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। স্যার না পড়েই এমন করলেন! মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। পল্লব স্যারকে ফোন করে আমার মন খারাপের কথা জানাল। রাতে স্যার ফোন করে যা বললেন, তাতে আমি আরো অবাক- ‘শোনো, আমি প্রতিদিন এই টাইমে টিভিতে একটা সিরিয়াল দেখি। তোমরা আসায় সিরিয়ালটা চলে যাচ্ছিল। সে কারণে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। কাল সকালে এসে পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে যেও।’
ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হলো। সকালে আবার পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে এলাম। ভূমিকা লেখার প্রসঙ্গে আর গেলাম না। তিনদিন পর ফোন করলেন, ‘আমি তোমার পুরো পাণ্ডুলিপিটা পড়েছি। ভালো হয়েছে তোমার কাজটা। তবে পালাগানের প্রসঙ্গটা আনা দরকার ছিল।’ জানতে চাইলেন, ‘তোমার বইটার ভূমিকা কে লিখবে?’ আমি বললাম, ‘আমি তো ভেবেছিলাম আপনিই লিখবেন।’ সঙ্গে সঙ্গে স্যার হাসতে হাসতে বললেন, ‘বিকেলে এসে নিয়ে যেও। আমি একটা ভূমিকা লিখে রেখেছি। হা হা হা!’ মনে আছে, একবার জেলা প্রশাসন আয়োজিত গ্রন্থ মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি আমারটাসহ আরও কয়েকটা বই নিয়ে উপস্থিত হলেন। বক্তৃতার সময় দর্শকদের একটার পর একটা বই দেখিয়ে বললেন, ‘নেত্রকোনার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে এই বইগুলো পড়বেন।’
আরেকবার রবীন্দ্রসঙ্গীতাচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জীবনীগ্রন্থ লিখে স্যারের কাছে গেলাম। বললাম, ‘স্যার পাণ্ডুলিপিটা একটু পড়ে দিবেন।’ তিনি চার-পাঁচদিনে পুরোটা পাণ্ডুলিপি পড়লেন। এরপর ফোনে বললেন, ‘তুমি একটা অসাধারণ কাজ করেছো। শৈলজারঞ্জন সম্পর্কে এতকিছু জোগাড় করলা কেমনে? ভালো একজন পাবলিশারকে দিয়ে বইটা প্রকাশ করো। এই কাজটার খুব দরকার ছিল।’ আমি স্যারকে ভূমিকা লিখে দিতে বললাম। তিনি লিখে দিলেন। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্ম-মৃত্যু দিবসে উদীচীর উদ্যোগে আলোচনা-অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্যারই প্রধান আলোচক থাকতেন। তিনি আমার বইটা নিয়ে যেতেন। বারবার বইটার রেফারেন্স তুলে ধরে আলোচনা করতেন। কোনো কোনো সময় বলতেন, ‘আজকে সঞ্জয় সরকারই মূল আলোচনা করবে। আমি শুধু সমাপ্তি টানবো।’
উকিল মুন্সিকে নিয়ে একাত্তর টিভিতে একটা ডক্যুমেন্টারি করেছিলাম। আমি ছিলাম অনুষ্ঠানটির সূত্রধর। প্রযোজক আর ক্যামেরা ক্রুদের নিয়ে স্যারের সাক্ষাৎকার নিতে গেলাম। উঠানে রাখা একটি চেয়ারে বসে কয়েকটি বই হাতে নিয়ে সাক্ষাৎকার দিলেন। মুহম্মদ আকবর সম্পাদিত ‘উকিল মুন্সি: প্রামাণ্য পাঠের সন্ধানে’ বইয়ে মুদ্রিত আমার ‘বিরহী বাউল উকিল মুন্সি’ শিরোনামের প্রবন্ধটি বের করে বললেন, ‘উকিল মুন্সি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে গেলে সঞ্জয়ের এই প্রবন্ধটি পড়তে হবে।’ কী যে ভালো লাগল! যদিও ডক্যুমেন্টারির সময়সীমা ঠিক রাখতে ওই অংশ বাদ দিয়ে আমরা শুধু স্যারের মূল আলোচনাটুকুই রেখেছিলাম।
স্যার জানতেন আমি ছড়াচর্চা করি। রমজান মাসের এক ছুটির দিন। সকাল এগারোটায়ও ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ স্যারের ফোন: ‘আমাদের সময় পত্রিকায় তোমার ছড়া পড়লাম। রমজানের বাজার দর নিয়ে লেখা। চমৎকার হইছে ছড়াটা। তুমি দেখোনি?’ আমি ‘না’ বলতেই বললেন, ‘তোমার ছড়া, অথচ তোমার আগেই আমি দেখলাম। হা হা হা! ছড়া তুমি ভালোই লেখো। নিয়মিত লিখে যাও।’ নেত্রকোনার উদীচীতে আমার ‘ফাগুন দিনের আগুন ছড়া’ বইটি নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছিল। স্যার ছিলেন প্রধান আলোচক। তিনি একেকটা ছড়া ধরে ধরে আলোচনা করলেন। তাঁর প্রশংসা-বাক্যে লজ্জায় আমার মুখ লাল হয়ে গেল। যদিও জানতাম, একটু বাড়িয়েই বলেছেন স্যার। আসলে আনকোড়া বা নবীন লেখকদের এভাবেই উৎসাহ দিতেন তিনি। আবার এমনটিও দেখেছি, কারও লেখা অতি নিম্নমানের বা কোনোরূপ লেখাই না হলে, অথবা ভুল তথ্য উপস্থাপন করলে, ধমকের স্বরে বলে দিয়েছেন, ‘ঘোড়ার ডিম লিখছো। কিচ্ছু হয় নাই। আগে পড়াশোনা করো।’ তখন প্রাসঙ্গিক কিছু বইয়ের নাম উল্লেখ করে সেগুলো পড়ার পরামর্শ দিতেন।
নেত্রকোনার সাংবাদিক ও চিন্তক কুন্তল দাকে (কুন্তল বিশ্বাস) ঘিরে আমাদের একটি নিয়মিত আড্ডা ছিল। সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি নানা প্রসঙ্গ ছিল সে আড্ডার বিষয়। কিন্ত কুন্তুলদা হঠাৎ মারা যাওয়ার পর সে আড্ডাটি ভেঙে গেল। আমরা তাঁর ভক্তরা আড্ডার মেজাজটিকে ধরে রাখতে ‘বাতিঘর’ নামে একটি সংগঠন করলাম। আমি ছিলাম সভাপতি, আর মোঃ আলমগীর সাধারণ সম্পাদক। আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমরা অনেক অনুষ্ঠান করেছিলাম ওই সময়। স্যার সেসব অনুষ্ঠানে আলোচনা করতেন। কিন্তু সংগঠন পরিচালনার অর্থ সঙ্কট এবং আমাদের চাকরিসহ জীবন-জীবিকার নানা টানাপড়েনে একটা সময়ে এসে সেই আড্ডার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পুরো ব্যর্থ হই। এ নিয়ে প্রচণ্ড রকমের অভিমান করেছিলেন স্যার। বহুদিন পর্যন্ত দেখা পেলেই ভর্ৎসনা করেছেন আমাদের।
ময়মনসিংহ প্রেসক্লাব থেকে আমি যখন ‘বর্ষসেরা সাংবাদিক পুরস্কার (২০২২) অর্জন করি, পরদিন পত্রিকায় খবরটি দেখেই স্যার ফোন করেন। উচ্চস্বরে তিনবার বলেন, ‘অভিনন্দন! অভিনন্দন! অভিনন্দন!’ আমার মনে হল যেন অস্কার জয় করেছি। যতীন সরকারের মতো একজন মনীষীর কাছ থেকে এমন অভিনন্দন-বার্তা শুনতে কার না ভালো লাগে! আমার স্ত্রী সঙ্গীতশিল্পী পিয়া বৈশ্যকে দেখলেই বলতেন, ‘জালাল খাঁর গান এখনও করোতো? জালাল খাঁ ও তাঁর জীবনদর্শন নিয়ে দীর্ঘ সময় গবেষণা করেছেন তিনি।
কয়েকটি পত্র-পত্রিকার সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদকগণ জানতেন, স্যারের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ-সম্পর্ক আছে। তাই বিশেষ কোনো সংখ্যা প্রকাশের আগে তারা স্যারের লেখা সংগ্রহ করে দিতে আমার সাহায্য চাইতেন। কিন্তু একটা সময়ে এসে স্যার বার্ধক্যজনিত জটিলতায় নতুন কিছু লেখার শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। সম্পাদকগণ তাও আমাকে তাগিদ দিতেন। বলতেন, নতুন না হলে অন্তত পুরনো লেখাই সংগ্রহ করে দেন। আমি প্রথম দিকে স্যারের অনুমতি নিয়ে পুরনো লেখা ফটোকপি বা স্ক্যান করে তাদের কাছে পাঠাতাম। কিছুদিন বাদে দেখলাম, স্যারের পক্ষে এখন আর পুরনো লেখা খুঁজে দেওয়াও সম্ভব না। তখন আমি নিজেই স্যারের বিভিন্ন বই থেকে লেখা কপি করে পাঠিয়ে দিতাম। এরপর তারা যখন সম্মানীর টাকা পাঠাতেন, তুলে দিয়ে আসতাম স্যারের হাতে। টাকাগুলো পেয়ে অবাক হতেন। আবার দারুণ খুশিও হতেন। তাঁর হাসিমুখটা দেখতে খুব ভালো লাগত। আসলে শেষ বয়সে এসে লেখালেখিই ছিল তাঁর সামান্য উপার্জনের পথ, যদিও ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আর্থিক কোনো টানাপড়েন ছিল না তাঁর। কিন্তু একজন লেখক যখন তাঁর লেখার সম্মানী পান, তখন অন্যরকম এক ভালোলাগা কাজ করে।
যতীন স্যার আমৃত্যু মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ছিলেন। লেখায়, কথায়, কাজে- সবসময় সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা চেয়েছেন। আবার কাউকে ভিন্ন পথে পারিচালিত হতে দেখলে, মনে যা আসত তা কোনো রকম রাখঢাক না করে সোজাসাপ্টা বলে দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনীতি একদিন না একদিন কালো টাকা ও পেশিশক্তি মুক্ত হবেই। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শোষিত, বঞ্চিত, মেহনতি ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষেরা জাগবেই। এ নিয়ে প্রায়ই ক্রিয়েটিভ বিতর্কে জড়াতাম স্যারের সঙ্গে। বাংলাদেশের বাম রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার সময় একদিন স্যারকে বলে বসলাম, ‘বাম দলগুলো এখন খণ্ডিত, একেক নেতার একেকটি দল। এ অবস্থায় আগামী ৫০ বছরে সে-রকম কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না।’ বলা শেষ করতে না করতেই স্যার প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। গলা ফাটিয়ে বললেন, ‘আমি তীব্র প্রতিবাদ করি তোমাদেও মতো বুর্জুয়াদের এসব প্রপাগান্ডায়। কমিউনিস্টরা একদিন না একদিন ক্ষমতায় আসবেই। আসতেই হবে। এটা আমার কথা না। কার্ল মার্কসের কথা। তাঁর কথা ও যুক্তি ভুল হতে পারে না।’ বলতে বলতে টেবিলের ওপর সজোরে তিনবার হাত চাপড়ালেন। আমি হতচকিত হয়ে গেলাম।
১৮ আগস্ট স্যারের জন্মদিন। আমরা স্থানীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মীরা কুন্তলদা’র নেতৃত্বে তাঁর ৭২তম জন্মদিনটি প্রথম উদযাপন করেছিলাম। সেই যে শুরু হয়েছিল, পরে প্রতিবছরই তা ঘটা করে উদযাপিত হয়েছে। ক্রমে এই দিনটি নেত্রকোনা শহরের একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছিল। স্যারের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নানা প্রান্তে থাকা ভক্তরা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিতেন প্রশাসনের কর্তাসহ ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও। রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় অনেকেরই জন্মদিন পালন হতে দেখা যায়। কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, যতীন স্যারের জন্মদিনে নানান মত-পথের মানুষদের উপস্থিতিতে যে প্রাণের সঞ্চার হত, সচরাচর এমন দৃশ্যের দেখা মেলে না। গেল বছর (২০২৪) আমরা স্যারের ৮৯তম জন্মদিন উদযাপন করেছিলাম। এবার তিনি নব্বইয়ে পা রাখতেন। সবার ইচ্ছা ছিল দিনটিতে আরও বড় পরিসরে উদযাপনের। কিন্তু নিয়তি বাধা হয়ে দাঁড়াল। জন্মতারিখের পাঁচদিন আগেই পৃথিবীকে প্রস্থান জানিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন আমাদের প্রিয় ঋষি।
তারা//
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর যত ন সরক র ন ত রক ন র কর ছ ল ম র বক ত ত র ফ ন কর ন কর ছ ল র র জন ম অন ষ ঠ ন ন আম দ র ন করল ন প রবন ধ প রসঙ গ র জন ত প রক শ যত ন স স য রক ক ত কর ত কর ম র জ বন র একট র সময় উদয প বলল ম বলত ন একদ ন বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
বৈষম্য দূরীকরণে ৯ দাবি রাবি শিক্ষক-কর্মকর্তাদের
প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা বহাল এবং বৈষম্য দূরীকরণে ৯ দফা দাবি জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
শনিবার (১৬ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনস কমপ্লেক্সের শিক্ষক লাউঞ্জে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এসব দাবি জানান তারা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এগ্রোনমি ও এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আব্দুল আলিম, প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড.মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান, অফিসার সমিতির সভাপতি মোক্তার হোসেন ও কোষাধ্যক্ষ, মাসুদ রানাসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
আরো পড়ুন:
রাবি অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ
রাকসু ফান্ডে জমা ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা, হল সংসদের ফান্ড অস্পষ্ট
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে এবং দীর্ঘ ১৫ বছরের গুম-খুন ও নির্যাতনের অবসান হয়। গণঅভ্যুত্থানে জনগণের প্রত্যাশা ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান এবং গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই প্রত্যাশা পূরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।
তারা বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবতাও প্রায় একই রকম। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য সেবা, আবাসন, যাতায়াত, পেশাগত সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন এবং দুর্নীতিবাজ ও নিপীড়কদের দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণে কার্যকর অগ্রগতি দেখা যায়নি। এসব জরুরি বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার ঘোষিত সুবিধা বহাল রয়েছে। অথচ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তা কার্যকর হয়নি।
বক্তারা বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বাইরে কোনো বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। তাই এখানেও শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য একই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
অফিসার সমিতি সভাপতি মুক্তার হোসেন বলেন, “পোষ্য কোটা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা এক নয়। আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা চাই, কোটা নয়। আমাদের সন্তানরা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেই এখানে ভর্তি হোক এটা চাই।”
রাবি/ফাহিম/সাইফ