ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান কার্যালয় নগর ভবন ও এর আওতাধীন আঞ্চলিক অফিসগুলো টানা ৪০ দিন বন্ধ থাকার অভিঘাত এখনো কাটেনি। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব দেওয়ার দাবিতে গত মে-জুনে এই কর্মসূচি চলেছিল। এর ফলে সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্থাটির রাজস্ব আদায় গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির রাজস্ব বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) সংস্থাটির মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭৯১ কোটি টাকা। অথচ আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) রাজস্ব আদায় হয়েছিল এক হাজার ৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছর আদায় কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগর ভবনসহ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১০টি আঞ্চলিক অফিস বন্ধ থাকায় নগরবাসী নিয়মিত সেবা থেকে যেমন বঞ্চিত হয়েছেন, তেমনি সিটি করপোরেশনও তাদের গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব আয় হারিয়েছে। এর দায় প্রশাসন ও আন্দোলনকারীদের উভয়কেই নিতে হবে।

সেবা বন্ধ করায় ধস

আদালতের রায়ের আলোকে বিএনপির নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে চলতি বছরের ১৪ মে থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত টানা ৪০ দিন বিএনপির নেতা-কর্মী এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নগর ভবনে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি পালন করেন। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে দক্ষিণ সিটির আওতায় থাকা মোট ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়েও সাধারণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নগরবাসীর সেবা গ্রহণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর ও ফি প্রদান কার্যক্রম পুরোপুরি থমকে যায়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিবছর মে ও জুন মাসেই রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হয়। কারণ, অর্থবছরের শেষ সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকেরা বকেয়া পরিশোধ করেন এবং নতুন বছরের জন্য অনুমতি বা নবায়ন নেন। কিন্তু এবার সেই সময়ে নগর ভবন বন্ধ থাকায় রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়।

রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তার ভাষ্য, ‘প্রতিবছর মে-জুনে আমাদের মোট রাজস্বের প্রায় ৩০ শতাংশ আসে। এবার সেই সময়েই নগর ভবন ও আঞ্চলিক কার্যালয় বন্ধ থাকায় বহু করদাতা কর বা ফি জমা দিতে পারেননি। এতে আমরা লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে থেকে গেছি।’

যেসব খাতে রাজস্ব আদায় কম

ঢাকা দক্ষিণ সিটি মোট ৫২টি খাত থেকে রাজস্ব আদায় করে। এর মধ্যে বেশি পরিমাণ আদায় হয় গৃহকর খাতে। এই খাতে গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল ৫৬০ কোটি টাকা আদায়ের। কিন্তু আদায় হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। ট্রেড লাইসেন্স (নতুন ও নবায়ন) তথা ব্যবসার অনুমতিপত্রের খাতে ১৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছিল। তবে আদায় হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। একইভাবে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর কর খাতে ১৫০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও আদায় হয়েছে ৮২ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাজার সালামি তথা সিটি করপোরেশনের আওতাধীন মার্কেটগুলোয় দোকান ভাড়া বাবদ ১০০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করা হলেও মাত্র ৩৫ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে সংস্থাটি। একই অবস্থা অন্য খাতগুলোরও।

রাজস্ব বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ডিএসসিসি রাজস্ব আদায় করেছিল ৭০৩ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৭৯ কোটিতে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩-এ তা বেড়ে ১ হাজার ৩২ কোটি টাকায় পৌঁছায় এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ হাজার ৬১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। অর্থাৎ গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে রাজস্ব আয় বেড়েছে। কিন্তু গত অর্থবছরে তা হঠাৎ করে ৭৯১ কোটিতে নেমে এসেছে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।

সংস্থাটির একজন সাবেক প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের রাজস্ব আদায় কেবল একটি সংখ্যাই নয়, এটি নাগরিক সেবার পরিমাপক। রাজস্ব না এলে সেবা থমকে যাবে, শহর থেমে যাবে। মানুষকেও নানা ভোগান্তিতে পড়তে হবে।’

সেবাবঞ্চিত হবে মানুষ

কম রাজস্ব আদায় হওয়া কারণে উন্নয়নকাজেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যেমন নিজস্ব অর্থায়নে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন ৭৫টি ওয়ার্ডের ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট ঠিক করা ও জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে প্রতিবছর সাধারণত ১০০ কোটির মতো বরাদ্দ রাখা হয়। এবার হয়তো এই খাতে কম টাকা খরচ করতে হবে বলে জানিয়েছেন প্রকৌশলীরা।

রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবছর যেখানে ঊর্ধ্বগতি হয়, সেখানে এবার কম আদায় হয়েছে। আবার চলতি অর্থবছরে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে উন্নয়ন ব্যয় ও পরিচালন ব্যয়ে প্রভাব পড়বে। যেখানে ১০ টাকা খরচের চিন্তা ছিল, সেখানে হয়তো ৫ টাকা খরচ করতে হবে। মোটা দাগে সব খাতেই কাটছাঁট করতে হবে। এতে মানুষ সেবাবঞ্চিত হবে।

আন্দোলনের কারণে রাজস্ব কম আদায় হওয়ার বিষয়ে জানতে ইশরাক হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। একাধিকবার তাঁকে কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন লিখে পাঠালেও কোনো জবাব দেননি তিনি।

দায় নিতে হবে সবাইকে

ঢাকা দক্ষিণ সিটির হিসাব বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে আয়ের ভিত্তিতে ব্যয়ের ছক করেছিলাম, সেটা আর কার্যকর রাখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া অনিবার্য।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে ডিএসসিসি ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এর ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা, রাস্তা-মেরামত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, দাপ্তরিক ব্যয়সহ নানা খাতে বরাদ্দ নির্ধারিত হয়। কিন্তু বছর শেষে দেখা যাচ্ছে, সেই লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেনি সংস্থাটি।

বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক আন্দোলনের সংস্কৃতি গণতান্ত্রিক চর্চাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে নাগরিক সেবা বন্ধ করে দাবি আদায়ের প্রবণতা জনস্বার্থবিরোধী। প্রশাসনিক স্তরেও জবাবদিহির ঘাটতি ছিল বলে মনে করছেন অনেকে। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনায় নাগরিক সুরক্ষায় স্পষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো ও ডিজিটাল সেবার বিকল্প পথ না থাকাটাও বড় একটি দুর্বলতা। এই বিষয়ও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, জনসেবা বন্ধ করে রাজনৈতিক দাবিতে আন্দোলন করাটা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের চরম অবহেলা। এর দায় প্রশাসন ও আন্দোলনকারীদের উভয়কেই নিতে হবে। তিনি বলেন, এই ঘটনায় যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা শুধু হিসাবের অঙ্ক নয়—নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে।

এই ঘটনার পর তিন মাস কেটে গেলেও প্রভাব কাটেনি। চলতি অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। রাজস্বের এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পাশাপাশি আগের ঘাটতি পূরণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আর এতে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হলে সরাসরি ভোগান্তিতে পড়বেন নগরবাসী।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র আওত ধ ন প রথম আল কর মকর ত নগর ভবন বন ধ থ ক ঠ ক কর ত বছর বছর র

এছাড়াও পড়ুন:

৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ

‎পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চারটি কোম্পানির সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন না করায় সাত নিরীক্ষক (অডিটর) প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের জন্য অডিট এবং অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সেইসঙ্গে ওই নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষকদের কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না, সেই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে তাদের শুনানিতে ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

আরো পড়ুন:

সোনালী পেপারের শেয়ার কারসাজি: ১১ কোটি ৮২ লাখ টাকা জরিমানা

পুঁজিবাজার উন্নয়নে ডিএসই ও ডিসিসিআইয়ের যৌথ সভা

‎গত মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে ৯৭৩তম কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ‎বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

‎সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক এ হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; রিংসাইন টেক্সটাইল লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক যথাক্রমে: আহমেদ অ্যান্ড আক্তার, মাহফেল হক অ্যান্ড কোং, আতা খান অ্যান্ড কোং এবং সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; আমান কটন ফাইব্রাস লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক ইসলাম কাজী শফিক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস এবং ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৮ ও ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক মাহফেল হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন করেনি। 

এ সকল নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষককে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানি, সকল ধরনের বিনিয়োগ স্কিম (যথা- মিউচ্যুয়াল ফান্ড, অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ও এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড) এবং পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী সকল প্রতিষ্ঠানের অডিট ও অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রম পরিচালনার উপর নিষেধাজ্ঞা তথা পাঁচ বছরের জন্য অডিট ও অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণে কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে শুনানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

‎ঢাকা/এনটি/বকুল 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিনা মূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সুযোগ, সারা দেশে ৮টি কেন্দ্রে
  • ২ কোম্পানির ক্রেডিট রেটিং নির্ণয়
  • ৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ
  • সেপ্টেম্বরের ১৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ হাজার কোটি টাকা
  • বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনে ২৬ ব্যাংক থেকে ৩৫ কোটি ডলার কিনল কেন