‘আমি আরও ৩০ বছর বাঁচতে পারতাম, কিন্তু মরতে চাই’: কেন স্বেচ্ছায় মরতে চান এই কানাডীয়
Published: 4th, April 2025 GMT
একটি নাট্যশালার মঞ্চে বসে আছেন এপ্রিল হাবার্ড। ওই মঞ্চে অনেকবার পারফর্ম করেছেন তিনি। চলতি বছরের শেষ দিকে সেখানেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করার পরিকল্পনা করছেন এই নারী।
প্রাণঘাতী কোনো রোগে আক্রান্ত নন এপ্রিল। তবে ৩৯ বছর বয়সী এই পারফরমার ও বার্লেস্ক শিল্পী কানাডার ক্রমবর্ধমান উদার আইনের অধীন সহায়তামূলক মৃত্যুর (স্বেচ্ছায় কারও সহায়তায় যন্ত্রণাহীন মৃত্যু) অনুমোদন পেয়েছেন।
কানাডার নোভা স্কশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর হ্যালিফ্যাক্সের বাস স্টপ নাট্যশালায় বিবিসি নিউজের সঙ্গে কথা বলেন এপ্রিল। ছোট্ট ওই নাট্যশালার আসনসংখ্যা এক শটিরও কম।
এপ্রিল বলেন, তাঁর আসন্ন ৪০তম জন্মদিনের ‘কয়েক মাসের মধ্যে’ তিনি ওই নাট্যশালার মঞ্চে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পরিকল্পনা করছেন। এ সময় তাঁর পরিবার ও বন্ধুদের একটি ছোট দল উপস্থিত থাকবে।
এপ্রিল বড় একটি আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর পরিকল্পনা করেছেন। এটিকে তিনি ‘উদ্যাপনের’ মুহূর্ত বলে মনে করছেন। একজন পেশাদার চিকিৎসক তাঁর রক্তপ্রবাহে একটি প্রাণঘাতী ইনজেকশন দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করবেন। তিনি চান, মৃত্যুর সময় তাঁর ভালোবাসার মানুষেরা যাতে তাঁকে ঘিরে থাকে ও জড়িয়ে থাকে। তাঁদের সমর্থন নিয়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে চান তিনি।
এপ্রিল জন্ম থেকেই স্পাইনা বিফিডা নামের মেরুদণ্ডের একটি জটিল রোগে আক্রান্ত। তাঁর মেরুদণ্ডের গোড়ায় একটি টিউমার ধরা পড়েছে। তিনি জানান, ওই টিউমারের কারণে তাঁকে অবিরত কাহিল করে দেওয়া যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে।
২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শক্তিশালী ব্যথানাশক নিচ্ছেন এপ্রিল। তিনি ২০২৩ সালের মার্চে মরার জন্য চিকিৎসা সহায়তার (মেইড) আবেদন করেছিলেন। শরীরে এই রোগ নিয়ে তিনি কয়েক দশক বাঁচতে পারবেন। এরপরও আবেদন করার সাত মাসের মধ্যেই তাঁকে স্বেচ্ছামৃত্যুর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আর প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এ অনুমতি পাওয়া সম্ভব।
এপ্রিল বলেন, ‘আমার ভোগান্তি ও যন্ত্রণা ক্রমে বাড়ছে। আমার জীবনযাত্রার সেই মান নেই, যা আমাকে সুখী ও পরিপূর্ণ করে তুলতে পারবে।’
এপ্রিল যেখানে আছেন, সেখান থেকে তিন হাজার মাইল দূরে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের পার্লামেন্ট সদস্যরা সহায়তায় মৃত্যুকে বৈধ করার প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করছেন। তাঁরা ২০২৪ সালের নভেম্বরে নীতিগতভাবে এ পরিকল্পনার সমর্থনে ভোট দিয়েছিলেন। কয়েক মাস ধরে বিস্তারিত যাচাই-বাছাই হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার আগে আইনসভার উভয় কক্ষে আরও ভোটের প্রয়োজন।
সমালোচকেরা বলছেন, কানাডা ‘পিচ্ছিল ঢালু জায়গার’ মতো। এর অর্থ হলো, একবার আপনি সহায়তায় মৃত্যুর আইন পাস করলে এটি অনিবার্যভাবে পরিধি বাড়াবে ও এর সুরক্ষাও কম থাকবে।
সহায়তায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উদারব্যবস্থা রয়েছে কানাডায়। নেদারল্যান্ডস ও বেলজিয়ামেও এই মৃত্যুর আইন আছে। ২০১৬ সালে তারা মেইড চালু করে। প্রাথমিকভাবে অসহনীয় যন্ত্রণার শিকার গুরুতর ও দুরারোগ্য শারীরিক অসুস্থতায় আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য এটি চালু করা হয়েছিল। ২০২১ সালে সহায়তায় মৃত্যুর জন্য প্রাণঘাতী রোগ থাকার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নেওয়া হয়। এরপর দুই বছরের মধ্যে কানাডা সরকার শারীরিক নয়; বরং শুধু মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের জন্যও মেইড উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
মেইডের বিরোধীরা বলছেন, প্রতিবন্ধী ও জটিল সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মৃত্যুকে একটি আদর্শ বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
২০২৩ সালে কানাডায় মেইডের মাধ্যমে ১৫ হাজার ৩৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সে হিসাবে প্রতি ২০ জনে একজনের মৃত্যু হয়েছে মেইডের মাধ্যমে। ২০১৬ সাল থেকে দেশটিতে সহায়তায় মৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ। যাঁরা এই মৃত্যু বেছে নিয়েছেন, তাঁদের গড় বয়স ৭৭ বছর।
হাতে গোনা কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া সাধারণত একজন চিকিৎসক বা নার্স প্রাণঘাতী ডোজ সরবরাহ করেন। এরিক থমাস নামের এক চিকিৎসকের সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে। তিনি ৫৭৭ জন রোগীকে মৃত্যুবরণ করতে সাহায্য করেছেন।
কানাডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব মেইড অ্যাসেসরস অ্যান্ড প্রোভাইডারসের সভাপতি ডা.
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ