ট্রাম্পের শুল্ক আরোপে কোন কোন পণ্যে পকেট কাটা যাবে মার্কিনদের
Published: 5th, April 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’ এনে দিতে বিশ্বজুড়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শুল্কের খড়্গ চাপিয়েছেন, তার ধাক্কা সামলাতে হবে মার্কিনদেরও। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যেসব দেশ থেকে নিয়মিত পণ্য কিনে থাকে, সেসব দেশের প্রায় সবাই দেশটিতে রপ্তানি করা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে পোশাক থেকে শুরু করে কফি—সবকিছুতেই বাড়তি অর্থ গুনতে হবে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে।
গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশটিতে প্রবেশ করা শত শত কোটি ডলারের পণ্যে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। যেসব দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘সবচেয়ে খারাপ’ বলে বিবেচনা করেছেন, সেসব দেশের ওপর তিনি চাপিয়েছেন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের বোঝা। আজ ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হচ্ছে তাঁর ওই ঘোষণা।
অর্থনীতিবিদেরা ট্রাম্পের এ নতুন শুল্ক ঘোষণা ও এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা পণ্যের ওপর কোনো কোনো দেশের বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘটনায় সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন। পাল্টাপাল্টি এমন শুল্কারোপে বিশ্বজুড়ে মার্কিনদের জন্য তৈরি করা পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এটি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরম পাওয়েল।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার জেরে বিদেশি পণ্যের মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্কের বোঝা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে বা পণ্যের আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে।অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার জেরে বিদেশি পণ্যের মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্কের বোঝা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে বা পণ্যের আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। এতে যেসব নিত্যপণ্যে মার্কিনদের বাড়তি অর্থ গুনতে হতে পারে, সেসবের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—
পোশাক
পোশাকের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের বাড়তি শুল্কের ধাক্কা লাগবে ভিয়েতনাম, চীন ও বাংলাদেশের মতো পোশাক রপ্তানিকারক দেশের ওপর। যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে, সে তালিকায় প্রথম পাঁচটির তিনটিই হলো এই তিন দেশ। তাদের পণ্যের ওপর ৩৪ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প।
পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপে বিশ্বজুড়ে মার্কিনদের জন্য তৈরি করা পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এটি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে।জেরম পাওয়েল, ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যানপোশাক রপ্তানিকারক এই তিন দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করার অর্থ হলো, টার্গেট ও ওয়ালমার্টের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোসহ পোশাক খাতের পরিচিত আরও কিছু ব্র্যান্ড আর্থিকভাবে চাপ অনুভব করতে পারে। সুলভ মূল্যে পছন্দের পোশাক কিনতে প্রায়ই এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে থাকেন মার্কিন ভোক্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্যাপ। খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওল্ড নেভি, ব্যানানা রিপাবলিক ও অ্যাথলেটাও পরিচালনা করে থাকে গ্যাপ। বৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্যাপের ২১ শতাংশ পোশাকের উৎস ভিয়েতনাম। এ ছাড়া আরও ৩৭ শতাংশ পোশাক আসে ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ থেকে। এ বিশ্লেষণ ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের ফ্যাশন অ্যান্ড অ্যাপারেল স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক শেং লুর।
আবার এইচঅ্যান্ডএম সস্তা ফ্যাশনের জন্য সুপরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি অধিকাংশ পোশাক কিনে থাকে চীন ও বাংলাদেশ থেকে।
বুধবার এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন সতর্ক করে বলেছে, নতুন শুল্ক মার্কিন পরিবারগুলো, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর অযৌক্তিক বোঝা চাপাতে পারে।
ইতিমধ্যে ট্রাম্প বলেছেন, শুল্ক বোঝা এড়াতে ভিয়েতনাম মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তিতে আসতে কাজ করার জন্য তৈরি। অন্যদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে।
কফি ও আমদানি করা অন্যান্য খাদ্যপণ্য
যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা নিত্যদিন যে কফি পান করে থাকেন, তার প্রায় সম্পূর্ণটা আসে দেশটির বাইরে থেকে। এর অর্থ হলো, মার্কিনরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাসাবাড়িতে বা দোকানে গিয়ে কফি পান করতে গেলে এখন থেকে বড়সড় অর্থ তাঁদের গুনতে হতে পারে, যা তাঁদের মানিব্যাগে চাপ বাড়াবে।
কফির জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার ওপর নির্ভর করে। দেশ দুটির ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে নির্দিষ্ট কিছু কফির গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকারক দেশের একটি ভিয়েতনাম।
যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা নিত্যদিন যে কফি পান করে থাকেন, তার প্রায় সম্পূর্ণটা আসে দেশটির বাইরে থেকে। এর অর্থ হলো, মার্কিনরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাসাবাড়িতে বা দোকানে গিয়ে কফি পান করতে গেলে এখন থেকে বড়সড় অর্থ গুনতে হতে পারে, যা তাঁদের মানিব্যাগে চাপ বাড়াবে।সান ফ্রান্সিসকো–ভিত্তিক কফি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্রাফিউর স্বত্বাধিকারী ওয়াল্টার হ্যাস ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, যেদিন শুল্ক কার্যকর হবে, আক্ষরিকভাবে পরদিন থেকেই তাঁর প্রতিষ্ঠানকে এর ধাক্কা সামলাতে হবে। বাড়তি শুল্ক বহাল থাকলে কফির দাম বাড়বে এবং ভোক্তাদের তা পরিশোধ করতে হবে।
একই রকম পরিণতি বরণ করতে হতে পারে অলিভ অয়েলসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য আমদানিকারক মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এসব পণ্য ইতালি, স্পেন, গ্রিসসহ বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো থেকে এসে থাকে। ইইউর পণ্যে ট্রাম্প ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
জুতা-অ্যাডিডাস থেকে নাইক
যুক্তরাষ্ট্রবাসীর নিত্যদিনের ব্যবহার্য পণ্যের একটি জুতা। জনপ্রিয় ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস থেকে শুরু করে নাইকের জুতা কিনতে সামনের দিনগুলোতে তাঁদের বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। দুটি প্রতিষ্ঠানই তাদের বিক্রি করা পণ্যের জন্য এশীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে। নাইকের জুতার প্রায় অর্ধেক ও অ্যাডিডাসের ৩৯ শতাংশ তৈরি হয় ভিয়েতনামে।
অধ্যাপক লুর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি জুতা আমদানি করেছে; এর অধিকাংশ এসেছে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে। এ পণ্যের ওপর এত দিন শুল্ক ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। তা এখন প্রায় তিন গুণ বাড়তে পারে।
অ্যালকোহল, ইউরোপীয় ওয়াইন ও বিয়ার
যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াইন সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস দেশগুলোর একটি ফ্রান্স। ইইউর ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করায় ওয়াইন আমদানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো।
দ্য বোরগোগন ওয়াইন বোর্ড বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ওয়াইন রপ্তানিকারক ও ভোক্তা উভয়ের জন্যই ‘এক গুরুতর ধাক্কা’।
ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তে পারে অ্যালকোহল ও বিয়ারের দামও।
আরও পড়ুনট্রাম্পের প্রতিশোধমূলক শুল্ক থেকে বাংলাদেশ যেভাবে লাভবান হতে পারে২২ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক আরোপে বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে যে দেশ২০ ঘণ্টা আগেইউবিএসের বিশ্লেষকেরা রয়টার্সকে বলেছেন, শুল্কের ধাক্কা সামলাতে অ্যালকোহলের বড় বিক্রেতারা তাঁদের পণ্যের দাম ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারেন।
এদিকে আইফোন, মুঠোফোন, টেলিভিশন, ভিডিও গেমিং উপকরণসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের দামও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তে পারে বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা। যুক্তরাষ্ট্রে এসব পণ্যের বড় রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া।
আরও পড়ুনচীনের পাল্টা শুল্ক আরোপ, সতর্ক করলেন ট্রাম্প ৯ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের তালিকায় রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার নাম নেই কেন০৩ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প ক ম র ক নদ র নত ন শ ল ক সব দ শ প ন কর র জন য আমদ ন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
বাগ্দানে হীরার আংটির প্রচলন কীভাবে হলো, এটি কেন এত দামি
ছেলেরা বাগ্দানের জন্য একটি হীরার আংটি কিনতে দশকের পর দশক ধরে বেশ অর্থ ব্যয় করেন। সামাজিক এ মানদণ্ড বা হীরার এই বিশেষ মর্যাদা, এটা কিন্তু হঠাৎ করেই হয়নি।
বরং এ গল্পের শুরু সেই ১৮৭০ সালে। ওই বছর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে নিজের ভাগ্য পরীক্ষার জন্য সিসিল রোডস রওনা দেন কেপ কলোনিতে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকার সময় বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার নাম ছিল কেপ কলোনি।
কেপ কলোনিতে তখন খনি থেকে হীরা উত্তোলন ব্যবসা সবে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করেছে। রোডস সেখানে গিয়ে হীরার খনির মালিকদের কাছে পানি সেচার পাম্প ভাড়া দেওয়া শুরু করেন। হীরা অনুসন্ধানের সময় খনি যাতে প্লাবিত না হয়, সে জন্য খনির ভেতর থেকে পাম্প দিয়ে পানি সেচা হয়।
পরবর্তী ২০ বছরে রোডস ও তাঁর সহযোগী চার্লস রাড শত শত, পরে হাজার হাজার ছোট ছোট খনি ও ‘ক্লেইম’ কেনা বা অধিগ্রহণ করতে শুরু করেন। ‘ক্লেইম’ বলতে ওই জমিকে বোঝানো হয়, যেখানে হীরা পাওয়া যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়। খনির মালিকেরা যখন দেউলিয়া হওয়ার মুখে পড়তেন, তখন অনেকটা নামমাত্র মূল্যে খনি বিক্রি করে দিতেন।
সেখানে অধিকাংশ খনি ছোট ছোট মালিকানায় ছিল। তাঁদের হাতে তেমন অর্থ থাকত না। অন্যদিকে রোডস ও রাডের হাতে বড় অঙ্কের পুঁজির জোগান ছিল। বিশেষ করে লন্ডনে তাঁদের যোগাযোগ থাকার সুবাদে রথসচাইল্ড ব্যাংকিং সাম্রাজ্যের সহায়তা তাঁরা পেতেন।
রোডস ও রাড তাঁদের কেনা জমিগুলো একত্র করে বড় খনিতে রূপান্তর করতে থাকেন। এতে খরচ কমে যায় এবং হীরা উত্তোলন কার্যক্রম আরও লাভজনক হয়ে ওঠে।
রোডস ও রাড তাঁদের কেনা জমিগুলো একত্র করে বড় খনিতে রূপান্তর করতে থাকেন। এতে খরচ কমে যায় এবং হীরা উত্তোলন কার্যক্রম আরও লাভজনক হয়ে ওঠে।দুজন ‘ডি বিয়ার্স কনসোলিডেটেড মাইনস’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করেন। ডি বিয়ার্স নামটি এসেছিল তাঁদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া একটি খনির নাম থেকে।
১৮৮৮ সালের মধ্যে কোম্পানিটি দক্ষিণ আফ্রিকার হীরার খনি ও ক্লেইমগুলোতে প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেয়।
১৯০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মোট রপ্তানি আয়ের ২৫ শতাংশের বেশি আসত হীরা রপ্তানি থেকে। সে সময় ডি বিয়ার্স দেশটির অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়। কোম্পানিটি তখন বিশ্বে হীরার মোট সরবরাহের প্রায় ৯০ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ করত।
রোডস নিজেই সে সময় একজন উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্যবাদী নেতায় পরিণত হন। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি কেপ কলোনির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ডি বিয়ার্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী নীতির ওপর ভর করে। দেশটিতে সে সময়ে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুদের শাসন জারি ছিল।
নামমাত্র মজুরিতে হীরার খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন কৃষ্ণাঙ্গরা। আর ডি বিয়ার্সের শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় বিনিয়োগকারীরা মুনাফা ভোগ করতেন।
১৯০২ সালে রোডসের মৃত্যুর পর ডি বিয়ার্সের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জার্মান বংশোদ্ভূত উদ্যোক্তা আর্নেস্ট ওপেনহেইমারের হাতে।
ওপেনহেইমার আর্থিক প্রণোদনা, কৌশলগত চাপ ও কূটনীতির সমন্বয় ব্যবহার করে অন্যান্য দেশের হীরা সরবরাহকারীদের শুধু লন্ডনভিত্তিক ডি বিয়ার্সের মালিকানাধীন সেন্ট্রাল সেলিং অর্গানাইজেশনের (সিএসও) মাধ্যমে হীরা বিক্রয় করতে রাজি করান।
ডি বিয়ার্সের প্রচারণার জোরে যুক্তরাষ্ট্রে বিয়ের কনেদের হীরার আংটি পরার প্রবণতা ১৯৪০ সালে ১০ শতাংশ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশে পৌঁছে যায়। জাপানে এই সংখ্যা ১৯৬০ সালে ৫ শতাংশের কম ছিল, ১৯৮১ সালে তা বেড়ে ৬০ শতাংশে পৌঁছে।১৯৩০–এর দশকে সিএসও কাটা হয়নি, এমন হীরা বিক্রির একক চ্যানেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফলে ডি বিয়ার্স হীরার বিশাল মজুত গড়ে তুলতে সক্ষম হয় এবং বিশ্ব বাজারে হীরা সরবরাহের ওপর প্রায় একক ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠানটি। এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তারা বিশ্বব্যাপী হীরার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে।
হীরার ঘাটতি নিয়ে বিভ্রম তৈরির পাশাপাশি ডি বিয়ার্স এই রত্নের প্রতি বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির চেষ্টা করে যেতে থাকে। ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি ফিলাডেলফিয়াভিত্তিক বিজ্ঞাপন সংস্থা এনডব্লিউ আয়ারকে এ কাজে নিয়োগ দেয়।
এক বছর পর হীরা নিয়ে প্রায় কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া স্লোগানটি চালু হয়। সেটি হলো, ‘আ ডায়মন্ড ইজ ফরএভার’ (হীরা চিরস্থায়ী)।
ব্যাপক বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্রে প্রদর্শন ও তারকাদের ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি হীরাকে বিশেষ করে হিরার বাগ্দানের আংটিকে ‘চিরস্থায়ী ভালোবাসার’ প্রতীক হিসেবে নতুনভাবে উপস্থাপন করে। যেমন তারা বড় অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার জন্য তারকাদের হীরার গয়না ধার দিত। এই প্রচার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানের হীরার বাজারকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়।
১৯৯০–এর দশকের শেষ দিকে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আরও বড় অভিযোগ ওঠে। ওইসব অভিযোগে বলা হয়, হীরা বাণিজ্যের মাধ্যমে অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরা লিওন ও কঙ্গোয় রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের অর্থায়ন হচ্ছে, যা হীরার ওপর ভোক্তাদের মনোভাব আরও খারাপ করে তোলে।২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬৪ বছর ধরে চলা এই বিজ্ঞাপন বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। ‘অ্যাড এজ’ সাময়িকী ‘আ ডায়মন্ড ইজ ফরএভার’–কে ২০ শতকের সেরা বিজ্ঞাপনী স্লোগান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ডি বিয়ার্স এমন একটি সামাজিক মানদণ্ড তৈরি করেছিল, যেখানে বিয়ে বা বাগ্দানে হীরার আংটি প্রতিটি আধুনিক সমাজব্যবস্থায় প্রায় অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে।
অথচ ডি বিয়ার্সের এই প্রচারের আগে, একজন প্রেমিক তাঁর ভবিষ্যৎ কনের জন্য লকেট, মুক্তার মালা বা পারিবারিক ঐতিহ্যবাহী গয়না দিতেন।
ডি বিয়ার্সের প্রচারের জোরে যুক্তরাষ্ট্রে বিয়ের কনেদের হীরার আংটি পরার প্রবণতা ১৯৪০ সালে ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশে পৌঁছে যায়। জাপানে এই সংখ্যা ১৯৬০ সালে ৫ শতাংশের কম ছিল, ১৯৮১ সালে তা বেড়ে ৬০ শতাংশে পৌঁছে।
১৯৫০–এর দশকের শুরুতে একটি হীরার আংটির দাম সাধারণত ১৭০ ডলারের মতো ছিল। ডলারের বর্তমান মূল্য হিসাবে যা প্রায় ২ হাজার ৩০০ ডলারের মতো।
গবেষণাগারে উৎপাদিত হীরা ও হীরার মতো দেখতে অন্যান্য অনেক সস্তা পাথরে এখন বাজার সয়লাব। সেসব পাথর দেখতে এতটাই হীরার মতো যে জহুরির চোখ দিয়ে বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে কেবল সেগুলোর পার্থক্য ধরা সম্ভব।শুরুতে ডি বিয়ার্সের বিজ্ঞাপনগুলোতে বাগ্দানের আংটির জন্য এক মাসের বেতন খরচ করার পরামর্শ দিত। কিন্তু ১৯৮০–এর দশকে তারা নতুন স্লোগান তোলে। বিজ্ঞাপনে ভোক্তাদের দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলা হতে থাকে, কীভাবে আপনি দুই মাসের বেতন চিরকাল স্থায়ী করতে পারেন।
অথচ হীরা আবার বিক্রি করতে গেলে তার দাম অর্ধেক হয়ে যায়। সেখানে সোনার বেলায় পুরো উল্টো ঘটনা ঘটে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ডি বিয়ার্সের একটি হীরার খনি। ৩ মে, ২০১৭