ট্রাম্পের শুল্ক আরোপে কোন কোন পণ্যে পকেট কাটা যাবে মার্কিনদের
Published: 5th, April 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’ এনে দিতে বিশ্বজুড়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে শুল্কের খড়্গ চাপিয়েছেন, তার ধাক্কা সামলাতে হবে মার্কিনদেরও। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যেসব দেশ থেকে নিয়মিত পণ্য কিনে থাকে, সেসব দেশের প্রায় সবাই দেশটিতে রপ্তানি করা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে পোশাক থেকে শুরু করে কফি—সবকিছুতেই বাড়তি অর্থ গুনতে হবে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে।
গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দেশটিতে প্রবেশ করা শত শত কোটি ডলারের পণ্যে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। যেসব দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘সবচেয়ে খারাপ’ বলে বিবেচনা করেছেন, সেসব দেশের ওপর তিনি চাপিয়েছেন ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের বোঝা। আজ ৫ এপ্রিল থেকে কার্যকর হচ্ছে তাঁর ওই ঘোষণা।
অর্থনীতিবিদেরা ট্রাম্পের এ নতুন শুল্ক ঘোষণা ও এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা পণ্যের ওপর কোনো কোনো দেশের বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘটনায় সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন। পাল্টাপাল্টি এমন শুল্কারোপে বিশ্বজুড়ে মার্কিনদের জন্য তৈরি করা পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এটি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরম পাওয়েল।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার জেরে বিদেশি পণ্যের মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্কের বোঝা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে বা পণ্যের আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে।অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার জেরে বিদেশি পণ্যের মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্কের বোঝা ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে বা পণ্যের আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। এতে যেসব নিত্যপণ্যে মার্কিনদের বাড়তি অর্থ গুনতে হতে পারে, সেসবের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—
পোশাক
পোশাকের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের বাড়তি শুল্কের ধাক্কা লাগবে ভিয়েতনাম, চীন ও বাংলাদেশের মতো পোশাক রপ্তানিকারক দেশের ওপর। যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে, সে তালিকায় প্রথম পাঁচটির তিনটিই হলো এই তিন দেশ। তাদের পণ্যের ওপর ৩৪ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প।
পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপে বিশ্বজুড়ে মার্কিনদের জন্য তৈরি করা পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। এটি মূল্যস্ফীতি বাড়াবে।জেরম পাওয়েল, ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যানপোশাক রপ্তানিকারক এই তিন দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করার অর্থ হলো, টার্গেট ও ওয়ালমার্টের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোরগুলোসহ পোশাক খাতের পরিচিত আরও কিছু ব্র্যান্ড আর্থিকভাবে চাপ অনুভব করতে পারে। সুলভ মূল্যে পছন্দের পোশাক কিনতে প্রায়ই এসব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে থাকেন মার্কিন ভোক্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের নামকরা খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্যাপ। খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওল্ড নেভি, ব্যানানা রিপাবলিক ও অ্যাথলেটাও পরিচালনা করে থাকে গ্যাপ। বৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্যাপের ২১ শতাংশ পোশাকের উৎস ভিয়েতনাম। এ ছাড়া আরও ৩৭ শতাংশ পোশাক আসে ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ থেকে। এ বিশ্লেষণ ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের ফ্যাশন অ্যান্ড অ্যাপারেল স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক শেং লুর।
আবার এইচঅ্যান্ডএম সস্তা ফ্যাশনের জন্য সুপরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি অধিকাংশ পোশাক কিনে থাকে চীন ও বাংলাদেশ থেকে।
বুধবার এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন সতর্ক করে বলেছে, নতুন শুল্ক মার্কিন পরিবারগুলো, বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর অযৌক্তিক বোঝা চাপাতে পারে।
ইতিমধ্যে ট্রাম্প বলেছেন, শুল্ক বোঝা এড়াতে ভিয়েতনাম মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তিতে আসতে কাজ করার জন্য তৈরি। অন্যদিকে চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে।
কফি ও আমদানি করা অন্যান্য খাদ্যপণ্য
যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা নিত্যদিন যে কফি পান করে থাকেন, তার প্রায় সম্পূর্ণটা আসে দেশটির বাইরে থেকে। এর অর্থ হলো, মার্কিনরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাসাবাড়িতে বা দোকানে গিয়ে কফি পান করতে গেলে এখন থেকে বড়সড় অর্থ তাঁদের গুনতে হতে পারে, যা তাঁদের মানিব্যাগে চাপ বাড়াবে।
কফির জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার ওপর নির্ভর করে। দেশ দুটির ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে নির্দিষ্ট কিছু কফির গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিকারক দেশের একটি ভিয়েতনাম।
যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা নিত্যদিন যে কফি পান করে থাকেন, তার প্রায় সম্পূর্ণটা আসে দেশটির বাইরে থেকে। এর অর্থ হলো, মার্কিনরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাসাবাড়িতে বা দোকানে গিয়ে কফি পান করতে গেলে এখন থেকে বড়সড় অর্থ গুনতে হতে পারে, যা তাঁদের মানিব্যাগে চাপ বাড়াবে।সান ফ্রান্সিসকো–ভিত্তিক কফি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান গ্রাফিউর স্বত্বাধিকারী ওয়াল্টার হ্যাস ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, যেদিন শুল্ক কার্যকর হবে, আক্ষরিকভাবে পরদিন থেকেই তাঁর প্রতিষ্ঠানকে এর ধাক্কা সামলাতে হবে। বাড়তি শুল্ক বহাল থাকলে কফির দাম বাড়বে এবং ভোক্তাদের তা পরিশোধ করতে হবে।
একই রকম পরিণতি বরণ করতে হতে পারে অলিভ অয়েলসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্য আমদানিকারক মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এসব পণ্য ইতালি, স্পেন, গ্রিসসহ বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো থেকে এসে থাকে। ইইউর পণ্যে ট্রাম্প ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
জুতা-অ্যাডিডাস থেকে নাইক
যুক্তরাষ্ট্রবাসীর নিত্যদিনের ব্যবহার্য পণ্যের একটি জুতা। জনপ্রিয় ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস থেকে শুরু করে নাইকের জুতা কিনতে সামনের দিনগুলোতে তাঁদের বাড়তি অর্থ খরচ করতে হবে। দুটি প্রতিষ্ঠানই তাদের বিক্রি করা পণ্যের জন্য এশীয় দেশগুলোর ওপর নির্ভর করে। নাইকের জুতার প্রায় অর্ধেক ও অ্যাডিডাসের ৩৯ শতাংশ তৈরি হয় ভিয়েতনামে।
অধ্যাপক লুর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি জুতা আমদানি করেছে; এর অধিকাংশ এসেছে চীন ও ভিয়েতনাম থেকে। এ পণ্যের ওপর এত দিন শুল্ক ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। তা এখন প্রায় তিন গুণ বাড়তে পারে।
অ্যালকোহল, ইউরোপীয় ওয়াইন ও বিয়ার
যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াইন সরবরাহের সবচেয়ে বড় উৎস দেশগুলোর একটি ফ্রান্স। ইইউর ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক ধার্য করায় ওয়াইন আমদানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্ট মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো।
দ্য বোরগোগন ওয়াইন বোর্ড বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ওয়াইন রপ্তানিকারক ও ভোক্তা উভয়ের জন্যই ‘এক গুরুতর ধাক্কা’।
ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তে পারে অ্যালকোহল ও বিয়ারের দামও।
আরও পড়ুনট্রাম্পের প্রতিশোধমূলক শুল্ক থেকে বাংলাদেশ যেভাবে লাভবান হতে পারে২২ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনট্রাম্পের উচ্চ শুল্ক আরোপে বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে যে দেশ২০ ঘণ্টা আগেইউবিএসের বিশ্লেষকেরা রয়টার্সকে বলেছেন, শুল্কের ধাক্কা সামলাতে অ্যালকোহলের বড় বিক্রেতারা তাঁদের পণ্যের দাম ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারেন।
এদিকে আইফোন, মুঠোফোন, টেলিভিশন, ভিডিও গেমিং উপকরণসহ অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের দামও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তে পারে বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদেরা। যুক্তরাষ্ট্রে এসব পণ্যের বড় রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া।
আরও পড়ুনচীনের পাল্টা শুল্ক আরোপ, সতর্ক করলেন ট্রাম্প ৯ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুনট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের তালিকায় রাশিয়া, উত্তর কোরিয়ার নাম নেই কেন০৩ এপ্রিল ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প ক ম র ক নদ র নত ন শ ল ক সব দ শ প ন কর র জন য আমদ ন র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালে বিশ্ববাজারে জিনিসপত্রের দাম আরও ৭% কমতে পারে, বাংলাদেশে কেন কমছে না
চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরে সামগ্রিকভাবে পণ্যমূল্য ৭ শতাংশ কমবে। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৬ সালে পণ্যমূল্য আরও ৭ শতাংশ কমবে। এ দাম হবে ছয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব নেই। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখনো ৮ শতাংশের ঘরে। যদিও একসময় তা দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ হয়েছে। দেশের মানুষকে এখনো বাড়তি দামেই পণ্য ও সেবা কিনতে হচ্ছে। আগামী বছর নিত্যপণ্যের দাম কমবে কি না, সেই নিশ্চয়তাও নেই। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশে এর প্রভাব কম।
বিশ্বব্যাংকের ‘কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যার মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে জ্বালানির দাম কমে যাওয়া। সেই সঙ্গে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে তারা। সেগুলো হলো চীনে তেলের চাহিদা বৃদ্ধির গতি কমে যাওয়া এবং বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় তেলের দামে বড় ধরনের পতন ঘটা। খাদ্যপণ্যের দাম বছরের শুরু থেকে ধীরে ধীরে কমতে থাকে, কিন্তু বছরের প্রথমার্ধে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে পানীয় পণ্যের দাম হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। মূলত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে মানুষ সোনার দিকে ছুটেছেন।
বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য নির্ধারণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে জ্বালানি তেলের দাম। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জ্বালানির দাম আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে আরও ১০ শতাংশ কমবে। ২০২৭ সালে তা আবার প্রায় ৬ শতাংশ বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ২০২৬ সালে কৃষিপণ্য, খাদ্য ও কাঁচামালের দাম কমবে। চলতি বছরেও এসব পণ্যের দাম কমেছে।
জ্বালানি তেলবিশ্বব্যাংকের ২০২৬ সালের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা বাড়ায় গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়লেও তেলের দাম কমে যাবে এবং সেই প্রভাবকে ছাপিয়ে যাবে। ২০২৫ সালে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের দাম হতে পারে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬৮ ডলার; ২০২৪ সালের ৮১ ডলারের তুলনায় যা বেশ কম। ২০২৬ সালে এই দাম আরও কমে ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৬০ ডলারে নামতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।
এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির হার আরও কমবে—মূলত চীনের চাহিদা কমে যাওয়া, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির দ্রুত প্রসার ও বৈশ্বিক তেল সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।
২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেলের বাজারে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২০ সালের সর্বোচ্চ মাত্রার তুলনায় প্রায় ৬৫ শতাংশ বেশি হবে এ সরবরাহ।
কৃষিপণ্যবিশ্বব্যাংক গ্রুপের পূর্বাভাস অনুযায়ী, কৃষিপণ্যের মূল্যসূচক ২০২৫ সালে স্থিতিশীল আছে। ২০২৬ সালে তা সামান্য ২ শতাংশ ও ২০২৭ সালে আরও ১ শতাংশ কমবে।
খাদ্যপণ্যের দাম, যেমন শস্য, তেল, প্রোটিনজাত খাবারসহ অন্যান্য খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক সীমার কাছাকাছি থাকবে। তবে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছুটা ওঠানামা থাকবে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, প্রধান ফসলগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধির হার আবার দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতায় ফিরে আসছে।
২০২৫ সালের বাকি সময়ে সয়াবিনের দাম কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে সয়াবিন সাধারণত চীনে রপ্তানি হয়, তা এবার কম দামে অন্য ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে হতে পারে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্রে হচ্ছে এই সয়াবিন। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সয়াবিন কিনছে না। ফলে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে এই পণ্যের দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্রে সয়াবিন চাষের পরিমাণ কিছুটা কমতে পারে, তবে ব্রাজিল তার সয়াবিন আবাদ আরও বাড়ানোর পথে রয়েছে। পানীয় পণ্যের দাম ২০২৬ সালে ৭ শতাংশ ও ২০২৭ সালে প্রায় ৫ শতাংশ কমবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এদিকে চলতি বছর সারের দাম সামগ্রিকভাবে ২১ শতাংশ বাড়তি। চাহিদা বৃদ্ধি, বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা ও কিছু অঞ্চলে সরবরাহ–ঘাটতির কারণে এ দাম বেড়ে যাওয়া। ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দাম প্রায় ৫ শতাংশ কমতে পারে। তবু ২০১৫-১৯ সালের গড় দামের তুলনায় তা অনেক বেশি থাকবে। এর কারণ হলো উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, রপ্তানি সীমাবদ্ধতা ও চলমান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।
চীন ইতিমধ্যে নাইট্রোজেন ও ফসফেট সার রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। অন্যদিকে পটাশ সরবরাহকারী বড় দেশ বেলারুশ এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে। রাশিয়া ও বেলারুশ—উভয় দেশই সারের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত নতুন শুল্কের সম্মুখীন।
দেশে কেন দাম বেশিবিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশের বাজার দাম না কমার অন্যতম প্রধান কারণ ডলারের দামের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। গত তিন বছরে ডলার দাম অনেকটা বেড়েছে। সেই সঙ্গে দেশের অনেক আমদানি পণ্যে শুল্ক বেশি বলে মনে করেন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে দাম কমছে না। বাজারে চাহিদা কত বা কখন কোন পণ্য আমদানি করতে হবে, সে বিষয়ে যথাযথ তথ্যের ঘাটতি আছে। ফলে সময়মতো পণ্য আমদানি হয় না।
আরেকটি বিষয় হলো দেশে যেসব পণ্য আমদানি করা হয়, তার অনেক কিছু উৎপাদিতও হয়। কিন্তু বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় এসব পণ্যের সরবরাহে টান পড়েছে। বাজারের পণ্যমূল্যে তার প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন মোস্তাফিজুর রহমান।
তিন বছর আগে দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন তা বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক মাস ধরে আমদানির ঋণপত্র খোলাও কমেছে। এতে আমসদানিতে চাপ পড়ছে।
দেশের বাজার উচ্চ মূল্যের কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সেলিম রায়হান বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয়, শুল্ক ও করের চাপ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতার কারণে দাম কমছে না। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত অতি মুনাফা ও অস্বচ্ছ বাণিজ্যিক শৃঙ্খলের কারণেও বাজারে কৃত্রিমভাবে উচ্চমূল্য বিরাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে টাকার অবমূল্যায়ন। ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে এবং আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাসের সুফল ভোক্তাপর্যায়ে পড়ছে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীরা নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দেশে তিন বছর ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। সম্প্রতি তা কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত আগস্ট মাসে এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।