ইসরায়েলি আগ্রাসনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা। খাদ্য, চিকিৎসাসহ সব পরিষেবা বন্ধ করে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। পৃথিবীর দেশে দেশে মানবিক মানুষেরা সেই গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন। এবার এই গণহত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সরব হয়েছেন বাংলাদেশের মানুষও। গতকাল শনিবার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আয়োজিত ‘মার্চ ফর গাজা’ সমাবেশে ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরোচিত গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন লাখো মানুষ।
‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট’-এর ডাকে আয়োজিত এ গণজমায়েতে অংশ নিতে ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, আলেম-ওলামাসহ সর্বস্তরের মানুষ। গতকাল সকাল থেকে ট্রেনের ছাদে, বাসে, ট্রাকে ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকেন হাজার হাজার মানুষ। ঢাকার নানা প্রান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এসেছেন অসংখ্য মানুষ। খণ্ড খণ্ড মিছিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জমায়েত হয়ে জনসমুদ্র তৈরি করে।
বেলা তিনটায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুর ১২টার মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। লাখো মানুষ সড়কে নেমে এলে রাজধানীর মূল সড়কগুলোতে যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। অনেকে বাস থেকে নেমে মিছিলের স্রোতে মিশে যান। হাতে হাতে ছিল ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফিলিস্তিনের পতাকা। অনেকের পরনে ছিলে গণহত্যা বন্ধের আহ্বান-সংবলিত টি-শার্ট।
‘ফিলিস্তিনে হামলা কেন, জাতিসংঘ জবাব চাই’, ‘তুমি কে আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’, ‘ফ্রি ফ্রি ফিলিস্তিন’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহবাগসহ অনেক এলাকা। ‘সেভ গাজা, সেভ হিউম্যানিটি’, ‘টু স্ট্যান্ড উইথ প্যালেস্টাইন ইজ টু স্ট্যান্ড উইথ হিউম্যানিটি’, ‘স্টপ জেনোসাইড ইন গাজা’, ‘স্টপ জায়োনিস্ট টেরর’—এ ধরনের লেখাসংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন সমাবেশে যোগ দেওয়া অনেকেই। স্বেচ্ছাসেবীরা নিজ উদ্যোগে মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পানি ও জুস বিতরণ করেন।
দুপুর ১২টার পর সমাবেশস্থলে প্রবেশ করতে না পেরে হাজার হাজার মানুষ শাহবাগ, হাইকোর্ট, টিএসসি, মৎস্য ভবন মোড়সহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারপাশে অবস্থান নেন।
‘গণহত্যা বন্ধে বিশ্বকে বার্তা দিতে এসেছি’মার্চ ফর গাজার গণজমায়েতে অংশ নিতে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে এসেছেন কলেজশিক্ষার্থী শাখাওয়াত হোসেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন টিভি পর্দায় এ নৃশংসতা দেখলে খুব অসহায় লাগে। ইসরায়েলকে কি কেউ থামাতে পারবে না! আমরা চাই মুসলিম উম্মাহ এ গণহত্যা বন্ধ করুক। এখান থেকে আমরা বিশ্বকে একটা বার্তা দিতে চাই।’
ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মো.
ছিন্নভিন্ন এক শিশুর প্রতিকৃতি নিয়ে মিরপুর-২ থেকে সমাবেশে এসেছেন ফজিলাতুন নেসা বৃষ্টি। তিনি বলেন, ইসরায়েল ১৭ হাজার ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা করেছে। পুরো পৃথিবী দেখছে। কেউ ইসরায়েলকে থামাচ্ছে না। মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় শত্রু এই ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান নিয়ে তিনি সমাবেশে এসেছেন।
কী বললেন বক্তারাপবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও গাজায় গণহত্যার ওপর তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে মার্চ ফর গাজা সমাবেশ শুরু হয় বেলা সোয়া তিনটার দিকে। সমাবেশ শুরুর আগে মঞ্চে প্রথম আসেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। একে একে উপস্থিতি হন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ, আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিসের নেতারা।
একপর্যায়ে মঞ্চে এসে সবাইকে শৃঙ্খলা মেনে সমাবেশ সফল করার আহ্বান জানান ইসলামি বক্তা মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী। তিনি বলেন, ‘আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্র ফিলিস্তিনের প্রতি, আল-আকসার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ভৌগোলিকভাবে আমরা ফিলিস্তিন থেকে অনেক দূরের হতে পারি, কিন্তু আজকের এ সমাবেশ প্রমাণ করে আমাদের একেকজনের বুকের ভেতরে বাস করে ফিলিস্তিন।’
সমাবেশে বক্তব্য দেন ইসলামি বক্তা শায়খ আহমাদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমাদের মত, পথ ভিন্ন হলেও আজকে আমরা প্রমাণ করেছি, ফিলিস্তিনের ন্যায্য দাবিতে আমরা সবাই এক।’
ঘোষণাপত্র পাঠসমাবেশের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। ঘোষণাপত্রে আন্তর্জাতিক আদালতে ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার, ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, আন্তর্জাতিক আদালতে জায়নবাদী ইসরায়েলের গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধবিরতি নয়, অবিলম্বে গণহত্যা বন্ধে জাতিসংঘসহ মুসলিম বিশ্বকে দায়িত্ব নিতে হবে। পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি মজলুম গাজাবাসীর পাশে খাদ্য, চিকিৎসা ও প্রতিরক্ষা সহায়তা নিয়ে দাঁড়ানো, বাংলাদেশের পাসপোর্টে ‘এক্সেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দ ফিরিয়ে আনা, ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল ও ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানানো হয়। ঘোষণাপত্রে পাঠ্যবই ও শিক্ষানীতিতে আল-আকসা, ফিলিস্তিন এবং মুসলিমদের সংগ্রামী ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানানো হয়েছে।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনের অধীনে মুসলিমদের অধিকার হরণ, বিশেষ করে ওয়াক্ফ আইন সংশোধনের মতো রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওআইসি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে দৃঢ় প্রতিবাদ ও কার্যকর কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে বলেও ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল মালেকের মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণহত য র ব ইসর য় ল এস ছ ন ইসল ম র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত
ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স।
গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’
পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।
আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।
সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’
তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।
রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।
ঢাকা/ফিরোজ