দিনাজপুরে চাল সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ না হওয়ায় ৩১৬ মিলের নিবন্ধন বাতিল
Published: 18th, April 2025 GMT
দিনাজপুরে সদ্য শেষ হওয়া আমন মৌসুমে সরকারি খাদ্যগুদামে চাল সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ না হওয়ায় ৩১৬টি মিলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে গত মঙ্গলবার এ তথ্য জানানো হয়েছে। তবে কয়েকজন মিলমালিক বলছেন, মৌসুমের শুরু থেকে বাজারে ধান-চালের দাম বেশি থাকায় লোকসানের ভয়ে সরকারের সঙ্গে চাল সরবরাহে চুক্তি করেননি অনেকেই।
জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আপত্কালীন মজুত গড়তে গত বছরের ১৭ নভেম্বর শুরু হয় আমন সংগ্রহ অভিযান। সেদ্ধ চাল ও ধান সংগ্রহের সময়সীমা ছিল গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং আতপ চাল সংগ্রহের সময় ধরা হয়েছিল ১৫ মার্চ পর্যন্ত। যেখানে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৭ হাজার ৭৯১ মেট্রিক টন। আর সেদ্ধ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫২ হাজার ৮৭২ দশমিক ৮১০ মেট্রিক টন এবং আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ হাজার ৮০৫ দশমিক ৯৪০ মেট্রিক টন। মৌসুমে ধান-চাল সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল ৯১১টি সেদ্ধ চালকল এবং ৮৩টি আতপ চালকল। মৌসুম শেষে এসব চুক্তিবদ্ধ মিল থেকে সংগ্রহ সম্পন্ন হয়েছে ৪৮ হাজার ৭২৪ দশমিক ০৪০ মেট্রিক টন; যা লক্ষ্যমাত্রার ৯৮ শতাংশ। আতপ চাল সংগ্রহ হয়েছে ১১ হাজার ৩০৬ দশমিক ৪৬০ মেট্রিক টন; যা লক্ষ্যমাত্রার ৯৬ শতাংশ এবং ধান সংগ্রহ হয়েছে ২ হাজার ২৫৮ মেট্রিক টন; যা লক্ষ্যমাত্রার ১৩ শতাংশ।
কয়েকজন মিলমালিক বলেন, বাজারে ধানের দাম বেশি ছিল। অন্যদিকে চাল উৎপাদনেও খরচ বেশি পড়েছে। কয়েক বছর থেকে মিলাররা লোকসান দিয়ে চাল সরবরাহ করে আসছেন। সরকার যে দর দিয়েছে, তাতে প্রতি কেজিতে তাঁদের লোকসান গুনতে হয় ৫ থেকে ৬ টাকা। লোকসান গুনতে গুনতে অনেক মিলমালিকেরই পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
মিলমালিকের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে বাংলাদেশ মেজর ও অটো মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহসভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ধান এবং চালের দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। মিলমালিকেরা তো লোকসান গুনেই আসছেন। সরকারের উচিত ধান-চালের দামে সামঞ্জস্য রেখে সরবরাহের ক্ষেত্রে কৃষক ও সব মিলমালিককে বাধ্য করা। নিবন্ধন বাতিল করে যদি পরবর্তী সময়ে আবার বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ নানা হয়রানি করা হয়, সেটি সমীচীন হবে না।
জেলা খাদ্যনিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী বলেন, জেলায় চুক্তিযোগ্য সেদ্ধ চালকলের সংখ্যা ১ হাজার ২১০ এবং আতপ চালকল মিলের সংখ্যা ১০। এবার চুক্তিকৃত সেদ্ধ চালকল মিলের সংখ্যা ৯১১ এবং আতপ চালকল ৮৩। একাধিকবার তাগাদা দিয়েও অনেকে চুক্তিবদ্ধ হননি। এসব মিলের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত খাদ্য বিভাগের এই সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ল সরবর হ ম ট র ক টন আতপ চ ল দশম ক চ লকল সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৭৭ মেট্রিক টন চাল তুলে নিয়েছেন ডিলার, উপকারভোগীরা জানেন ‘বরাদ্দ হয়নি’
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলায় গত জুলাই মাসে ট্রেডিং করপোরেশন বাংলাদেশের (টিসিবি) উপকারভোগীদের জন্য ৭৭ দশমিক ৮ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছিল। প্রক্রিয়া অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে এ চাল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির (ওএমএস) একজন ডিলার (পরিবেশক) তুলেও নেন। তবে ওই মাসে টিসিবির অন্য পণ্য পেলেও চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছেন উপকারভোগীরা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, মহম্মদপুরের ৮ ইউনিয়নে টিসিবির উপকারভোগী কার্ডধারী আছেন ১৫ হাজার ৫৬৭ জন। এসব উপকারভোগী নিজেদের কার্ড দেখিয়ে প্রতি মাসে একবার ইউনিয়নের টিসিবির নিয়োগ করা ডিলারের কাছ থেকে বাজারের চেয়ে কম মূল্যে তেল, চিনি, ডাল ও চাল কিনতে পারেন। গত জুলাইয়ে ডিলারদের কাছ থেকে তেল, চিনি ও ডালের একটি প্যাকেজ কিনতে পেরেছেন তাঁরা। ওই মাসে চালের বরাদ্দ আসেনি বলে জানানো হয় কার্ডধারীদের।
মহম্মদপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে পাওয়া নথিতে দেখা গেছে, গত ৩০ জুলাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. মজনুর রহমান স্বাক্ষরিত দুইটি বিলি আদেশে (ডিও) উপজেলার হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে একজন ওএমএস ডিলারের অনুকূলে ৭৭ দশমিক ৮৩৫ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ওই দিনই মহম্মদপুর ও বিনোদপুর খাদ্যগুদাম থেকে এ চাল তুলেও নেওয়া হয়।
সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।শরিফা, টিসিবির কার্ডধারী, রাজাপুর ইউনিয়নটিসিবি ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন টিসিবি উপকারভোগীদের চাল ছাড়া অন্য পণ্য সরাসরি তাঁদের নিয়োগ করা ডিলারদের কাছে সরবরাহ করে। চালের বরাদ্দ দেওয়া হয় খাদ্য বিভাগ থেকে। এ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে প্রথমে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ করা ওএমএস বা খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলারদের অনুকূলে ২৬ টাকা কেজি দরে চাল বরাদ্দ দেয়। সেই চাল ওই ডিলারদের কাছ থেকে ২৮ টাকা কেজি দরে নেন টিসিবির ডিলাররা। এরপর তাঁরা ৩০ টাকা কেজি দরে ওই চাল উপকারভোগীদের কাছে বিক্রি করেন।
উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পারুল নামে টিসিবির এক উপকারভোগী ১ সেপ্টেম্বর জানান, আগস্ট মাসে চাল, ডাল, তেল ও চিনির প্যাকেজ পেলেও জুলাই মাসে তাঁদের চাল ছাড়া অন্য তিন ধরনের পণ্যের প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। জুলাই মাসে তাঁদের জানানো হয় চাল বরাদ্দ হয়নি।
বিষয়টি জানতে উপজেলার ৮ ইউনিয়নে টিসিবির নিয়োগ করা ৮ জন ডিলারের সঙ্গে কথা বলেছেন এই প্রতিবেদক। তাঁদের মধ্যে মহম্মদপুর সদর, নহাটা, পলাশবাড়ীয়া, বালিদিয়া, রাজাপুর ও বাবুখালী ইউনিয়নের ডিলার জানিয়েছেন, জুলাই মাসে তাঁদেরকে চাল দেওয়া হয়নি। নহাটা ও রাজাপুর ইউনিয়নের ডিলার মিলন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মিলন ঘোষ ৪ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘জুলাই মাসে আমাদের বলা হইছিল চাল বরাদ্দ নেই। এ কারণে চাল ছাড়া অন্য পণ্যগুলো বিক্রি করেছি। তবে অ্যাপে দেখাইছিল চাল। কিন্তু আমরা পাইনি।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পানঅবশ্য বিনোদপুর ও দীঘা ইউনিয়নের দুই ডিলার দাবি করেছেন তাঁরা অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে চালও কার্ডধারীদের কাছে বিক্রি করেছেন। তবে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১০ জন উপকারভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাঁরা কেউই চাল পাননি। এর মধ্যে বিনোদপুর বাজারের একজন ফল ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জুলাই মাসে ডিলার জানাইছিল চাল ফুরায় গেছে।’
হোসনিয়া কান্তা উপজেলার বিনোদপুর এলাকার ওএমএস ডিলার। গত ২৫ জুলাই লটারির মাধ্যমে তিনিসহ তিনজন উপজেলায় ওএমএস ডিলার হিসেবে নিয়োগ পান বলে খাদ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে হোসেনিয়া কান্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তাঁর মুঠোফোনে সোমবার যোগাযোগ করা হলে একজন ধরে জানান, ওই নম্বর হোসেনিয়া কান্তা ঋতু নামে কেউ ব্যবহার করেন না।
জানতে চাইলে টিসিবির ঝিনাইদহ ক্যাম্প অফিসের উপপরিচালক আকরাম হোসেন সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিসিবির চাল খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করা হয়। আর বিতরণ কার্যক্রম তদারকির জন্য প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। যেখানে প্রতি ইউনিয়নে একজন ট্যাগ অফিসার আছেন, যিনি এগুলো তদারকি করেন।’
জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৬ টাকা কেজি দরে কেনা এসব চাল বাজারে প্রায় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। উপকারভোগীদের কাছে তা ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করার কথা। এ হিসাবে উপকারভোগীদের ফাঁকি দিয়ে এ চাল বাজারে বিক্রি করতে পারলে কেজিতে ২২ থেকে ২৪ টাকা লাভ হয়।
চাল না পাওয়ার বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন মহম্মদপুরের ইউএনও শাহীনুর আক্তার। সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাল দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত এমন অভিযোগ কেউ দেয়নি। খাদ্য অফিস থেকে আমি যত দূর জানতে পেরেছি তাতে সবকিছু দেওয়া হয়ে গেছে। বরাদ্দ থাকলে তা আটকে রাখার সুযোগ নেই। তারপরও কোনো অভিযোগ থাকলে খতিয়ে দেখব।’
হঠাৎ এক মাসে চাল না পাওয়ায় বিপাকে পড়েন উপকারভোগীরা। রাজাপুর ইউনিয়নের শরিফা নামের টিসিবি কার্ডধারী এক নারী বলেন, ‘সেখানে ৩০ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায়। বাজার থেকে ওই চাল কিনতে কেজিতে প্রায় ৫০ টাকা লাগে। জুলাই মাসে চাল না পাওয়ায় কিছুটা কষ্টই হইছে।’