ভাসানী-বঙ্গবন্ধুর আ’লীগ ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টের হলো যেভাবে
Published: 19th, April 2025 GMT
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক সংস্কার নিয়েও জোরেশোরে কথাবার্তা চলেছে। অবশ্য রাষ্ট্রীয় সংস্কারের আলোচনা যতটা জোর পাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের কথা ততটা পাচ্ছে না। আবার সেই রাজনৈতিক সংস্কারের আলোচনায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গ আসছে আরও কম। বরং আলোচনাটা দাঁড়িয়েছে, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কিনা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারবে কিনা।
দেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের এমন করুণ পরিণতি হলো কেন? আমার ধারণা, গণমানুষের নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগে যখন থেকে শেখ হাসিনা নব্য ধনীদের যুক্ত করতে শুরু করেছেন, তখন থেকেই দলটির এমন করুণ পরিণতির ভিত রচনা হয়েছিল। বস্তুত, বিস্ময়করভাবে, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনা রীতিমতো ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের লীলাক্ষেত্রে পরিণত করেছিলেন।
আমরা জানি, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন কারাবন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয়েছিল যুগ্ম সম্পাদক। পরে শামসুল হক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যাওয়ায় বঙ্গবন্ধু দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে হাল ধরেন। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার পর ১৯৫৭ সালে সভাপতি হন মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। ১৯৬৬ সালে সভাপতি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জন্মলগ্ন থেকে এই তিন সভাপতির নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ এ দেশের শ্রমজীবী কৃষক-শ্রমিক ও জনগণের রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
বিশেষত ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণার পথ ধরে আওয়ামী লীগ পরিণত হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এসেছিল ভূমিধস বিজয়। একাত্তরের ২৬ মার্চ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকার যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র দিয়েছিল, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনটি মূলনীতি ঘোষিত হয়েছিল: সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। তিন মূলনীতির মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এর ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়লগ্নে যাত্রা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের।
স্বাধীন দেশে এসে আওয়ামী লীগের মতো গণমানুষের শক্তিতে বলীয়ান একটি রাজনৈতিক দল কীভাবে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে গেল? জনমানুষের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কীভাবে ধীরে ধীরে ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা লুটেরা পুঁজিবাদ, ক্লেপ্টোক্রেসি বা চৌর্যতন্ত্র এবং নব্যধনী নিয়ন্ত্রিত শাসকগোষ্ঠী বা অলিগার্কিতে রূপান্তরিত হলো? এর দায় প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে নিতে হবে।
এটা ঠিক, ১৯৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধু হত্যার পরও ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসার পর বিপদসংকুল দেড় দশকে ১৯৯৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতাসীন করায় সফল হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হলেও ক্ষীণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০০১ সাল পর্যন্ত হাসিনাকে শাসন চালাতে হওয়ায় তাঁর একনায়কতান্ত্রিক মানসিকতা জনগণের কাছে ধরা পড়েনি। বরং ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালিত ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিপর্যয় ডেকে আনে। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ভূমিধস বিজয় অর্জন করায় হাসিনা আজীবন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সর্বনাশা পথে পা বাড়ান।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পুত্র সোহেল তাজ অভিযোগ করেছেন, ২০০৯ সালে হাসিনা বলেছিলেন, “বিএনপি অনেক টাকা কামিয়েছে। এখন আমাদের দু’হাতে টাকা বানাতে হবে।” গত সাড়ে পনেরো বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের মহোৎসব বোঝার জন্য অবশ্য সোহেল তাজের সাক্ষ্য প্রয়োজন পড়ে না। এই পুঁজি লুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল শেখ হাসিনার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, বিভিন্ন লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও উচ্চস্তরের নেতাকর্মী কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারে জড়িয়ে গিয়েছিল।
ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে হাসিনা দুর্নীতি, বেধড়ক পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের লীলাক্ষেত্রে কীভাবে পর্যবসিত করলেন? দেখা যায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের রাতের ভোটের প্রহসনের মাধ্যমে সংসদে আসা সদস্যদের ৬১.
২০২৪ সালের আগস্টে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসাবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত ও বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল খাত, তারপর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত, তারপর ভৌত অবকাঠামো খাত এবং এরপর তথ্যপ্রযুক্তি খাত। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত এবং কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা কীভাবে জনগণের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে এ রকম ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের লুটপাটের লীলাক্ষেত্রে পরিণত করতে পারলেন? আসলে ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ক্রমেই হাসিনা নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী আসনে অধিষ্ঠিত করে ফেলেছিলেন। যেন তিনিই সবজান্তা, সব সিদ্ধান্ত তাঁরই, অন্য কারও ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার নেই। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের একে একে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। কোনো মন্ত্রী, সংসদ সদস্য কিংবা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা দলের নীতিনির্ধারণী অবস্থানে ছিলেন না। প্রয়াত মতিয়া চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর, সাবের হোসেন চৌধুরী, সিমিন হোসেন রিমি, ডা. সেলিনা হায়াত আইভী, এম. এ. মান্নানের মতো নেতারা ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতি না করলেও দলীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সক্ষম হননি।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনীতি করে আসা রাজনীতিকদেরও স্থান ছিল না; থাকলেও নীতিনির্ধারণে কোনো ভূমিকা ছিল না। ড. কামাল হোসেন বা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতো মহিরুহকে আওয়ামী লীগ থেকে নব্বই দশকেই উৎপাটিত করা হয়েছিল। তোফায়েল আহমেদের মতো নেতা দলে থাকলেও কোণঠাসা অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের পর প্রায় সব জ্যেষ্ঠ নেতাকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর কমপক্ষে আগামী এক দশক আওয়ামী লীগের পক্ষে যে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন, এটি সবাই বোঝে। একটি গণমুখী রাজনৈতিক দলের এমন গণধিকৃত অবস্থান!
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত শ খ ম জ ব র রহম ন র র জন ত ল আওয় ম র আওয় ম অবস থ ন জনগণ র হয় ছ ল ত হয় ছ সরক র মওল ন ক ষমত সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
মাগুরায় শিশু ধর্ষণ-হত্যা মামলায় সাক্ষ্য ৩ চিকিৎসকের
মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় চতুর্থ দিনের মতো সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বুধবার জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম জাহিদ হাসানের আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
এ দিন শিশুকে চিকিৎসা প্রদানকারী তিন চিকিৎসক সাক্ষ্য দেন। তারা হলেন– মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালের ডা. সোহাস হালদার, নাকিবা সুলতানা এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডা. ইসরাত জাহান। তারা সবাই শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করেন।
এর আগে সকালে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে মামলার ৪ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। বাদীপক্ষের আইনজীবী ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি মনিরুল ইসলাম মুকুল জানান, বিগত চার কার্যদিবস একটানা সাক্ষ্য গ্রহণ চলেছে। এ নিয়ে মোট ১৯ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। মামলায় মোট ৩৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হবে। আগামী রোববার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাদে অন্য সব সাক্ষী সাক্ষ্য দেবেন। বুধবার আসামিপক্ষের আইনজীবী স্বাধীনভাবে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। তিনি আদালতে আসামিরা নির্দোষ বলে যুক্তি উপস্থাপন করেন। আসামিরাও নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন।
বেড়াতে এসে ৬ মার্চ রাতে মাগুরা সদরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুর হিটু শেখের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় ৮ বছরের শিশুটি। এই ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে ঢাকা সিএমএইচে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল। ১৩ মার্চ শিশুটি সেখানে মারা যায়। এ ঘটনায় শিশুটির মা আয়েশা আক্তার বড় মেয়ের শ্বশুর হিটু শেখসহ চারজনকে আসামি করে মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন। রিমান্ডে হিটু শেখ ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে।