নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলামের প্রতিবাদ সমাবেশের পর এই লেখাটা দাঁড় করানোর তাগিদ বোধ করলাম। ধর্মভিত্তিক নিয়মকানুনের অপব্যবহার কীভাবে নারী ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে, প্রযুক্তি ও নারী নিয়ে আমার গবেষণার নানা সময়ে তা দেখেছি। ভাবলাম, আমার গবেষণার সময়কার অভিজ্ঞতাগুলো দিয়ে রাখলে ছোট-বড়-সমবয়সী যাঁরা দেশ গড়ার কাজ করছেন, তাঁদের কাজে লাগতে পারে।

প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন—এমন অনেক নারীর সঙ্গে অনলাইনে একবার করোনার সময় আলোচনা চলছে। সেখানে বেশ প্রভাবশালী একজন পুরুষ আলোচকও যোগ দিয়েছিলেন। আলোচনার সময় হঠাৎ তিনি বললেন, ‘মহিলাদের যেহেতু বুদ্ধি কম.

..।’

অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আলোচনায় আমার চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কেউই প্রতিবাদ করছেন না। আমি আর পারলাম না, বলেই ফেললাম, ‘এই কথাটা এখানে বেমানান। কারণ, সবাই এখানে প্রতিষ্ঠিত।’ তিনি কথাটি কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘আরে, না, না, আপনারা না। অন্য যাদের বুদ্ধি কম, ওদের কথা বলছি।’

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এভাবে কি কথা বলা যায়? বুঝলাম, এ রকম কথার একটি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে আছে। যেকোনো পরিসরে একজন নারীকে নিয়ে কথা বলার মতো কুরুচিপূর্ণ একটি সমাজ আমরা তৈরি করে ফেলেছি। আর এ রকম কথাকে জোরালো করার জন্য যদি ধর্মকে ভুল-শুদ্ধ যেভাবে হোক জড়িয়ে-পেঁচিয়ে ফেলা যায়, তাহলে তো কেউ তার প্রতিবাদ করারও সাহস পাবেন না।

বহুদিন ধরে আমি প্রযুক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ আর প্রযুক্তি দিয়ে নানা রকমের সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে সীমিত পরিসরে কাজ করেছি। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, বহু বাধা নারীদের মতো অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্যও সমান। গবেষণায় দেখেছি, মেয়েদের বেশির ভাগ বাধা আর বৈষম্য আসে পরিবার আর সমাজ থেকে।

আর সেগুলো বেশির ভাগই তৈরি হয় ধর্মীয় আর সামাজিক নিয়মের বেড়াজালে। নারীর স্তন ক্যানসারের জন্য কীভাবে প্রযুক্তি ডিজাইন করা যায়, এ নিয়ে কাজ করতে গেলে বলা হয়েছে যে প্রসঙ্গটি নাকি ধর্মসম্মত নয়। অবাক হয়ে গেলাম। শরীরের যত্ন নেওয়ায় কি কোনো বাধা থাকতে পারে!

ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, বহু বছর ধরে একদল মানুষ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ তৈরি এবং সেই বিভেদকে বৈধ করার কাজে লাগিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও তা-ই হয়েছিল। এ জন্যই সম্ভবত বাংলাদেশের জন্মের সময় আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ভেবেছিলাম।

আরেকবার যৌন নিপীড়ন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে শুনতে পেলাম, নারীদের নানা নিগ্রহের জন্য মূলত দায়ী নাকি তাঁদের পোশাক। নারীরা যদি শালীন আর ধার্মিক হতেন, এসব যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটত না। অথচ সবার সচেতনতা দিয়েই যৌন নিপীড়নের একটা সামাজিক সমাধান করা সম্ভব হতে পারে।

গবেষণা করতে গিয়ে যাঁদের বাধা পেয়েছি, যেখানে নির্বিশেষেই পুরুষ ও নারী ছিলেন, তাঁরা সমস্যার সমাধান নিয়ে চিন্তা না করে নারীদের একতরফা দায়ী করেছেন। যাঁরা জোর গলায় নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলেন, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন চান, তাঁদের দেওয়া হয় না এমন কোনো অশ্লীল গালাগালি নেই। নারীর সম্মান আর অধিকার ভীষণভাবে আহত করতে কারও কোনো সংকোচ হয় না। কোনো সমস্যার সঙ্গে যদি যৌক্তিক বা অযৌক্তিকভাবে ধর্মকে যুক্ত করা যায়, তখন কেউ আর তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সাহস পান না। মূল সংকট এখানেই। ধর্ম নিয়ে সেই ব্যাখ্যাগুলো আদৌ অপব্যাখ্যা কি না, বেশির ভাগ মানুষ তা আর খুঁজে দেখতে যান না।

ধর্মে অনেক ভালো ভালো নিয়মকানুন এসেছে, সবই মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু ব্যক্তিগত ধর্মচর্চা আর রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহারে অনেক পার্থক্য আছে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, বহু বছর ধরে একদল মানুষ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ তৈরি এবং সেই বিভেদকে বৈধ করার কাজে লাগিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও তা-ই হয়েছিল। এ জন্যই সম্ভবত বাংলাদেশের জন্মের সময় আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ভেবেছিলাম।

হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আগে থেকে থাকা একটি নারীর একটি প্রতীককে পেটানো হলো। এটি কি সেই বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সবার আগে অন্যায়ের প্রতিবাদ হতো? সমাবেশে কিছু বক্তা নারীদের নিয়ে আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। সংগঠনটি এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেও এই প্রশ্ন তো থেকেই যাবে, এটি আদৌ হওয়া উচিত ছিল কি না। ঘটনাটি কি আমাদের সামগ্রিক দুর্বলতা প্রকাশ করছে না?

২০১৭ সালে আফগানিস্তানের যে কম্পিউটার-বিজ্ঞানী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, আজকে তাঁদের কোথাও খুঁজে পাই না। আমাদের মেয়েরাও হারিয়ে যাবে না তো?

নোভা আহমেদ শিক্ষক, ইলেকট্রিক ও কম্পিউটার বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক জ কর র জন য আম দ র য় আমর সমস য র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

দুপুরে সংবাদ সম্মেলন ডে‌কে‌ছে সরকার

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সোমবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়েছে।

আজ দুপুর ১২টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের করবী হলে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

রবিবার (২ নভেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়। 

শুধু বৈধ নিরাপত্তা পাশধারী স্বীকৃত সাংবাদিকরা এতে অংশ নিতে পারবেন। 

প্রেস উইং থেকে  স্বীকৃত সাংবাদিকদের সোমবার দুপুর ১২টায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ