সেন্টমার্টিনে পর্যটক নেই, হোটেল বন্ধ: ক্যারাম বোর্ডে চলছে সংসার
Published: 17th, May 2025 GMT
নীল জলরাশি ঘেরা সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ একসময় পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকলেও এখন যেন নীরব এক জনপদ। বন্ধ হোটেল-রিসোর্ট, তালাবদ্ধ রেস্তোরাঁ, কর্মহীন মানুষের হাহাকার। সবমিলিয়ে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি এখন পর্যটনশূন্য।
পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকায় আয়-রোজগার নেই, ফলে অনেক হোটেল মালিক কর্মচারীদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে কেউ কেউ হাল না ছেড়ে জীবিকার নতুন পথ খুঁজে নিয়েছেন। যেমন, খালি রেস্টুরেন্টে ক্যারাম বোর্ড বসিয়ে স্থানীয়দের খেলতে দিয়ে আয়ের পথ বের করেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেন্টমার্টিন জেটিঘাট থেকে বাজারপাড়া ঢুকতেই ডান পাশে দেখা গেল একসময়ের জমজমাট দারুচিনি রেস্টুরেন্টটি খালি পড়ে আছে। এখন সেখানে চলছে ক্যারাম খেলা। প্রতি গেম ১০ টাকায় খেলে স্থানীয়রা সময় কাটাচ্ছেন। এখান থেকেই প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে সংসার চালান রেস্টুরেন্টটির মালিক সৈয়দ আমিন।
তিনি বলেন, “চার মাস ধরে হোটেল ব্যবসা বন্ধ। পর্যটক নেই, তাই সবাইকে ছাঁটাই করতে হয়েছে। সংসার তো থেমে থাকবে না, তাই রেস্টুরেন্টের চেয়ার টেবিল সরিয়ে ক্যারাম বোর্ড বসিয়ে কিছুটা আয় করছি।”
তিনি আরও জানান, একসময় এ প্রতিষ্ঠানে ২০ জনের বেশি কর্মচারী কাজ করতেন, এখন সবাই বেকার।
পর্যটন মৌসুম সীমিত হয়ে আসায় বন্ধ হয়ে গেছে আশপাশের শাহিনা রেস্তোরাঁ, আল্লাহর দান রেস্টুরেন্ট, ইউরো বাংলা, এশিয়া বাংলা রেস্টুরেন্টসহ অধিকাংশ হোটেল-রেস্তোরাঁ। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাটে ঘোরাঘুরি করছে অভুক্ত কুকুর আর কর্মহীন মানুষ। কেউ জাল বুনছেন, কেউ রাস্তায় এবং আশেপাশে সময় পার করছেন।
ক্যারাম খেলার ফাঁকে স্থানীয় যুবক আলমগীর চৌধুরী আকাশ বলেন, “সেন্টমার্টিনের মানুষ এখন খুব কষ্টে আছে। পর্যটক না থাকায় রিকশা, হোটেল, রেস্তোরাঁ-সবখানে আয় নেই।”
শাহজালাল নামে একজন বলেন, “আগে ব্যবসা করতাম, এখন বড়শি নিয়ে সাগরে যাই। কিন্তু মাছ কিনবে এমন সামর্থ্যবান মানুষও নেই। এভাবে চললে না খেয়ে মরতে হবে।”
কোণারপাড়া এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ তৈয়ব উল্লাহ বলেন, “একসময় আমরা গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করে চলতাম। কিন্তু পর্যটন ব্যবসা শুরু হলে সবাই সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে। আগে চার মাস ব্যবসা করলেই সারা বছর চলে যেত, এখন সরকারিভাবে তিন মাসের বেশি অনুমতি নেই। এতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।”
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য হাবিবুর রহমান জানান, দ্বীপে ৫০টির বেশি রেস্টুরেন্ট ছিল, যেখানে প্রায় দেড় হাজার কর্মচারী কাজ করতেন। এখন সবাই বেকার। প্রায় ৪০০ অটোরিকশা চালকও আয়হীন হয়ে পড়েছেন। কেউ গরু-ছাগল বিক্রি করছেন, কেউ স্বর্ণ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, “নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি- এই তিন মাস সেন্টমার্টিনকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। তবে নভেম্বরে রাতযাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটক আসে না। বাকি দুই মাসের ব্যবসায় সারা বছর চলে না। এ বিষয়ে সরকারের ভেবে দেখা উচিত।”
হোটেল মালিক রেজাউল করিম বলেন, “আমার হোটেলে আগে ১০ জন স্টাফ ছিল, এখন মাত্র একজন আছে। খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। এভাবে চললে হোটেলটিও বিক্রি করে দিতে হবে।”
হোটেলের সাবেক কর্মচারী রবিউল হাসান বলেন, “আগে দিনে হাজার টাকা বকশিশ পেতাম, এখন বেতনও নেই। পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে আছি।”
পর্যটন ব্যবসায় ধস নামায় কেউ কেউ দ্বীপ ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে পাড়ি জমাচ্ছেন। আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী জসিম উদ্দীন শুভ টেকনাফ সদরে গিয়ে মুদি দোকান খুলেছেন। তিনি বলেন, “সেন্টমার্টিনে আর চলে না, তাই টেকনাফে এসে সংসার চালাচ্ছি। আবার পর্যটক এলে হোটেল ব্যবসায় ফিরব।”
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়জুল ইসলাম জানান, দ্বীপবাসীর কষ্টের কথা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে মিছিল-মানববন্ধন করেও সমাধান আসেনি। তিনি আশাবাদী, নির্বাচিত সরকার এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন বলেন, “সেন্টমার্টিন দ্বীপ সুরক্ষায় একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। পর্যটক যাতায়াত বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের বিকল্প জীবিকার বিষয়টি ভেবে দেখা হচ্ছে।”
সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় সেন্টমার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ২০২০ সালের আগস্টে পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয় সরকার। সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে সমীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গবেষণায় বলা হয়, সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের রাতযাপন অনুমোদনযোগ্য নয়।
ঢাকা/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ন টম র ট ন ব যবস য় এখন স সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতীয় পর্যটকদের কাছে ১৩তম জনপ্রিয় শহর ঢাকা
করোনার আগের তুলনায় বর্তমানে ভারত থেকে ঢাকায় ভ্রমণকারীর সংখ্যা ৩১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে ভারতীয় পর্যটকদের কাছে ঢাকা ১৩তম জনপ্রিয় শহরে পরিণত হয়েছে। ভারতের পাশাপাশি মালয়েশিয়ার ভ্রমণকারীদের জন্যও ঢাকা একটি জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
মাস্টারকার্ড ইকোনমিকস ইনস্টিটিউটের বার্ষিক ‘ট্রাভেল ট্রেন্ডস ২০২৫’ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভ্রমণের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, বিশ্বের শীর্ষ ১৫টি গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ গন্তব্যের মধ্যে আটটিই এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশ।
অর্থনীতিতে ভ্রমণের অবদান ও পর্যটকদের ব্যয়ের প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানুষের আগ্রহ, রুচি ও উদ্দেশ্যনির্ভর চিন্তাভাবনাই এখন পর্যটনের সবচেয়ে বড় চালিকা শক্তি।
শীর্ষে জাপান
২০২৫ সালের গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) টোকিও ও ওসাকা যথাক্রমে বিশ্বের ১ ও ২ নম্বর শীর্ষ ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে স্থান পেয়েছে। জাপানের এই দুটি শহরের প্রতি পর্যটকদের আগ্রহ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ২০২৩ সালে দ্বিতীয় স্থানে থাকা জাপানের রাজধানী টোকিও ২০২৪ সালে এসে ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে শীর্ষে জায়গা করে নেয়।
২০২৪ সালে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক পর্যটক বাজার হিসেবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে। এ ছাড়া ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের ক্ষেত্রে কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান ও কিরগিজস্তানের মতো মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে।
মাস্টারকার্ডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পর্যটকেরা ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ভ্রমণের ক্ষেত্রে রেকর্ড গড়েছেন। ভারতীয় পর্যটকেরা ভ্রমণের জন্য এখন বেছে নিচ্ছেন বৈচিত্র্যময় সব গন্তব্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছেন আবুধাবি, হ্যানয় আর বালিতে। চীন ও ভারত মিলেই বৈশ্বিক ভ্রমণের গতিপথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, স্পোর্টস ট্যুরিজম বা খেলাধুলাভিত্তিক পর্যটনের জনপ্রিয়তাও দিন দিন বাড়ছে। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন টেনিস টুর্নামেন্ট এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে বেসবল ওয়ার্ল্ড সিরিজের মতো বড় আসরে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মাস্টারকার্ড ইকোনমিকস ইনস্টিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভিড ম্যান বলেন, বিশ্ব ভ্রমণে এখনো এগিয়ে আছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল। টোকিও, সাংহাই, সিউল ও সিঙ্গাপুরের মতো গন্তব্যগুলো মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে।
২০২৪ সালের বেশির ভাগ সময়জুড়ে জাপানি ইয়েন দুর্বল থাকায় দেশটিতে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কম খরচে ঘোরার সুযোগ থাকায় জাপান ভ্রমণকারীদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।