বাংলাদেশের প্রান্তিক কৃষক সমাজ আজ এক গভীর সংকটে। নদীভাঙন, খাসজমির অব্যবস্থাপনা, আইন প্রয়োগের জটিলতা এবং ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ‘শিকস্তি-পয়স্তি’ ব্যবস্থার ভুল ব্যাখ্যা ও আইনি ফাঁকফোকরে প্রকৃত মালিকেরা তাদের অধিকার হারাচ্ছেন, অথচ ভূমিদস্যু ও প্রভাবশালীরা একই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে জমির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছেন।

এই প্রেক্ষাপটে একটি স্বাধীন, কার্যকর ও স্বচ্ছ ভূমি ও কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। এটি কেবল সময়ের দাবি নয়—এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক প্রয়োজন। এমন একটি কমিশনের মাধ্যমে খাসজমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি আইনের সংস্কার, এবং প্রকৃত ভূমিহীনদের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ভবিষ্যৎ কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে একটি ন্যায্য ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব।

নদীভাঙন ও জমি হারানোর প্রক্রিয়া: বাস্তবতার নির্মম চিত্র

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ নদীভাঙনের ফলে জমি হারায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যমতে, গত এক দশকে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ নদীভাঙনের কারণে বাস্তুহারা হয়েছে। এই মানুষদের বড় একটি অংশ ছিল ক্ষুদ্র কৃষক, যাদের জমির মালিকানা ছিল কিন্তু এখন তারা ভূমিহীন।

এই জমিগুলো ভাঙনের পর নদীগর্ভে বিলীন হয়। কয়েক বছর পর যখন আবার চর জেগে ওঠে, তখন স্থানীয় প্রভাবশালীরা সরকারি খাসজমি দেখিয়ে দখলে নেয় এবং প্রকৃত মালিকদের বঞ্চিত করে। অনেক সময় স্থানীয় ভূমি অফিসের অসহযোগিতা, দালালচক্র এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়া প্রকৃত মালিকদের আইনি প্রমাণের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করে।

‘শিকস্তি-পয়স্তি’: ব্যবস্থাপনার ফাঁক না দুর্নীতির হাতিয়ার?

‘শিকস্তি’ অর্থ চাষাবাদ বন্ধ থাকা জমি; ‘পয়স্তি’ অর্থ চাষাবাদি জমি। ঔপনিবেশিক আমলে এই ধারণা মালিকানা ও ভোগাধিকারের মাঝে একটি পার্থক্য নির্ধারণের জন্য চালু হয়। কিন্তু আজ এই ব্যবস্থাই ভূমি-বিরোধের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে।

প্রায়ই দেখা যায়—নদীভাঙনে হারানো জমির সাবেক মালিক ‘শিকস্তি’ বিবেচিত হন, আর চর জাগা জমি যাঁরা চাষাবাদ শুরু করেন, তাঁরা নিজেদের ‘পয়স্তি’ পরিচয়ে মালিকানা দাবি করেন। দুর্বল আইনি কাঠামো ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে প্রকৃত মালিকেরা বছরের পর বছর ধরে জমির অধিকার ফিরে পান না।

আইনি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা: আইন আছে, কার্যকারিতা নেই

বর্তমানে খাসজমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেসব আইন কার্যকর রয়েছে, তা বাস্তব সমস্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়:

১.

বাংলাদেশ ভূমি আইন, ১৯৫০: ভূমির রেকর্ড প্রণয়নে সহায়ক হলেও নদীভাঙন ও চর পুনর্গঠনের বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

২. খাসজমি বন্দোবস্ত নীতিমালা, ১৯৯৭ (সংশোধিত ২০১১): ভূমিহীনদের জন্য নীতিগত সুবিধা থাকলেও এর প্রয়োগ নির্ভর করে স্থানীয় প্রশাসনের সদিচ্ছার ওপর।

৩. সার্ভে ও রেকর্ড সংশোধন আইন, ২০০৯: পুনঃ সার্ভে সম্ভব হলেও বাস্তবে ভূমিহীন কৃষকদের পক্ষে তা প্রমাণ ও প্রাপ্তি প্রায় অসম্ভব।

৪. ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৭ (সংশোধিত ২০২১): উন্নয়ন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ সহজ হলেও ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের প্রশ্নে আইনটি নীরব।

৫. দখলসূত্রে মালিকানা আইন: দীর্ঘদিন অচাষযোগ্য থাকা জমির ওপর তৃতীয় পক্ষ মালিকানা দাবি করতে পারায় ভূমিদস্যুদের জন্য এটি হয়ে উঠেছে এক দুর্নীতির চাবিকাঠি।

এসব আইনের অভ্যন্তরীণ অসংগতি ও প্রয়োগে প্রশাসনিক দুর্বলতা মিলে এক ভয়াবহ ভূমি-সংকট তৈরি করেছে।

ভূমিদস্যুতা ও ক্ষমতার জোট: প্রান্তিক কৃষকের বিপরীতে ক্ষমতার লড়াই

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর গড়ে ৫০ হাজার একর খাসজমি অবৈধভাবে দখল হয়ে যায়। স্থানীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অংশবিশেষ এবং দালাল চক্র মিলে গড়ে তুলেছে এক সুসংগঠিত দখলদার নেটওয়ার্ক।

দলিল জালিয়াতি, মিথ্যা পয়স্তি দাবি, ভুয়া বন্দোবস্ত দলিল, এমনকি ভূমিকর পরিশোধ দেখিয়ে জমির মালিকানা বদল করে ফেলা—এসবই চলছে নির্লজ্জ প্রকাশ্যতায়। অনেক ক্ষেত্রেই ভূমি অফিস ও থানার সহযোগিতা না পেলে সাধারণ কৃষকের পক্ষে আইনত প্রতিকার পাওয়া দুঃস্বপ্নের শামিল।

করণীয়: একটি মানবিক ও কার্যকর ভূমি সংস্কার দর্শন

১. স্বাধীন ভূমি ও কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন:

এ কমিশনের প্রধান কাজগুলো হবে—

● নদীভাঙন ও চরজমি নিয়ে একটি আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন

● শিকস্তি-পয়স্তি ও খাসজমি বিতর্কে সুস্পষ্ট আইনি সংজ্ঞা ও নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া তৈরি

● ভূমি অফিসের কার্যক্রমের ওপর স্বাধীন নজরদারি ও দুর্নীতি প্রতিরোধ

● প্রকৃত ভূমিহীনদের সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমির অধিকার নিশ্চিত করা

২. সমন্বিত ভূমি কোড প্রণয়ন:

বিচ্ছিন্ন আইন ও বিধিমালাকে একত্র করে একটি যুগোপযোগী ও সুসংহত ‘ভূমি কোড’ তৈরি করা আবশ্যক। এতে জমির মালিকানা, হস্তান্তর, অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে।

৩. স্থানীয় বিচারপ্রক্রিয়ায় তৃতীয় পক্ষ বা পঞ্চায়েতের ভূমিকা:

চরভূমি বা বিতর্কিত জমির মালিকানা নির্ধারণে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে বিরোধ সহজেই নিষ্পত্তি হতে পারে। এ ব্যবস্থাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।

৪. ডিজিটাল ভূমি প্ল্যাটফর্ম:

সব খতিয়ান, নামজারি, মালিকানা ও বন্দোবস্ত তথ্য একটি কেন্দ্রীয় ও উন্মুক্ত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ ও গণপ্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

ভূমি শুধু সম্পদ নয়—এটি কৃষকের জীবনের মৌলিক অধিকার। এক টুকরা জমি তার মর্যাদা, আত্মপরিচয় ও জীবনসংগ্রামের মূল ভিত্তি। তাই ভূমিহীন কৃষকের জমি ফেরত দেওয়া কিংবা ন্যায্য মালিকানা নিশ্চিত করা কোনো অনুদান নয়—এটা তার প্রাপ্য।

নদীভাঙন, ভূমিদস্যুতা, আইনি জটিলতা আর দুর্নীতির ছোবলে আজ কৃষক জমি হারিয়ে শহরে রিকশাচালক বা নির্মাণশ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই সময়, একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ ও মানবিক ভূমি ও কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন করে এই সংকট থেকে মুক্তির পথ রচনা করার।

সরকার, প্রশাসন এবং সমাজের বিবেকবান নাগরিকদের প্রতি আহ্বান—এই জটিল সমস্যাকে উপেক্ষা না করে দ্রুত এবং সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। এই মুহূর্তে ভূমিহীন কৃষকের পাশে দাঁড়ানো মানেই দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা।

মুনতাসির রাসেল লেখক ও সংগঠক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রক ত ম ল ক ন শ চ ত কর ভ ম হ নদ র প রক র য় র ওপর পয়স ত গ রহণ খ সজম

এছাড়াও পড়ুন:

ওমরাহর, ইহরাম, তাওয়াফের ফরজ এবং ওয়াজিব

মসজিদুল হারামের সীমানার বাইরে মিকাতের ভেতরের স্থানটি হিল নামে পরিচিত। এই হিল অথবা মিকাত থেকে ইহরামের নিয়ত করে বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া সাঈ করা এবং মাথার চুল ফেলে দেওয়া বা ছোট করাকে ওমরাহ বলে। 
৯ থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত সময় ছাড়া বছরের যে কোনো সময় ওমরাহ পালন করা যায়। হজের পাঁচ দিন ওমরাহ করা মাকরুহ। (আল-বাহরুল আমিক, ৪/২০২১)। 

ওমরাহর ফরজ, ওয়াজিব
ওমরাহর ফরজ ২টি: ইহরাম ও তাওয়াফ।
ওমরাহর ওয়াজিব ২টি: সাঈ ও হলক করা। 

নারীদের ইহরাম
নারীদের ইহরাম একটু ভিন্ন। নারীদের ইজার ও রিদা পরতে হয় না; বরং নারীরা যে কোনো রঙের বা প্রকারের কাপড় পরতে পারেন। তবে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে কোনোভাবেই যেন এমন ধরনের কাপড় না পরা হয়, যাতে পর্দা নষ্ট হয়।
ইহরামের ফরজ ২টি: নিয়ত করা ও তালবিয়া পড়া।
ইহরামের ওয়াজিব ২টি: মিকাত থেকে ইহরাম বাঁধা এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকা।

তাওয়াফ
তাওয়াফের ফরজ ৩টি: ১. নিয়ত করা। ২. বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করা। ৩. নিজে তাওয়াফ করা।
তাওয়াফের ওয়াজিব ৬টি: ১. শরীর পাক রাখা। ২. হেঁটে তাওয়াফ করা। ৩. হাতিমের বাইরে দিয়ে তাওয়াফ করা। ৪. তাওয়াফের সাত চক্কর পুরো করা। ৫. তাওয়াফ হাজরে আসওয়াদ থেকে শুরু করা। ৬. তাওয়াফ শেষে মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে দুই রাকাত নামাজ পড়া।
তাওয়াফের সুন্নত ৪টি: ১. হাজরে আসওয়াদের দিকে মুখ করে তাওয়াফ শুরু করা। ২. প্রথম তিন তাওয়াফে রমল করা (বীরের মতো চলা)। ৩. প্রতি চক্করে সম্ভব হলে হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা। ৪. তাওয়াফ ও নামাজ শেষে জমজমের পানি পান করা।

সাঈ
সাঈ মানে সাতটি দৌড়। সাঈ করার সময় সবুজ বাতির নিচে পুরুষেরা দৌড়াবেন। নারীরা স্বাভাবিকভাবে চলবেন (বাদায়েউস সানায়ে, ২/৪৮০)। 
সাঈর ওয়াজিব: ১. ওজর না থাকলে হেঁটে সাঈ করা। ২. সাত চক্কর পুরো করার পর মাথা মুণ্ডন করা।
ওমরাহর কাজ ধারাবাহিকভাবে করতে হবে, যেমন তাওয়াফ করা, নামাজ আদায় করা, জমজমের পানি পান করা, সাঈ করা (সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানো), মাথা ন্যাড়া অথবা চুল ছোট করা।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ