শিকস্তি-পয়স্তি ও খাসজমি বিতর্ক: প্রান্তিক কৃষকের জমি কার হাতে
Published: 28th, May 2025 GMT
বাংলাদেশের প্রান্তিক কৃষক সমাজ আজ এক গভীর সংকটে। নদীভাঙন, খাসজমির অব্যবস্থাপনা, আইন প্রয়োগের জটিলতা এবং ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ‘শিকস্তি-পয়স্তি’ ব্যবস্থার ভুল ব্যাখ্যা ও আইনি ফাঁকফোকরে প্রকৃত মালিকেরা তাদের অধিকার হারাচ্ছেন, অথচ ভূমিদস্যু ও প্রভাবশালীরা একই ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে জমির নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছেন।
এই প্রেক্ষাপটে একটি স্বাধীন, কার্যকর ও স্বচ্ছ ভূমি ও কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন এখন সময়ের দাবি। এটি কেবল সময়ের দাবি নয়—এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক প্রয়োজন। এমন একটি কমিশনের মাধ্যমে খাসজমি ব্যবস্থাপনা, ভূমি আইনের সংস্কার, এবং প্রকৃত ভূমিহীনদের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করে ভবিষ্যৎ কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে একটি ন্যায্য ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো সম্ভব।
নদীভাঙন ও জমি হারানোর প্রক্রিয়া: বাস্তবতার নির্মম চিত্রবাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষ নদীভাঙনের ফলে জমি হারায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যমতে, গত এক দশকে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ নদীভাঙনের কারণে বাস্তুহারা হয়েছে। এই মানুষদের বড় একটি অংশ ছিল ক্ষুদ্র কৃষক, যাদের জমির মালিকানা ছিল কিন্তু এখন তারা ভূমিহীন।
এই জমিগুলো ভাঙনের পর নদীগর্ভে বিলীন হয়। কয়েক বছর পর যখন আবার চর জেগে ওঠে, তখন স্থানীয় প্রভাবশালীরা সরকারি খাসজমি দেখিয়ে দখলে নেয় এবং প্রকৃত মালিকদের বঞ্চিত করে। অনেক সময় স্থানীয় ভূমি অফিসের অসহযোগিতা, দালালচক্র এবং দুর্নীতিগ্রস্ত প্রক্রিয়া প্রকৃত মালিকদের আইনি প্রমাণের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করে।
‘শিকস্তি-পয়স্তি’: ব্যবস্থাপনার ফাঁক না দুর্নীতির হাতিয়ার?‘শিকস্তি’ অর্থ চাষাবাদ বন্ধ থাকা জমি; ‘পয়স্তি’ অর্থ চাষাবাদি জমি। ঔপনিবেশিক আমলে এই ধারণা মালিকানা ও ভোগাধিকারের মাঝে একটি পার্থক্য নির্ধারণের জন্য চালু হয়। কিন্তু আজ এই ব্যবস্থাই ভূমি-বিরোধের অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে।
প্রায়ই দেখা যায়—নদীভাঙনে হারানো জমির সাবেক মালিক ‘শিকস্তি’ বিবেচিত হন, আর চর জাগা জমি যাঁরা চাষাবাদ শুরু করেন, তাঁরা নিজেদের ‘পয়স্তি’ পরিচয়ে মালিকানা দাবি করেন। দুর্বল আইনি কাঠামো ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে প্রকৃত মালিকেরা বছরের পর বছর ধরে জমির অধিকার ফিরে পান না।
আইনি কাঠামোর সীমাবদ্ধতা: আইন আছে, কার্যকারিতা নেইবর্তমানে খাসজমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেসব আইন কার্যকর রয়েছে, তা বাস্তব সমস্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়:
১.
২. খাসজমি বন্দোবস্ত নীতিমালা, ১৯৯৭ (সংশোধিত ২০১১): ভূমিহীনদের জন্য নীতিগত সুবিধা থাকলেও এর প্রয়োগ নির্ভর করে স্থানীয় প্রশাসনের সদিচ্ছার ওপর।
৩. সার্ভে ও রেকর্ড সংশোধন আইন, ২০০৯: পুনঃ সার্ভে সম্ভব হলেও বাস্তবে ভূমিহীন কৃষকদের পক্ষে তা প্রমাণ ও প্রাপ্তি প্রায় অসম্ভব।
৪. ভূমি অধিগ্রহণ আইন, ২০১৭ (সংশোধিত ২০২১): উন্নয়ন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ সহজ হলেও ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের প্রশ্নে আইনটি নীরব।
৫. দখলসূত্রে মালিকানা আইন: দীর্ঘদিন অচাষযোগ্য থাকা জমির ওপর তৃতীয় পক্ষ মালিকানা দাবি করতে পারায় ভূমিদস্যুদের জন্য এটি হয়ে উঠেছে এক দুর্নীতির চাবিকাঠি।
এসব আইনের অভ্যন্তরীণ অসংগতি ও প্রয়োগে প্রশাসনিক দুর্বলতা মিলে এক ভয়াবহ ভূমি-সংকট তৈরি করেছে।
ভূমিদস্যুতা ও ক্ষমতার জোট: প্রান্তিক কৃষকের বিপরীতে ক্ষমতার লড়াইবাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবছর গড়ে ৫০ হাজার একর খাসজমি অবৈধভাবে দখল হয়ে যায়। স্থানীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অংশবিশেষ এবং দালাল চক্র মিলে গড়ে তুলেছে এক সুসংগঠিত দখলদার নেটওয়ার্ক।
দলিল জালিয়াতি, মিথ্যা পয়স্তি দাবি, ভুয়া বন্দোবস্ত দলিল, এমনকি ভূমিকর পরিশোধ দেখিয়ে জমির মালিকানা বদল করে ফেলা—এসবই চলছে নির্লজ্জ প্রকাশ্যতায়। অনেক ক্ষেত্রেই ভূমি অফিস ও থানার সহযোগিতা না পেলে সাধারণ কৃষকের পক্ষে আইনত প্রতিকার পাওয়া দুঃস্বপ্নের শামিল।
করণীয়: একটি মানবিক ও কার্যকর ভূমি সংস্কার দর্শন১. স্বাধীন ভূমি ও কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন:
এ কমিশনের প্রধান কাজগুলো হবে—
● নদীভাঙন ও চরজমি নিয়ে একটি আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন
● শিকস্তি-পয়স্তি ও খাসজমি বিতর্কে সুস্পষ্ট আইনি সংজ্ঞা ও নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া তৈরি
● ভূমি অফিসের কার্যক্রমের ওপর স্বাধীন নজরদারি ও দুর্নীতি প্রতিরোধ
● প্রকৃত ভূমিহীনদের সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমির অধিকার নিশ্চিত করা
২. সমন্বিত ভূমি কোড প্রণয়ন:
বিচ্ছিন্ন আইন ও বিধিমালাকে একত্র করে একটি যুগোপযোগী ও সুসংহত ‘ভূমি কোড’ তৈরি করা আবশ্যক। এতে জমির মালিকানা, হস্তান্তর, অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে।
৩. স্থানীয় বিচারপ্রক্রিয়ায় তৃতীয় পক্ষ বা পঞ্চায়েতের ভূমিকা:
চরভূমি বা বিতর্কিত জমির মালিকানা নির্ধারণে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে বিরোধ সহজেই নিষ্পত্তি হতে পারে। এ ব্যবস্থাকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
৪. ডিজিটাল ভূমি প্ল্যাটফর্ম:
সব খতিয়ান, নামজারি, মালিকানা ও বন্দোবস্ত তথ্য একটি কেন্দ্রীয় ও উন্মুক্ত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষণ ও গণপ্রকাশ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
ভূমি শুধু সম্পদ নয়—এটি কৃষকের জীবনের মৌলিক অধিকার। এক টুকরা জমি তার মর্যাদা, আত্মপরিচয় ও জীবনসংগ্রামের মূল ভিত্তি। তাই ভূমিহীন কৃষকের জমি ফেরত দেওয়া কিংবা ন্যায্য মালিকানা নিশ্চিত করা কোনো অনুদান নয়—এটা তার প্রাপ্য।
নদীভাঙন, ভূমিদস্যুতা, আইনি জটিলতা আর দুর্নীতির ছোবলে আজ কৃষক জমি হারিয়ে শহরে রিকশাচালক বা নির্মাণশ্রমিকে পরিণত হচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এখনই সময়, একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ ও মানবিক ভূমি ও কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন করে এই সংকট থেকে মুক্তির পথ রচনা করার।
সরকার, প্রশাসন এবং সমাজের বিবেকবান নাগরিকদের প্রতি আহ্বান—এই জটিল সমস্যাকে উপেক্ষা না করে দ্রুত এবং সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। এই মুহূর্তে ভূমিহীন কৃষকের পাশে দাঁড়ানো মানেই দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা।
মুনতাসির রাসেল লেখক ও সংগঠক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রক ত ম ল ক ন শ চ ত কর ভ ম হ নদ র প রক র য় র ওপর পয়স ত গ রহণ খ সজম
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রুটে দুই ট্রেনের সময় বদলে যাচ্ছে
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলা সৈকত এক্সপ্রেস ও প্রবাল এক্সপ্রেস ট্রেনের সময়সূচি পরীক্ষামূলকভাবে নতুন করে নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। নতুন সময়সূচি আগামী ১০ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস (৮২১ নম্বর ট্রেন) ট্রেনটি এখন সকাল সোয়া ৬টায় চট্টগ্রাম স্টেশন ছেড়ে যায়। নতুন সূচি অনুযায়ী, পরীক্ষামূলকভাবে এ ট্রেন চলাচল করবে ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে।
আর কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী প্রবাল এক্সপ্রেস (৮২২ নম্বর ট্রেন) ট্রেনটি কক্সবাজার স্টেশন ছাড়বে সকাল ১০টায়। এখন এ ট্রেন ছাড়ে ১০টা ২০ মিনিটে। গত মঙ্গলবার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলাচলরত সৈকত এক্সপ্রেস ও প্রবাল এক্সপ্রেসের সময়সূচি পরীক্ষামূলকভাবে পরিবর্তনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের উপপ্রধান পরিচালন কর্মকর্তা তারেক মুহাম্মদ ইমরান।
রেলওয়ের সহকারী প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিকীকের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, যাত্রীদের চাহিদা ও সময়ানুবর্তিতা রক্ষায় সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার জন্য কক্সবাজারগামী সৈকত এক্সপ্রেস এবং চট্টগ্রামমুখী প্রবাল এক্সপ্রেস ট্রেনের সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রুটে এখন দুই জোড়া আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চলাচল করে আরও দুই জোড়া আন্তনগর ট্রেন।
কক্সবাজার রেললাইনে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর। প্রথমে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস নামে আন্তনগর বিরতিহীন ট্রেন দেওয়া হয়। এরপর গত বছরের জানুয়ারিতে চলাচল শুরু করে পর্যটক এক্সপ্রেস। এটাও দেওয়া হয় ঢাকা থেকে। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন না দেওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।
গত বছরের ৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এক জোড়া বিশেষ ট্রেন চালু করা হয়। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ট্রেন। এরপর ইঞ্জিন ও কোচের সংকটের কথা বলে গত বছরের ৩০ মে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের চাপে সেই অবস্থান থেকে সরে আসে রেলওয়ে। গত বছরের ১২ জুন থেকে আবার চালু হয় ট্রেন। আর নিয়মিত ট্রেন চলাচল শুরু হয় চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে।
সৈকত এক্সপ্রেস ট্রেনটি যাত্রী ওঠানামার জন্য ষোলশহর, জানালী হাট, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, চকরিয়া, ডুলাহাজরা ও রামু স্টেশনে থামবে।
আর প্রবাল এক্সপ্রেস যাত্রাপথে থামবে ষোলশহর, গোমদণ্ডী, পটিয়া, দোহাজারী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলহাজারা, ইসলামাবাদ ও রামু স্টেশনে।