পোলট্রি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ উপখাত– ব্রিডার খামার ও হ্যাচারিগুলো বড় সংকটে পড়েছে। এক দিন বয়সী ব্রয়লার, লেয়ার এবং কালার জাতের মুরগির বাচ্চার লাগাতার দর পতনের ফলে হাজার হাজার খামার ও হ্যাচারি এখন আর্থিক ক্ষতির মুখে। এই খাতে গত দুই মাসে ৫৩০ কোটি টাকারও বেশি লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছেন খামারিরা। 

খামার মালিকরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে দুই-তিন ভাগ কম দামে বাচ্চা বিক্রি করতে হচ্ছে, অথচ উৎপাদন খরচ দিন দিন বাড়ছে। এখনই সরকার কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে পোলট্রি শিল্পের মূল ভিত্তি ভেঙে পড়তে পারে। যার প্রভাব পড়বে ডিম ও মাংসের বাজারে। হুমকির মুখে পড়তে পারে দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তা।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (বিএবি) জানিয়েছে, গত এপ্রিল ও মে মাসে ব্রয়লার বাচ্চা গড়ে বিক্রি হয়েছে ৩০-৪০ টাকা, যা মে মাসের শেষে নেমে এসেছে ৮-১০ টাকায়। অথচ সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্য ছিল ৫৮ টাকা। লেয়ার বাচ্চার দাম ছিল গড়ে ৪৭ টাকা, যেখানে সরকার নির্ধারণ করেছে ৫৭ টাকা। কালার জাতের বাচ্চার দাম ছিল ১৫-২০ টাকা, যা উৎপাদন খরচের অর্ধেকেরও কম।

এ পরিস্থিতিকে ‘মারাত্মক ও পূর্বাভাসহীন ধস’ বলে উল্লেখ করেছেন ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সভাপতি মাহাবুবুর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমানে যে হারে বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে, তাতে প্রতি সপ্তাহে আমাদের কয়েক কোটি টাকা  ক্ষতি হচ্ছে। দুই মাসে শুধু ব্রয়লার বাচ্চাতেই লোকসান হয়েছে প্রায় ৫৩০ কোটি টাকা। এটা আর শুধু ব্যবসায়িক সমস্যা নয়, কৃষিভিত্তিক শিল্পের জন্য বড় হুমকি। এ ছাড়া গত বছরের জুন-অক্টোবরেও হিটস্ট্রোক, অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে খাতটি লোকসান গুনেছে প্রায় ৪১৭ কোটি টাকা।

সংকটে পড়ে জয়পুরহাট, নওগাঁ, কুমিল্লা, গাজীপুরসহ দেশের নানা প্রান্তে ছোট ও মাঝারি খামারিরা তাদের খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন। কারণ, বাচ্চা কম দামে কিনলেও পরে বিক্রি করে লাভ করা তো দূরের কথা, মূলধনও মিলছে না। শুধু জয়পুরহাটেই গত তিন মাসে বন্ধ হয়েছে ১২০টির বেশি ছোট খামার।

পোলট্রি শিল্পে এগিয়ে থাকা জেলা জয়পুরহাটে এক দিনের মুরগির বাচ্চার দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কমে গেছে। প্রতিটি বাচ্চা দুই থেকে আড়াই ভাগ কম দামে বিক্রি হচ্ছে। হ্যাচারি মালিকরা বলেছেন, এক দিনের মুরগির বাচ্চার দামের এই ধসের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। কয়েক বছর ধরেই লোকসানে পড়ে ছোট খামারগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাচ্চার উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা কমেছে। এ ছাড়া প্রচণ্ড গরমের কারণে বাচ্চা মারা যাওয়ার ঝুঁকি থাকায় অনেক খামারি বাচ্চা কিনছেন না।

খামারিদের মতে, ব্রিডার খামার ও হ্যাচারি হলো দেশের ডিম ও মাংস উৎপাদনের প্রথম ধাপ। এগুলো ভেঙে পড়লে পুরো পোলট্রি চেইনে ধাক্কা লাগবে। টাঙ্গাইলের হ্যাচারি মালিক মিজানুর রহমান বলেন, একটা হ্যাচারি বন্ধ হলে শুধু মালিক নয়, তার অধীন শতাধিক খামার, শ্রমিক, সরবরাহকারী– সবাই বিপদে পড়ে। এই বাস্তবতা বুঝতে হবে নীতিনির্ধারকদের। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে বাচ্চার উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে, কিন্তু বাজারে সমপরিমাণ চাহিদা বাড়েনি। তার ওপর রয়েছে গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহ ও রোগবালাইয়ের ভয় তো। ফলে খামারিরা নতুন বাচ্চা তুলতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।

প্রাণিসম্পদ গবেষক ড.

মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বাচ্চা উৎপাদন ও ডিম-মাংসের চাহিদার মধ্যে সমন্বয় না ঘটালে এ ধস আরও গভীর হবে। বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্প শুধু খাদ্য নিরাপত্তার বিষয় নয়, এটি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। ডিম, মুরগির মাংসের মতো প্রোটিন উৎস সাশ্রয়ী দামে রাখতে হলে, এই শিল্পের ভিত্তি– ব্রিডার ও হ্যাচারিকে রক্ষা করা জরুরি। সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে সামনে আরও ভয়াবহ সংকট অপেক্ষা করছে।

২০২৩ সালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ব্রয়লার বাচ্চার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করেছিল ৫৩ টাকা। গত এপ্রিলে ব্রিডার ও হ্যাচারি মালিকরা মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব দিয়ে ব্রয়লার বাচ্চার দাম ৬০ টাকা এবং লেয়ার বাচ্চার দাম ৬৫ টাকা (ভ্যাকসিন ছাড়া) নির্ধারণের দাবি জানায়। তবে এখন পর্যন্ত সেই প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। এ পরিস্থিতিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের জরুরি হস্তক্ষেপ চেয়ে গত ১৮ মে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকে (বিএবি) চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে অংশীজন নিয়ে সমন্বয় সভা করার আহ্বানও জানিয়েছে সংগঠনটি।

এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবু সুফিয়ান বলেন, মুরগির বাজার ভালো থাকলে খামারিদের চাহিদাও বেশি থাকে। এখন বাজার পড়ে যাওয়ায় চাহিদা কমেছে। তবে মুরগির বাচ্চার এ দাম স্থায়ী হবে না। আমরা বিষয়টি নিয়ে দ্রুত সভা করব। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম রগ ম রগ র ব চ চ র ব রয়ল র ব চ চ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া প্রশ্নে রুল

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি শেখ তাহসিন আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার এ রুল দেন। একই সঙ্গে যেকোনো অপারেটরকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব (নিযুক্ত) দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি অনুসারে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক বিডিং (দরপত্র আহ্বান) নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

আরও পড়ুননতুন ব্যবস্থাপনায় নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনা শুরু০৭ জুলাই ২০২৫

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের পক্ষে সংগঠনটির সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন রিটটি করেন। রিটে নৌসচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়।

‘নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে’ শিরোনামে গত ২৬ এপ্রিল প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এ প্রতিবেদনসহ এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে এনসিটি পরিচালনায় ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করার নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করা হয়।

আগের ধারাবাহিকতায় ৯ জুলাই রিটের ওপর শুনানি শেষ হয়। সেদিন আদালত ২৩ জুলাই আদেশের জন্য দিন রাখেন। ধার্য তারিখে আদালত আদেশের জন্য ৩০ জুলাই দিন রাখেন। এ অনুসারে আজ বিষয়টি আদেশের জন্য আদালতের কার্যতালিকার ৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।

আজ মধ্যাহ্নবিরতির পর আদালত আদেশ দেন। আদালত বলেন, শুধু রুল দেওয়া হলো।

আদেশের সময় রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আহসানুল করিম এবং আইনজীবী কায়সার কামাল ও আনোয়ার হোসেন উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মহাদ্দেস-উল-ইসলাম।

পরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার নতুন দায়িত্ব নিয়েছে নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড। টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাইফ পাওয়ারটেকের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৬ জুলাই দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে এ দায়িত্ব নেয় জাহাজ মেরামতের এ প্রতিষ্ঠান। প্রথমবারের মতো বন্দরে টার্মিনাল পরিচালনায় যুক্ত হলো চিটাগং ড্রাইডক।

চট্টগ্রাম বন্দরের বৃহৎ এই টার্মিনাল নির্মিত হয় ২০০৭ সালে। টার্মিনালটি নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি সংযোজনে বন্দর কর্তৃপক্ষ ধাপে ধাপে মোট ২ হাজার ৭১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের সিংহভাগ এই টার্মিনাল দিয়ে পরিবহন হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ