প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনাকে কেন্দ্র করে ঘেরাও ও অবস্থান কর্মসূচি, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য, বিএনপি ও এনসিপির পাল্টাপাল্টি অবস্থান, অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগ ভাবনা—সব মিলিয়ে কয়েক দিন ধরে দেশ একধরনের অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অনিশ্চয়তা কাটাতে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নানা তৎপরতা চলছে। তবে সরকার, রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে যে মতভিন্নতা তৈরি হয়েছে, সেটা কমেনি। কার্যত সব পক্ষ যার যার অবস্থানে অনড়। এমন অবস্থায় যেকোনো অনভিপ্রেত ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও কঠিন করে তুলতে পারে।
নির্বাচনের রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণা করা নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের দূরত্বের কথাও জনপরিসরে আলোচনা হচ্ছে। এ ছাড়া বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। দলগুলোর মধ্যে কাজ করছে নানা সমীকরণ। কিছু বিষয় অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় নানা পক্ষকে বৈরিতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন—এ নিয়ে প্রারম্ভিক আলোচনায় ভিন্নমতের কথা শোনা যায়। শুরু থেকে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে দূরত্ব বা ভুল–বোঝাবুঝির একটা কারণ বলে অনেকে মনে করেন। অতীতের কিছু ঘটনাও সন্দেহ–অবিশ্বাস তৈরিতে ভূমিকা রাখে বলে ধারণা করা হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বিতর্কিত মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতারা কীভাবে দেশ ছেড়ে পালালেন, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন, দোষারোপ ছিল এবং আছে। পুলিশ বাহিনীর ভঙ্গুর অবস্থার কারণে মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের যুক্ত রাখা হচ্ছে কি না, সেটা নিয়েও ভেতরে-ভেতরে আলোচনা ছিল।
বিএনপি ৫ আগস্টের পর থেকেই দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। পরে তা এ বছরের ডিসেম্বরের সময়সীমার মধ্যে ঠেকেছে। তবে সরাসরি এ দাবিতে তারা মাঠে নামেনি। তবে সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপির নেতা ইশরাক হোসেনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করে দলটি।
বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলোর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। দলগুলোর মধ্যে কাজ করছে নানা সমীকরণ। কিছু বিষয় অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় নানা পক্ষকে বৈরিতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।নির্বাচন প্রশ্নে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের গঠিত দল এনসিপির অবস্থান বিএনপির চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। এনসিপি আগে স্থানীয় নির্বাচন চায়। মৌলিক সংস্কার শেষ করে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে তারা। একই সঙ্গে গণপরিষদ নির্বাচনও চায় দলটি। এ ক্ষেত্রে এনসিপির সঙ্গে কিছু ইসলামপন্থী দলের বোঝাপড়া রয়েছে। পুরোপুরি না হলেও এনসিপির ভাবনার সঙ্গে জামায়াত ইসলামীর অনেক ভাবনার মিল পাওয়া যায়। আবার এনসিপির চিন্তাভাবনা ও বিভিন্ন বক্তব্যের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কারও কারও চিন্তাভাবনার মিল পাওয়া যায়। ওই উপদেষ্টারা বিভিন্ন ইস্যুতে ভেতরে–বাইরে বিশেষভাবে সক্রিয় বলে বিএনপির নেতারা মনে করেন।
এই যে শুরু থেকে রাজনীতির মাঠের বর্তমান অংশীজনদের মধ্যে একটা চাপা দূরত্ব ও মতভেদ, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমেনি; বরং ক্রমেই বেড়েছে।
সম্প্রতি রাজনীতিতে যে অস্থিরতা, এর শুরুটা সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনার পর। মামলা থাকা সত্ত্বেও স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের রাষ্ট্রপতি কীভাবে দেশ ছাড়ার সুযোগ বা ছাড়পত্র পেলেন; এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ ঘটনায় সরকার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। তবে এর শক্ত প্রভাব পড়ে রাজনীতির মাঠে। এর জেরে এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর ডাকে এবং জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণে যমুনা ঘেরাওসহ আন্দোলনের মুখে সরকার আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। সরকারের সিদ্ধান্তকে বিএনপির নেতারা স্বাগত জানালেও এ আন্দোলনে তাঁদের প্রকাশ্য উপস্থিতি ছিল না; বরং একটার পর একটা ইস্যু সামনে এনে নির্বাচন পেছানোর চেষ্টা হচ্ছে কি না, বিএনপির মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়।
এই যে শুরু থেকে রাজনীতির মাঠের বর্তমান অংশীজনদের মধ্যে একটা চাপা দূরত্ব ও মতভেদ, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমেনি; বরং ক্রমেই বেড়েছে।আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনার চার দিনের মাথায় ১২ মে হঠাৎ সেনানিবাসকেন্দ্রিক একধরনের উত্তেজনা ও নিরাপত্তা জোরদারের খবর আসে জনপরিসরে এবং তা বেশ আলোড়ন তোলে। কিছু বিষয় গুজব আকারেও সামাজিক মাধ্যমে আসে। তখন এমন খবরও নানাভাবে প্রচার পায় যে সরকারের ভেতর থেকে সেনাপ্রধানকে সরানোর চিন্তা বা চেষ্টা হচ্ছে। যদিও সরকার বা সেনাবাহিনী কোনো পক্ষ থেকেই এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
এমন একটা পরিস্থিতিতে ২০ মে দেশের ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি’ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তাঁর সরকারি বাসভবন যমুনায় উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক হয়। তাতে সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর প্রধানেরাসহ অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। ওই বৈঠকের আগে বা পরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানদের আলাদা বৈঠক হয় বলে আলোচনা আছে। তবে সরকারি সূত্র থেকে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
এমন নানা আলোচনা ও গুমোট অবস্থার মধ্যে বিএনপির নেতা ইশরাককে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে কয়েক দিন ধরে চলা আন্দোলন ২১ মে যমুনার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছায়। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করে। দলটি দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। এর পাল্টা হিসেবে এনসিপি অন্য তিনজন উপদেষ্টাকে বিএনপিপন্থী আখ্যা দিয়ে তাঁদের পদত্যাগ চায়। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবিতে কর্মসূচি দেয়।
এমন নানা আলোচনা ও গুমোট অবস্থার মধ্যে বিএনপির নেতা ইশরাককে মেয়র পদে বসানোর দাবিতে কয়েক দিন ধরে চলা আন্দোলন ২১ মে যমুনার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছায়। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করে।এ রকম একটা উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে ২১ মে ঢাকা সেনানিবাসে কর্মকর্তাদের এক সভায় (অফিসার্স অ্যাড্রেস) সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্য গণমাধ্যমসহ সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ পায়। তিনি ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেন, যা চলমান পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে।
সেনাপ্রধানের এ বক্তব্য দেশি–বিদেশি গণমাধ্যমেও প্রচার পেয়েছে। এ নিয়ে নানা আলোচনা হয়। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে বিএনপির নেতারা বক্তব্যও দেন। সেনাপ্রধানের এমন বক্তব্যকে ভিন্নমতের ইঙ্গিত হিসেবে দেখেন অন্তর্বর্তী সরকার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারণ, প্রধান উপদেষ্টা বলে আসছেন, ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এ ছাড়া করিডর, বন্দর, সংস্কারসহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়েও সেনাপ্রধান যা বলেছেন তার সঙ্গে বিএনপির বক্তব্য ও দাবির অনেকাংশে মিল রয়েছে। ফলে বিএনপি ও সেনাপ্রধানের মধ্যে একধরনের বোঝাপড়া রয়েছে কি না, বিভিন্ন মহলে সেই আলোচনাও আছে।
এমন একটা পরিস্থিতিতে ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান। সেটা প্রকাশ পেলে একটা দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। ওই রাতেই বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে এ নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
পরে ২৪ মে দুপুরে একনেকের বৈঠক শেষে অধ্যাপক ইউনূস উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকে বসেন। জানা গেছে, ওই বৈঠকে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে শক্ত মনোভাব প্রকাশ করেন। সেখানে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের বিষয়েও আলোচনা হয়। এরপর উপদেষ্টা পরিষদ যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে সরকারের শক্ত অবস্থানের বিষয়টিই স্পষ্ট হয়।
সর্বশেষ সরকারের ভেতরের বিভিন্ন সূত্র থেকে যতটা জানা যাচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর অবস্থানে অটল রয়েছেন। তিনি একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে চান। চাপ তৈরি করে যেনতেন নির্বাচন করানোর পরিস্থিতি তৈরি হলে তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।এরপর প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। সবাই অধ্যাপক ইউনূসের ওপর আস্থা রাখার কথা জানায়। তবে বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি। গত মঙ্গলবার বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না হলে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। গতকাল ঢাকায় বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশেও দলটির নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের জোরালো সমালোচনা করেন। এতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা শুরু হয়েছে। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
সর্বশেষ সরকারের ভেতরের বিভিন্ন সূত্র থেকে যতটা জানা যাচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর অবস্থানে অটল রয়েছেন। তিনি একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে চান। চাপ তৈরি করে যেনতেন নির্বাচন করানোর পরিস্থিতি তৈরি হলে তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। সবাই চায় সমঝোতার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের একটা পথ তৈরি হোক। এমন একটি পরিস্থিতিতে সরকার, রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য পক্ষগুলো কতটা দায়িত্বশীলতা ও সহনশীলতার পরিচয় দেবে তার ওপরই নির্ভর করছে দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা।অনেকে মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার, সেনাবাহিনী এবং প্রধান ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি কার্যকর আস্থার সম্পর্ক তৈরি না হওয়ায় অনিশ্চয়তা গভীর হয়েছে। দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা, গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্কার এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার, সেনাবাহিনী, বিএনপি, এনসিপি, জামায়াতসহ অন্যদের মধ্যে একটা আস্থার সম্পর্ক অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু শুরু থেকেই তা হোঁচট খেয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের ৯ মাসের মাথায় এসে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস বেড়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। সবাই চায় সমঝোতার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের একটা পথ তৈরি হোক। এমন একটি পরিস্থিতিতে সরকার, রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য পক্ষগুলো কতটা দায়িত্বশীলতা ও সহনশীলতার পরিচয় দেবে তার ওপরই নির্ভর করছে দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতা।
টিপু সুলতান: হেড অব পলিটিকস অ্যান্ড ক্রাইম, প্রথম আলো
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র ন ত পর স থ ত ত র পদত য গ র অবস থ ন একধরন র এমন একট ড স ম বর এনস প র সরক র র ত র পর ভ বন র পর য য় ন র পর প রক শ র ওপর ন একট র একট ইসল ম ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
ম্যান্ডেট নিয়ে বোঝাপড়ার ঘাটতি অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে
জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের ৯ মাসের মাথায় পরিবর্তনের ম্যান্ডেট-সংক্রান্ত বোঝাপড়া ও পরিবর্তনকামী প্রতিটি নাগরিকের মূল আকাঙ্ক্ষার জায়গাগুলো আবারও মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে আসা আপাতদৃষ্টে জরুরি হয়ে পড়েছে।
বর্তমান সরকার যে সময়টিতে দায়িত্ব নেয়, তখন বাংলাদেশ এক গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক শূন্যতা থেকে উত্তরণের আশায় বুক বেঁধেছিল। পতিত স্বৈরশাসনের ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলার পতন, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও নীতি সার্বভৌমত্বের বিসর্জন মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছিল। সেই ক্ষোভ থেকে উঠে আসে একটি বৃহৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রত্যয়। সেখানে ছাত্র–জনতা, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র বাহিনীরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সম্মিলিত প্রত্যয়ে গড়ে ওঠে নতুন এক ম্যান্ডেট। সেটি উৎসারিত হয়েছিল একটি রক্তাক্ত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে।
‘ম্যান্ডেট’ বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল ও কার্যকর তৎপরতার ওপর নির্ভরশীল। আর ম্যান্ডেটের আসল নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ‘জন–আকাঙ্ক্ষা’ ও ‘জনমনস্তত্ত্ব’। এ কথা ভুলে গেলেই বিপত্তি। কেননা তখন নাগরিকের সঙ্গে সরকারের পার্থক্যের প্রাচীর বড় হতে থাকে।
এই ম্যান্ডেট তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত, একটি স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে উত্তরণ; দ্বিতীয়ত, কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং তৃতীয়ত, জনগণের বিশ্বাস পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি কার্যকর ও পক্ষপাতমুক্ত প্রশাসনিক উপস্থিতি। এর কোনো লিখিত দলিল ছিল না; বরং ছিল একটি যৌথ উপলব্ধির রাজনৈতিক চুক্তি। সেটাকে আমরা একটি জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি বলতে পারি।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই ম্যান্ডেট আজ একেকজনের কাছে একেকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, যা জাতীয় ঐক্যের চেতনাকে ভেঙে দিচ্ছে। কোনো পক্ষই এককভাবে এই ম্যান্ডেটের দাবিদার নয়। এটি এসেছে জনতার কণ্ঠস্বর থেকে, যেখানে রাজনৈতিক দল, ছাত্রসমাজ ও সশস্ত্র বাহিনী একযোগে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
ম্যান্ডেটের একটি মুখ্য অনুষঙ্গ ছিল কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। এটি নিছক প্রশাসনিক পরিমার্জন নয়, বরং গণতন্ত্রের ভিত্তিকে পুনর্নির্মাণের একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই সংস্কার-প্রক্রিয়া এখন এক গভীর ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। সরকার বিভিন্ন কমিশন, শ্বেতপত্র কমিটি, টাস্কফোর্স এবং পরামর্শ সভার মাধ্যমে একটি আমলাতান্ত্রিক কর্মকৌশল নির্মাণ করেছে ঠিকই কিন্তু বাস্তবতার জমিনে সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। সংস্কার শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে সর্বত্র, কিন্তু তার কার্যকরী রূপ ও অগ্রাধিকার বিষয়ে রয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। সংস্কার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েও একধরনের দোদুল্যমানতা দেখা যাচ্ছে। সেখানে অদক্ষতার ছাপ সুস্পষ্ট। ‘সংস্কার প্রকল্প’ জনপরিসরের যুক্ত করার অর্গানিক কাঠামোগত উদ্যোগও অনুপস্থিত। ‘জন–আকাঙ্ক্ষা’র সঙ্গে তার কোনো জোরালো মিথস্ক্রিয়াও দৃশ্যমান নয়।
রাজনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে মাত্র কয়েকটি প্রশ্ন। যেমন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে আনা যায়, সংসদ কতটা কার্যকর হবে, সংসদীয় সংস্কার কেমন হবে। অথচ গত দেড় দশকের স্বৈরশাসন চারটি স্তম্ভের ওপর নির্মিত হয়েছিল—অতি ক্ষমতায়িত প্রধানমন্ত্রী, এলাকাভিত্তিক ‘এমপি রাজ’, কেন্দ্রীয় সরকারের সামনে স্থানীয় সরকারকে অধস্তন কর্মচারীতে রূপান্তর এবং স্বৈরশাসনের প্রয়োজনে পুলিশ ও প্রশাসনের চেইন অব কমান্ডের সার্বিক পতন। শেষোক্ত তিনটি প্রশ্নে সংস্কারের আলোচনা প্রায় অনুপস্থিত।
আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে প্রশাসনিক সংস্কারে। প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কারের যে সুপারিশগুলো এসেছে, সেখানে যথেষ্ট প্রায়োগিক দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। অথচ জনগণ তাদের জীবনে রাষ্ট্রের মুখোমুখি হয় এই প্রায়োগিক স্তরেই। এখানেই স্বৈরশাসনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা জমা হয়। একজন এসপি কেন্দ্রের ইশারায় তাঁর ঊর্ধ্বতনকে পাশ কাটিয়ে কাজ করেন কিংবা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষককে ভোরে তুলে নেওয়া হয় রাজপথে আন্দোলন করার জন্য। সংস্কার যদি এই স্তর পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে, তাহলে কাঠামোগত পরিবর্তন ততটা ফলপ্রসূ হবে না।
সংস্কার বাস্তবায়নের কর্মপরিকল্পনা নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, একাধিক কমিশনের রিপোর্ট দাখিল করা হলেও সেগুলোর ভিত্তিতে সরকার কোন সংস্কারগুলো প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়ন করবে, তা স্পষ্ট নয়। এখানে রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে প্রশাসনিকভাবে কিছু কাজ এগিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন এবং যথাসময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারার সংকট সংস্কারকে জনসমক্ষে একটি অলৌকিক প্রক্রিয়ায় পরিণত করেছে। এ ছাড়া সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য একটি অতিমাত্রায় ব্যবহৃত শব্দ হয়ে উঠেছে। অথচ এই ঐকমত্য তৈরির প্রক্রিয়াটা অসম্পূর্ণ, সময়সাপেক্ষ ও আমলাতান্ত্রিক করে তোলা হয়েছে। এর ফলে সংস্কার কার্যক্রম বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সংস্কার নিয়ে ক্রমেই জনগণের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
পুরো প্রক্রিয়া থেকে একটি প্রশ্ন সামনে আসছে—সংস্কারের আলোচনাগুলো কি কেবল একটি সাইড শো হয়ে যাচ্ছে? জনগণ কীভাবে বুঝবে যে তাদের আকাঙ্ক্ষামতো সংস্কার হচ্ছে? মানুষ তো প্রশাসন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা বিচারের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতায় কী পরিবর্তন হচ্ছে, তার বাস্তব প্রতিফলন দেখতে চায়। সংস্কারের এই ছন্দপতন আজকের সংকটের আরেকটি বড় স্তম্ভ।
সংস্কার ও ম্যান্ডেট বিষয়ে বিভ্রান্তির পাশাপাশি আরেকটি সংকটও আমাদের ঘিরে ধরেছে। জনগণ, বিশেষ করে তরুণসমাজ, একটি নির্দিষ্ট প্রত্যয়ের ভিত্তিতে পরিবর্তনের যাত্রায় অংশ নিয়েছিল। তারা রক্ত দিয়েছে, বিপদের মুখে দাঁড়িয়েছে এই প্রত্যাশায় যে সমাজ বদলাবে, রাষ্ট্র তাদের কণ্ঠ শুনবে, সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা আজ কতটুকু পূরণ হচ্ছে?
তরুণদের প্রতি যে আশা উচ্চারিত হয়েছিল, তার বিপরীতে তাদের দুঃখ-কষ্টগুলো উপেক্ষিত হচ্ছে। আমরা বলেছি, তারুণ্যই শক্তি। কিন্তু তারা যে বেকারত্ব, অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনুপ্রাণিত না হওয়ার সামাজিক ক্লান্তির শিকার—এই কথাগুলো এখন আর বলা হচ্ছে না। পরিবর্তনের সহযাত্রী নারীরা অনিশ্চয়তায় পড়ে যাচ্ছে। তাদের ন্যায্য ও যোগ্য চাওয়াগুলো পেছনে পড়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থানের ঘাটতি, শিক্ষার গুণগত সংকট এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনার অভাব তরুণদের মধ্যে এক বিষণ্নতা তৈরি করেছে। তারা জানে, সবকিছু এক দিনে বদলায় না, কিন্তু তারা দেখতে চায় কাল, পরশু বা আরও পরে পরিবর্তনের নিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে কি না। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আজ অনুপস্থিত।
এদিকে সরকারের ভাষা ও মনোভাব থেকে উঠে আসছে একধরনের আত্মমগ্ন, ক্ষমতাশালী অবস্থান, যা সংকটকে উসকে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে। একই সঙ্গে গেড়ে বসা গোষ্ঠীস্বার্থ সংস্কার পদক্ষেপকে বিভ্রান্ত করতেও ক্রিয়াশীল। গোষ্ঠীস্বার্থ নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উদ্যোগের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। শাসনের ক্ষেত্রে যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকার কথা, তার বদলে আমলাতান্ত্রিক অলসতা কাজ করছে। যার ফলে গণমানুষের কষ্ট নিরসনের পরিবর্তে একধরনের সংকীর্ণতা ও রুদ্ধতা জন্ম নিচ্ছে।
ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি কমানো—সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারের নিঃসন্দেহে কিছু অর্জন আছে। কিন্তু দারিদ্র্য বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বহু মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। মূল্যস্ফীতিও ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে থেকে যাচ্ছে অথচ মজুরি বাড়ছে না। এই বাস্তবতায় সরকারের অগ্রগতি পর্যালোচনায় যদি জনগণের মধ্যে অনীহা জন্ম নেয়, তাহলে সেটিকে স্বাভাবিক ভাবলে চলবে না। এটি একধরনের আত্মিক বিচ্ছিন্নতাও।
স্বৈরশাসনের কুফলগুলোর পুনর্জন্ম, নীতি–সার্বভৌমত্ব আবারও অনিশ্চিত হয়ে ওঠা, অনৈতিক গোষ্ঠীতন্ত্রের জাঁতাকলে বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ গতিপথ হারানো, অমানবিক ও অকার্যকর রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিকতাই গেড়ে বসে থাকা—এর কোনোটাই ফিরে আসুক, সেটা বাংলাদেশের জাগ্রত জনগণ চান না। উপরিকাঠামোর পদচারীদের এই সর্বজনীন প্রত্যয়ের দিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি। শুধু মনোযোগী নয়, আস্থা নির্মাণ করে কার্যকর হওয়াও সমানভাবে জরুরি।
● ড. হোসেন জিল্লুর রহমান অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
* মতামত লেখকের নিজস্ব