‘ও আল্লা গো। উ...হু,। ও মাগো...’—এভাবেই থেমে থেমে চিৎকার করছিলেন এক নারী। পাশে দাঁড়িয়ে ওই নারীর হাত-পা চেপে ধরে আছেন আরেক নারী। অন্যদিকে এক যুবক ওই নারীর হাতের কেটে যাওয়া গভীর অংশে ড্রেসিং করছিলেন। পরে যুবকটি হাতে ব্যান্ডেজও করে দেন। তবে চিকিৎসা শেষেও নারীর চিৎকার-গোঙানি থামছিল না।

এটি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের দৃশ্য। হাসপাতালে গিয়ে গত সোমবার দুপুর ১২টা ৫১ মিনিটে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে গেলে চেয়ারে বসে থাকা দায়িত্বরত চিকিৎসক ও তাঁর পাশে দাঁড়ানো নার্স বাধা দেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ড্রেসিংয়ের কাজ করা যুবকটি হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়। তাঁর নাম জাকারিয়া হোসেন।

দুর্ঘটনায় হাত কেটে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ওই নারীর সঙ্গে এক যুবকও ছিলেন। এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই যুবক তীব্র গোঙানি শুনে ভেতরে ঢুকে চিকিৎসকের কাছে কারণ জানতে চান। হাতের কেটে যাওয়া অংশে সেলাই করার আগে নারীকে কেন ‘লোকাল অ্যানেসথেসিয়া’ দেওয়া হয়নি এবং চিকিৎসক কেন নিজে সেলাই করলেন না, এ নিয়ে যুবকটি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। দায়িত্বরত চিকিৎসক যুবককে জানান, ‘অ্যানেসথেসিয়া দিয়েই নারীর সেলাই হয়েছে। একটু-আধটু ব্যথা হবেই।’ এমন জবাবে যুবক ও চিকিৎসকের মধ্যে কিছুক্ষণ মৃদু বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। পরে যুবকটি বাইরে চলে যান।

যুবক বাইরে চলে যাওয়ার পর চিকিৎসকের কাছে এ প্রতিবেদক প্রশ্ন রাখেন, ‘তাহলে কি ওয়ার্ডবয় সেলাই করেছেন? ড্রেসিংয়ের কাজ ওয়ার্ডবয় কেন করছিলেন?’ প্রশ্নের জবাবে জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক সৈয়দ মইনুল হাসান বলেন, ‘কখনো ওসমানী কিংবা অন্য বড় হাসপাতালে গিয়েছেন? যাননি মনে হয়! তাহলে জানবেন কীভাবে? ওয়ার্ডবয় এমন কাজ সবখানেই করেন।’ তবে তিনি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া আর কোনো কথা বলতে চাননি।

জরুরি বিভাগ থেকে এই প্রতিবেদক যান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো.

সালাহ্উদ্দিন মিয়ার কক্ষে। জরুরি বিভাগের ঘটনাটি তাঁকে বলেন। সব শুনে তিনি বলেন, ‘আসলে হাসপাতালে তীব্র লোকবলের সংকট। চিকিৎসকের সংকট। তাই ব্যান্ডেজ দেওয়ার কাজটি অনেক সময় ওয়ার্ডবয় করেন। তবে তাঁরা (ওয়ার্ডবয়) সেলাই দেন না। কেবল ড্রেসিং করেন। রোগীর সেবার স্বার্থেই ওয়ার্ডবয়দের দিয়ে এ কাজ করাতে হয়।’

সালাহ্উদ্দিন মিয়া জানান, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতলে গড়ে প্রতিদিন ৫০ জন রোগী ভর্তি থাকেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগে প্রতিদিন অন্তত ৩৫০ থেকে ৪০০ জন চিকিৎসা নেন। হাসপাতালে তীব্র লোকবলের সংকট সত্ত্বেও আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁরা চিকিৎসা দিচ্ছেন। তবে লোকবলের সংকটে ছয় মাস ধরে অপারেশন থিয়েটার (ওটি) বন্ধ। ল্যাব টেকনোলজিস্ট না থাকায় সব ধরনের যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা যথাযথভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। যক্ষ্মা (টিবি) রোগের যিনি পরীক্ষা করেন, তাঁকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে সীমিত পরিসরে ল্যাবের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

ওয়ার্ডের শয্যায় খুব বেশি রোগী নেই। গত সোমবারের ছবি

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক র করছ ল ন য বকট

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ