ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের সিরাজগঞ্জ অংশের কাজ চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। নানা কারণে এই অংশের ৪৭ দশমিক ৮ কিলোমিটারে বছরজুড়ে দুর্ভোগ লেগে থাকে। আসন্ন ঈদুল আজহা সামনে রেখেও দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ২২ জেলামুখী মানুষকে বিপাকে পড়তে হতে পারে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জমি অধিগ্রহণ ও পাথর আমদানির জটিলতা, ডলারের দর বাড়ার পাশাপাশি বিল বাড়িয়ে নিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কৌশলগত বিলম্বের দিকে আঙুল তুলেছেন। 
এ সড়কে যাত্রী দুর্ভোগের সাক্ষী প্রধানত পরিবহন কর্মীরা। এ বিষয়ে সম্প্রতি কথা হয় সিরাজগঞ্জ-রংপুর রুটে চলাচলকারী জেনিন সার্ভিসের সুপারভাইজার শাওন আহম্মেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, মহাসড়কের দুই পাশের পার্শ্বরাস্তার (সাইড লেন) কাজ শেষ হয়নি। যে কারণে তিন চাকার ছোট ছোট যানবাহন মূল মহাসড়ক 
ধরেই দাপিয়ে বেড়ায়। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা এ বিষয়ে তেমন তৎপর নন। 
টাঙ্গাইল জেলার এলেঙ্গা থেকে রংপুর পর্যন্ত মহাসড়কের ১৯০ কিলোমিটার সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক-২) প্রকল্পের অংশ। এ পথেই পড়েছে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা জেলা। এই প্রকল্পের আওতায় আগের মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার কাজটি শুরু হয় ২০১৬ সালে। কয়েক দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কাজটি শেষ করার কথা। সব মিলিয়ে প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির ১৩টি প্যাকেজের মধ্যে দুটি পড়েছে সিরাজগঞ্জে। ৬ নম্বর প্যাকেজে পড়েছে যমুনা সেতুর পশ্চিম গোলচত্বর থেকে হাটিকুমরুল মোড় পর্যন্ত ১৯ দশমিক ৮ কিলোমিটার অংশ। এই কাজটি বাস্তবায়ন করছে মীর আকতার লিমিটেড। ইতোমধ্যে তারা ৭৯৩ কোটি টাকা বিলের মধ্যে ৭৬০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। ৭ নম্বর প্যাকেজের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম লিমিটেড। এ প্যাকেজে পড়েছে হাটিকুমরুল মোড় থেকে চান্দাইকোনা পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার। এই অংশের নির্মাণব্যয় ধরা হয় ১১৭৯ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৮৯০ কোটি টাকার বিল পেয়েছে। আরও ৪০ কোটি টাকার বিল প্রক্রিয়াধীন। 
উভয় প্যাকেজের কাজ ৮০-৮২ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর দাবি। তবে যমুনা সেতু-হাটিকুমরুল অংশের ঝাঐল ওভারপাস, ইকোনমিক জোন ওভারপাস, বাইলেন বা পার্শ্বরাস্তা নির্মাণ, রাস্তার উপরিভাগে দুই স্তরের বিটুমিন বা সিমেন্টের আবরণ, রোড-মার্কিং এখনও অসম্পূর্ণ। হাটিকুমরুল-চান্দাইকোনা অংশে পার্শরাস্তাসহ অন্যান্য কাজ বাকি। যে কারণে ঢাকা ও উত্তরের যাত্রীরা সিরাজগঞ্জের অংশ দুটিতে চার লেনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। 
এর বাইরেও একই প্রকল্পের গাইবান্ধার পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ অংশের কাজেও ধীরগতি দেখা গেছে। ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তৌহিদুজ্জামান ইমনের বাড়ি দিনাজপুরে। প্রতি মাসেই বাড়িতে যেতে হয় তাঁকে। এ পথের দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ীসহ সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা, হাটিকুমরুল, ভূঁইয়াগাতী, হাটিকুমরুল মোড় এবং ঝাঐল অংশে এখনও প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়নি।
সম্প্রতি সরেজমিন সিরাজগঞ্জের দুটি অংশেই দেখা যায়, মহাসড়কের কোথাও বিটুমিনের প্রথম স্তর, কোথাও দ্বিতীয় স্তর দেওয়া হয়েছে। কোথাও তৃতীয় স্তরের আবরণ পড়েনি। বাইলেন সম্পন্ন হয়নি কোনো জায়গাতেই। এমনকি রোড মার্কিংও করা হয়নি। এর বাইরে ঝাঐল ওভারপাসের চার লেনের মধ্যে দুটি লেন চলতি বছরের ২০ মার্চ খুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি দুই লেন এখনও নির্মাণাধীন। ইকোনমিক জোন ওভারপাসটি অসম্পূর্ণ।
এ বিষয়ে কথা হয় সিরাজগঞ্জ জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আসলাম উদ্দিনের সঙ্গে। তাঁর ভাষ্য, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতার কারণে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ অংশে সমস্যা ছিল। কিন্তু সিরাজগঞ্জে এই সমস্যা ছিল না। হাটিকুমরুল মোড় থেকে চান্দাইকোনার অংশ নির্মাণের ধীরগতি কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এই শ্রমিক নেতার অভিযোগ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গড়িমসি ও ধীরগতি জেনেও ব্যবস্থা নেয়নি সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। 
তিন চাকার যান মহাসড়কে ঝুঁকি তৈরি করছে। কিন্তু পার্শ্বরাস্তা নির্মাণে সাসেক প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বারবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে বলে জানান হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুর রউফ। তিনি বলেন, পার্শ্বরাস্তা তৈরি না হওয়ায় তিন চাকার যানবাহন মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা প্রায়ই ধরে ধরে মামলা দিচ্ছেন, আটকে থানায় রাখছেন। এর পরও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। একই রকম 
মন্তব্য করেন বগুড়া হাইওয়ে পুলিশের এসপি মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ। তাঁর কথা, পার্শ্বরাস্তা নির্মিত হলে মহাসড়কে তিন চাকার ক্ষুদ্র যানবাহন চলতে দেওয়া হবে না।
৬ নম্বর প্যাকেজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আকতার লিমিটেডের প্রধান প্রকৌশলী একলাছ উদ্দিনের ভাষ্য, ঝাঐল ওভারপাসের একটি অংশের দুটি লেন খুলে দেওয়া হয়েছে। আগস্ট মাসের মধ্যে বাকি অংশ খুলে দেওয়া হবে। ঝাঐল ওভারপাস ও সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনের ওভারপাসের নকশায় পরিবর্তনের কারণে কিছুটা দেরি হয়েছে। তাদের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বাকি কাজও শেষ হবে। 
এ অংশের তদারকের দায়িত্বে থাকা যমুনা সেতু রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল কবির পাভেলের নম্বরে কল দিলেও ধরেননি।
প্রকল্পে গড়িমসির বিষয়ে ৭ নম্বর প্যাকেজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিমের নম্বরে কল দিলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি ছাড়া বক্তব্য দিতে রাজি হননি। একই প্রতিষ্ঠানের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম মাইন উদ্দিন মোনেমের দাবি, ‘৮৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগস্ট মাসের নির্ধারিত তারিখের মধ্যে বাকি কাজও শেষ হবে, ইনশাআল্লাহ।’  
সাসেক প্রকল্পের উপপরিচালক সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের ভাষ্য, ‘আবদুল মোনেম লিমিটেডকে পাঁচ দফায় সুযোগ দিতে সময় বাড়ানো হয়। এর পরও গতি বাড়াতে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে।’
এমন ধীরগতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সিরাজগঞ্জ জেলা স্বার্থ রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নব কুমার কর্মকার। তাঁর ভাষ্য, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গড়িমসিতে প্রকল্পে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। এতে খরচও বেড়েছে, তবে চালক ও যাত্রীদের দুর্ভোগ কমেনি। 
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীদের সমন্বয়হীনতায় বিব্রত বোধ করছেন বলে জানান প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড.

ওয়ালিউর রহমান। তিনি বলেন, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের সময় আছে। আগস্টের মধ্যে কাজ শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কোনোভাবেই আর সময় বাড়ানোর সুযোগ নেই। তাঁর ভাষ্য, ১৩টি প্যাকেজের কাজে অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ীতে কাজ শুরু করতেই দেরি হয়। সেখানে ওভারব্রিজের কাজ চলছে। সার্ভিস লেনও চালু হয়েছে। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা থেকে রংপুর পর্যন্ত মাত্র আড়াই ঘণ্টায় যাওয়া যায়। ডিসেম্বরের মধ্যেই সন্তোষজনক অগ্রগতির আশা করছেন। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প র শ বর স ত স র জগঞ জ র গ ব ন দগঞ জ প রকল প র প রক শ র চ লক ধ রগত

এছাড়াও পড়ুন:

টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য

‘কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজের’ শিরোনামে ২৭ জুলাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ‘৫-জি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদনটির প্রতিবাদ পাঠানো হয় ২৮ জুলাই।

প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রকল্পটি নিয়ে করা প্রতিবেদনে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে জড়িয়ে যে ‘অভিযোগ ও ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ মন্তব্য করা হয়েছে, তা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন। এতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে ফয়েজ আহমদের মানহানি করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিরুদ্ধ।

টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রতিবাদপত্রে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছে। নিচে সেই সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো উল্লেখ করে প্রতিবেদকের বক্তব্য তুলে ধরা হলো।

আরও পড়ুনদুর্নীতির অভিযোগে কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজ আহমদের২৭ জুলাই ২০২৫

এক. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ফয়েজ আহমদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানাধীন একটি প্রকল্পের কার্যক্রম ‘এগিয়ে নিতে’ বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছেন। বাস্তবতা হলো, বিটিসিএলের ৫–জি রেডিনেস প্রকল্পে ২৯০ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) পূর্ববর্তী সরকারের আমলে চূড়ান্ত হয়েছে। সেই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো বাস্তবসম্মত পথ নেই। এবং এসব যন্ত্রপাতি গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ অর্থই রাষ্ট্রের অপচয়ে পরিণত হবে।

টেলিযোগাযোগ বিভাগ আরও বলেছে, ফয়েজ আহমদ শুধু অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে, আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে দুদকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করেছেন, যেখানে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিও তিনি তুলে ধরেছেন। এটি দুর্নীতির ‘সহযোগিতা’ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় দায়িত্বশীল পদক্ষেপ।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে বিটিসিএল একটি বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুদকের অনুসন্ধানাধীন প্রকল্পের বাকি কাজ এগিয়ে দিতে আইনগত মতামত নেয় (২৭ মার্চ, ২০২৫)। যদিও এ ধরনের আইনগত মতামত দেওয়ার জন্য বিটিসিএলের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল রয়েছে। বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রথমে ইতিবাচক মতামত দিলেও পরে (৮ এপ্রিল, ২০২৫) দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পেরে সতর্ক করে দেয় যে তদন্তাধীন প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

দুদক চিঠি দিয়ে বিটিসিএলকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় (১৮ জুন, ২০২৫) যে তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ক্রয় আইনের লঙ্ঘন পাওয়া গেছে। তাই কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিলে আইনের ব্যত্যয় হবে এবং অর্থ ব্যয় আইনসিদ্ধ হবে না। দুদক তাদের মতামত জানানোর পরও ফয়েজ আহমদ আবার (২২ জুন) সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

দুদকের নেতিবাচক মতামতের পরও কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া টেলিযোগাযোগ বিভাগের (প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা) দাবিকে সমর্থন করে না। ফয়েজ আহমদ দুদককে দ্রুত অনুসন্ধান শেষ করার অনুরোধ করতে পারতেন। অনুসন্ধান শেষ হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারতেন। বিটিসিএলের ওই প্রকল্পে দুদক গত ৯ জানুয়ারি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অনুসন্ধান নিশ্চয়ই বছরের পর বছর চলবে না। কেনাকাটায় আর কিছুদিন দেরি হলে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে, এ দাবি যৌক্তিক নয়।

‘দুর্নীতি সহায়ক’ বক্তব্যটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতামত, প্রথম আলোর নয়।

দুই. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, প্রয়োজনের চেয়ে ৫ গুণ সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নিয়ে অর্থ অপচয়ের চেষ্টার অভিযোগ অসত্য। প্রতিবাদপত্রে কারিগরি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের চাহিদা বিবেচনা করা হয়নি। সেসব বিবেচনায় নেওয়া হলে যন্ত্রপাতির সক্ষমতা ২৬ টিবিপিএস (টেরাবাইট পার সেকেন্ড) নয়, ১২৬ টিবিপিএসের প্রয়োজন হবে। ফাইভ-জি প্রকল্পে ১২৬ টেরাবাইট ক্ষমতা ‘রিডান্ডেন্ট’সহ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে কোনো যন্ত্রপাতি বা সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকার সুযোগ নেই।

প্রতিবাদপত্রে আরও বলা হয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ২০২১ সালে প্রণীত বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্পের একটি সমীক্ষায় মতামত দেয় যে শুধু আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ যদি ২৬ টিবিপিএস হয়, তাহলে সব মিলিয়ে ‘সিস্টেমের লাইন ক্যাপাসিটি’ ১২৬ টিবিপিএস প্রয়োজন হবে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: এই প্রকল্প নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুই হলো ‘দরপত্রের শর্তানুযায়ী দরদাতাদের মূল্যায়ন না করে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি লঙ্ঘনপূর্বক শুধু প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্যের ভিত্তিতে তিনজন দরদাতাকেই কারিগরিভাবে রেসপনসিভ (যোগ্য) ঘোষণা করাসহ নন-রেসপনসিভ দরদাতাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সক্ষমতার পাঁচ গুণ বেশি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতিসাধনের অভিযোগ।’ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এ ‘অভিযোগ’ই শুধু তুলে ধরা হয়েছে।

তা ছাড়া ২০৩০ সাল পর্যন্ত যে ২৬ টিবিপিএস চাহিদা নিরূপিত হয়েছিল, কিন্তু কেনা হচ্ছে ১২৬ টেরাবাইট—এটা ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত বিটিসিএলের ২১৩তম পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীতে রয়েছে। পাশাপাশি তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে টেলিকম যন্ত্রপাতিও অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এ কারণে দীর্ঘ সময় যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য থাকে না। সাধারণভাবে টেলিকম যন্ত্রপাতির সর্বোচ্চ ব্যবহারযোগ্য আয়ুষ্কাল সাত বছর ধরা হয়। এই দরপত্রের ক্ষেত্রেও কারিগরি নির্দেশে যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল সাত বছর নির্ধারিত রয়েছে। তিনি সাবধান করেছিলেন যে ২০৪০ সাল পর্যন্ত চাহিদা পূরণে বেশি সক্ষমতার যন্ত্রপাতি চাওয়া হলেও বাস্তবে তা সচল থাকার নিশ্চয়তা ২০৩০ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি কেনা হবে, তার একটি বড় অংশই ২০৩০ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হবে না এবং ব্যবহারের পূর্বেই মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।

বিগত সরকারের সময় অতিরিক্ত সক্ষমতার যন্ত্র কেনার অনুমোদন না দেওয়ার কারণেই আসাদুজ্জামানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

তিন. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, দুদকের ওপর প্রভাব বিস্তারের দাবি তথ্যভিত্তিক নয়। দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা এবং চিঠি পাঠানো একটি প্রাতিষ্ঠানিক, নীতিগত এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অংশ। এর মধ্য দিয়ে কোনোভাবেই সংস্থাটির ওপর ‘প্রভাব বিস্তার’ করা হয়নি; বরং তদন্তকাজ চলমান রাখতে এবং যন্ত্রপাতি গ্রহণের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে একটি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে। তা ছাড়া বিশেষ সহকারীর দুদকে প্রেরিত আধা সরকারি পত্রের বক্তব্যকে প্রকল্পের কেনাকাটা করতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ বলে প্রচার করা হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এটা অপসংবাদিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: টেলিযোগাযোগ বিভাগের এক নম্বর পয়েন্টেও একই বিষয়ে বলা হয়েছে। সেখানেই প্রতিবেদকের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছতার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ বিভাগের এই বক্তব্য আবার উল্লেখ করা হলো। এখানে বলে রাখা দরকার, দুদকের স্পষ্ট মতামত পাওয়ার পরও চেয়ারম্যানকে দ্বিতীয় দফা চিঠি দেওয়া এবং অভিযোগকে ‘সত্য নয়’ বলে দাবি করা স্বাধীন সংস্থাটিকে প্রভাবিত করারই চেষ্টা। দুদকের মতামত যাতে কেনাকাটার পক্ষে পরিবর্তিত হয়, সে জন্যই ফয়েজ আহমদ দ্বিতীয় দফা আধা সরকারি পত্র দিয়েছিলেন এবং তিনি সেখানে দুদক চেয়ারম্যানের ‘ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা’ কামনা করেন।

চার. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে কারখানা পরিদর্শন ও জিও (সরকারি আদেশ) জারির প্রেক্ষাপট চেপে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেই জিও অনুমোদন না হওয়ায় চীনে কারখানা পরিদর্শনের জন্য প্রতিনিধিদল পাঠানো সম্ভব হয়নি। সরকারের নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী, যখন কারখানা পরিদর্শন সম্ভব নয়, তখন পণ্য সরবরাহ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জাহাজীকরণ করা যেতে পারে—বিষয়টি সচেতনভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্রের নিয়মানুযায়ী কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা বিটিসিএলের চারজন প্রকৌশলীর। সেখানে নিয়মবহির্ভূতভাবে চারজনের জায়গায় পাঁচজনকে কারখানা পরিদর্শনে পাঠানোর জন্য জিও জারির অনুরোধ করা হয়। নতুন দলে বিটিসিএলের প্রকৌশলী রাখা হয় দুজন আর টেলিযোগাযোগ বিভাগের তিনজন। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে তাঁদের চীন সফরে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। যদিও তাঁদের চীনে যাওয়া হয়নি। কারণ, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জিও (সরকারি আদেশ) জারির বিষয়টি আটকে দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গত ৯ ডিসেম্বর বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে সাধারণভাবে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে নির্দেশনার ৯ নম্বরে কেনাকাটা, জাহাজীকরণের আগে কারখানা পরিদর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কেবল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ প্রেরণের বিষয় বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ফ্যাক্টরি একসেপটেন্সের’ জন্য বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ নয়। আরও উল্লেখ্য যে এই কেনাকাটার জন্য কারখানায় যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জিও গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ২৪ সেপ্টেম্বর তা বাতিল করা হয়। ২৪ অক্টোবর (২০২৪) বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ প্রকল্প নিয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বছরের ৬ জানুয়ারি সেই তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠাতে বলে।  

পাঁচ. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ফয়েজ আহমদের চীন সফর নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। এতে চীন সফরের ব্যাখ্যা এবং এর সরকার অনুমোদিত বৈধতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এটিকে ‘অপরিচিত সংস্থার অর্থে’ পরিচালিত বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ এটি ছিল সরকারি অনুমোদিত সফর, যার উদ্দেশ্য ছিল তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অর্জন ও অবকাঠামোগত সক্ষমতা পর্যালোচনা।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: এ সফর সরকারের অনুমোদনহীন, তা প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে, জিওতে উল্লিখিত ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন মেম্বারস ইন বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি অপরিচিত। তবে ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন রয়েছে। উল্লেখ্য, ওই সফরে বিশেষ সহকারীর একান্ত সচিব সফরসঙ্গী ছিলেন, যা সরকারের বিদেশ ভ্রমণবিষয়ক নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ নির্দেশনায় একান্ত সচিবদের জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত সঙ্গে নেওয়া পরিহার করতে বলা হয়েছে।

ছয়. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বাস্তবতা বিশ্লেষণ না করে শুধু প্রাক্তন আমলাদের বক্তব্য, বাতিল হওয়া দরপত্র এবং অনুমাননির্ভর ব্যাখ্যা দিয়ে ফয়েজ আহমদের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে নিজের অবস্থান গণমাধ্যমে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যার কিছু অংশ প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের প্রতি উত্তরের অনুপস্থিতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ১৬ জুলাই ফয়েজ আহমদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। পরে ফয়েজ আহমদকে ফোন করা হয় এবং খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ফোনে বিষয়টি জানানো হয়। ২০ জুলাই আইসিটি বিভাগে গেলে অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে জানানো হয়, ফয়েজ আহমদ অফিসে উপস্থিত নেই। তখন আইসিটি বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠাবেন বলে জানান। তিনি পাঠাননি। পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ৭ জুলাই ফয়েজ আহমদ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সেটাই তাঁর বক্তব্য। উল্লেখ্য, ফয়েজ আহমদের আগের বক্তব্যের চুম্বক অংশ প্রতিবেদনে রয়েছে। পাশাপাশি ৭ জুলাই তা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে অনুমাননির্ভর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

সাত. টেলিযোগাযোগ বিভাগ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে দুজন কারিগরি ও দুজন ক্রয় বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ (ব্যয়ের বিপরীতে সুফল পর্যালোচনা) কমিটি গঠন করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ করা হয়েছে কি না, সেটা প্রথম আলোকে দেওয়া বক্তব্যে জানতে চেয়েছিলেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।

আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, প্রথম আলোর প্রতিবেদন মোটেও ‘ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ নয়, এটা ‘বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন’ও নয়; বরং প্রথম আলোর প্রতিবেদন সঠিক এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র প্রথম আলোর কাছে আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ