সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী আছেন। এর জেরে দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের মধ্যে ভেতরে–ভেতরে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আছে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও। তবে নেতাদের একে অন্যের প্রতি ক্ষোভ আর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশে কর্মী-সমর্থকেরাও এখন দ্বিধাবিভক্ত। সব মিলিয়ে নগরকেন্দ্রিক সিলেট বিএনপির রাজনীতিতে বিভেদ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্থানীয় বিএনপির পুরোনো কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গণ–অভ্যুত্থান–পূর্ববর্তী সময়ে নেতাদের ভেতরে–ভেতরে দ্বন্দ্ব-বিভেদ থাকলেও তা খুব একটা সামনে আসেনি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর নানা ঘটনায় নেতাদের মধ্যে বহুদিনের জিইয়ে থাকা বিভেদ প্রকাশ্যে আসে।

সর্বশেষ গত শুক্রবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে সিলেট মহানগর বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় এমন বিভেদ দেখা গেল। সেখানে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সামনেই বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এবং মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। তাঁরা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এর বাইরে ওই সভায় মহানগর বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের ‘অবমূল্যায়নের’ অভিযোগও উঠেছে।

এ ছাড়া গত ২০ মে বিএনপির নেতাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এক মতবিনিময় সভা হয়। সভা চলাকালে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরীর মুঠোফোনে সিলেট সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগদলীয় সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ‘কল’ এসেছে—এমন তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ইমদাদ হোসেন ওই রাতেই জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘটনায় মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও তাঁর অনুসারীদের অভিযুক্ত করেন।

তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সামনেই বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়ান আরিফুল হক চৌধুরী ও রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। তাঁরা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী।

ইমদাদের অভিযোগের পরই ফেসবুকে দুই পক্ষের অনুসারীরা পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাস দেওয়ার পাশাপাশি একে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে নগরের একটি রেস্তোরাঁয় অনুসারী নেতাদের নিয়ে সভা করেছেন ইমদাদ হোসেন। এ নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়।

স্থানীয় বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, মহানগর বিএনপিকেন্দ্রিক সাম্প্রতিক দুটি কর্মকাণ্ডে দলের ভেতরে-বাইরে নানামুখী আলোচনা চলছে। বিশেষ করে দলের প্রতিষ্ঠাতার শাহাদাতবার্ষিকীর আলোচনা সভায় মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান দলের একজন প্রবীণ নেতা ও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আরিফুল হকের নির্দেশনামূলক কথার পৃষ্ঠে ‘কাউন্টার কথায়’ জড়িয়ে রীতিমতো ‘বেয়াদবি’ করেছেন বলে অনেকে মনে করছেন।

আরিফুল হকের অনুসারীদের দাবি, দলের প্রতিষ্ঠাতার শাহাদাতবার্ষিকীর সভায় কেন মহানগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা অনুপস্থিত—এমন প্রশ্ন তুলে আরিফুল হক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। দলের সাংগঠনিক স্বার্থে একজন প্রবীণ নেতার রাখা এমন বক্তব্যের বিষয়টি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ না করে রেজাউল হাসান আঙুল নেড়ে নেড়ে ‘কাউন্টার ও অ্যাগ্রেসিভ বক্তব্য’ দিয়ে আলোচনায় আসার চেষ্টা করেন। এটা ‘ধৃষ্টতাপূর্ণ’।
তবে রেজাউল হাসানের অনুসারীদের দাবি, আরিফুল হক প্রায়ই মহানগর বিএনপির খুঁত ধরে বিভিন্ন সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দেন। গত শুক্রবারও তিনি এমনটা করেছেন। এমন অবস্থায় রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখছিলেন। এমন সময় অযাচিতভাবে আরিফুল হক চৌধুরী নিজেই বক্তব্যরত রেজাউল হাসানের দিকে তেড়ে আসেন এবং শাসানোর ভঙ্গিতে কথা বলেন। দলের একজন জ্যেষ্ঠ নেতার কাছ থেকে এমন আচরণ একেবারেই প্রত্যাশিত নয়।

সভায় আরিফুল হক সুন্দর করে কথা বলেছেন। কেন সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতি কম, এ নিয়ে তিনি বক্তব্য দেন। কিন্তু রেজাউল হাসান কয়েস লোদী এটা সুন্দরভাবে নেননি। হলভর্তি লোকের সামনে কয়েস লোদী যেভাবে একজন সিনিয়র নেতাকে নিয়ে বক্তব্য দেন, সেটা উচিত হয়নি।নাসিম হোসাইন, সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক নেতা

মহানগর বিএনপির সেদিনের আলোচনা সভায় দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অবমূল্যায়নের অভিযোগও উঠেছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মহানগর বিএনপির দুবারের নির্বাচিত সাবেক সভাপতি ও দুবারের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক নাসিম হোসাইন এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিমকে মঞ্চে তোলা দূরের কথা, বক্তব্য রাখার সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি বলে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ। এ নিয়ে দলের তৃণমূলের অনেকে ভেতরে–ভেতরে ক্ষুব্ধ হন।

এ বিষয়ে নাসিম হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সভায় আরিফুল হক সুন্দর করে কথা বলেছেন। কেন সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতি কম, এ নিয়ে তিনি বক্তব্য দেন। কিন্তু রেজাউল হাসান কয়েস লোদী এটা সুন্দরভাবে নেননি। হলভর্তি লোকের সামনে কয়েস লোদী যেভাবে একজন সিনিয়র নেতাকে নিয়ে বক্তব্য দেন, সেটা উচিত হয়নি। আরিফুল ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, অথচ ভারপ্রাপ্ত সভাপতির কাছে তিনি অসম্মানিত হলেন। তিনি (লোদী) অতিরিক্ত অ্যাগ্রেসিভ বক্তব্য দিয়েছেন। একজন সভাপতি হিসেবে তিনি যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, এতে অনেকে আহত হয়েছেন।’ তাঁকে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ না-দেওয়ার বিষয়ে ‘ছোট মনের পরিচয়’ দিয়েছেন বলে মন্তব্য তাঁর।

সিনিয়র নেতাদের অনেকে কর্মসূচিতে ছিলেন না, এ জন্য প্রধান অতিথি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিষয়টি দেখার জন্য বলেছেন। এটা অন্যায় না। কিন্তু পরে যেটা ঘটেছে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত।ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, সিলেট মহানগর বিএনপি

বদরুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘তাঁরা (মহানগরের বর্তমান নেতৃত্ব) তো এখন অথরিটি। আমরা তো এখন সাবেক, পুরানা মাল। যেহেতু দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের শাহাদাতবার্ষিকী, তাই সাবেক হিসেবে আমি গিয়েছিলাম। দলের একজন ফাউন্ডার ওয়ার্কার হিসেবে দায়িত্ব থেকেই গিয়েছি। কিন্তু মঞ্চে সিট থাকা সত্ত্বেও নাসিম হোসাইনসহ আমাকে যথাযথ মূল্যায়ন তাঁরা করেননি। দলের একজন ফাউন্ডার ওয়ার্কার হিসেবে এটা মাইনা নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না, তাই আমি চইলা আইছি।’

আরও পড়ুনসিলেটে জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকীর সভায় আরিফুল-লোদীর বাগ্‌বিতণ্ডা, উত্তেজনা৩০ মে ২০২৫

সাবেক দুই নেতার অভিযোগ প্রসঙ্গে সিলেট মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘বক্তব্য না দেওয়ায় তাঁরা (নাসিম ও বদরুজ্জামান) কোনো মান-অভিমান করেননি। আর সিনিয়র নেতাদের অনুপস্থিতির বিষয়ে প্রধান অতিথি বক্তব্যে যা বলেছেন, এটা তিনি বলতেই পারেন। সিনিয়র নেতাদের অনেকে কর্মসূচিতে ছিলেন না, এ জন্য প্রধান অতিথি দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিষয়টি দেখার জন্য বলেছেন। তিনি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, কথা প্রসঙ্গে তিনি এটা বলতেই পারেন। এটা অন্যায় না। কিন্তু পরে যেটা ঘটেছে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে কেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পরে এমন করলেন, সেটা তাঁর (লোদী) কাছ থেকেই জেনে নেওয়া ভালো।’ তবে এগুলোকে তিনি বিভেদ বলতে নারাজ।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিষয়ে রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘কারও সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ বা বিভেদ নেই। আমি শুধু আমাদের নেতা ও অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যের সূত্র ধরে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলাম। কিন্তু সেদিন তিনি (আরিফুল) কেন আমার দিকে তেড়ে এলেন কিংবা এমন আচরণ করলেন, সেটা বোধগম্য নয়।’

আমরা চাই, সামগ্রিকভাবে দলের সবাই যেন দায়িত্বশীল আচরণ করেন। তবে দলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নিশ্চয়ই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।মিফতাহ্ সিদ্দিকী, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সিলেট বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক

মহানগর বিএনপির নেতাদের দ্বন্দ্বের রেষ ফেসবুকেও গড়িয়েছে। দলটির অনেক নেতা-কর্মী মহানগর বিএনপির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। গত শনিবার রাতে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি বদর মাহমুদ বদরুদ্দোজা একটি স্ট্যাটাস দেন। এতে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লেখেন, ‘সিলেট বিএনপিকে গতিশীল করতে মহানগর বিএনপিকে ঢেলে সাজানো জরুরি।’

মহানগর বিএনপির নেতাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি কয়েক দিনের ব্যবধানে একাধিকবার প্রকাশ্যে আসার ব্যাপারে কথা হয় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিলেট বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই, সামগ্রিকভাবে দলের সবাই যেন দায়িত্বশীল আচরণ করেন। তবে দলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে নিশ্চয়ই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব এনপ র ন ত দ র ন স ম হ স ইন ইমদ দ হ স ন দল র একজন র অন স র দ বন দ ব অন ষ ঠ ন র স মন বল ছ ন প রক শ র অন ক দল র ভ এক ধ ক ব ষয়ট

এছাড়াও পড়ুন:

দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের সবচেয়ে চাকচিক্যপূর্ণ এলাকায় একটি যৌন ব্যবসা এবং অসহায় নারীদের শোষণ–নির্যাতনের মূল হোতাকে চিহ্নিত করেছে বিবিসির অনুসন্ধানী দল।

চার্লস মোসিগা নামের ওই ব্যক্তি পরিচয়-গোপনকারী বিবিসি প্রতিবেদককে বলেন, এক সেক্স পার্টির জন্য তিনি ন্যূনতম এক হাজার ডলার দরে নারী সরবরাহ করতে পারবেন। তাঁরা অনেকেই গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে ‘প্রায় সবকিছুই’ করতে পারবে। মোসিগা লন্ডন শহরের সবেক একজন বাসচালক হিসেবে নিজের পরিচয় দেন।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের উন্মত্ত ‘সেক্স পার্টি’ নিয়ে বহু বছর ধরেই নানা কথা চালু আছে। টিকটকে এ-সংক্রান্ত একটি হ্যাশট্যাগ ৪৫ কোটি বারেরও বেশি দেখা হয়েছে। এটা ধরে অনেক ব্যঙ্গাত্মক ও জল্পনামূলক তথাকথিত অনুসন্ধানী কনটেন্ট ছড়িয়েছে। সেগুলোতে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে অর্থলোভী কিছু নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্সারের ভূমিকা নেন এবং তাঁরা গোপনে মানুষের যথেচ্ছ যৌন চাহিদা মিটিয়ে বিলাসী জীবনযাপনের খরচ জোগান।

বিবিসির অনুসন্ধানী দলকে বলা হয়েছে, বাস্তবতা আরও ভয়াবহ।

উগান্ডার কয়েকজন তরুণী বিবিসিকে বলেছেন, তাঁরা কখনো ভাবেননি, মোসিগার অধীনে তাঁদের যৌনকর্ম করতে হবে। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, তাঁরা সুপার মার্কেট বা হোটেলের মতো কোনো জায়গায় কাজ করার জন্য আরব আমিরাতে যাচ্ছেন।

‘মিয়া’ (ছদ্মনাম) বলেন, মোসিগার আনা গ্রাহকদের অন্তত একজন নিয়মিত মেয়েদের গায়ে মলত্যাগ করতে চান। তিনি বলেন, মোসিগার চক্র তাঁকে ফাঁদে ফেলে এ কাজে জড়িয়েছে।

মোসিগা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি শুধু বাড়িওয়ালাদের মাধ্যমে নারীদের বাসা পেতে সহায়তা করেন। আর তাঁরা মোসিগার সঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে যান, কারণ তাঁর সঙ্গে দুবাইয়ের অনেক ধনাঢ্য মানুষের যোগাযোগ আছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে উন্মত্ত ‘সেক্স পার্টি’ নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। অভিযোগ আছে, অনেক অর্থলিপ্সু নারী ইনফ্লুয়েন্সার তাঁদের বিলাসী জীবনযাপনের জন্য গোপনে অর্থের জোগান মেটাতে অস্বাভাবিক ও বিকৃত যৌন চাহিদা মেটানোর কাজও করছেন।

অনুসন্ধানে বিবিসি আরও জানতে পেরেছে, মোসিগার সঙ্গে যোগসূত্র থাকা দুই নারী দুবাইয়ের সুউচ্চ ভবন থেকে পড়ে মারা গেছেন। যদিও তাঁদের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের স্বজন ও বন্ধুরা মনে করেন, পুলিশের আরও তদন্ত করা উচিত ছিল।

মোসিগা বলেন, ঘটনা দুটি দুবাই পুলিশ তদন্ত করেছে। এ–সংক্রান্ত তথ্যের জন্য তিনি বিবিসিকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু পুলিশ বিবিসির অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

মারা যাওয়া দুই নারীর একজন মোনিক কারুঙ্গি। তিনি পশ্চিম উগান্ডা থেকে দুবাইয়ে আসেন। মোসিগার জন্য কাজ করা আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে একটি ফ্ল্যাটে মোনিকের ঠাঁই হয়।

একজন নারী বলেন, তিনি ২০২২ সালে মোনিকের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটে থেকেছেন। বিবিসি এই নারীর নাম দিয়েছে কেইরা।

কেইরা বলেন, ‘(মোসিগার) ওই ফ্ল্যাটটি ছিল বাজারের মতো। সেখানে প্রায় ৫০টি মেয়ে একসঙ্গে থাকত। সে (মোনিক) খুশি ছিল না। কারণ, সে যা চেয়েছিল, তা পায়নি।’

মোনিকের বোন রিতা বলেন, একটি সুপার মার্কেটে কাজ করবেন ভেবে তাঁর বোন দুবাই গিয়েছিলেন।

মোনিকের সঙ্গে মিয়ারও পরিচয় ছিল। বিবিসিকে মিয়া বলেন, ‘আমি বাড়ি ফিরেতে চাইলে তিনি (মোসিগা) সহিংস হয়ে ওঠেন। তিনি জানান, দুবাই আসার পর মোসিগা তাঁকে বলেছিলেন—তিনি ইতিমধ্যে মিয়ার কাছে ২ হাজার ৭১১ ডলার পান। ঠিক সময়ে পরিশোধ না করলে দুই সপ্তাহের মধ্যে এটা দ্বিগুণ হবে।

মিয়া বলেন, ‘বিমান টিকিট, ভিসা খরচ, বাসা ভাড়া, খাবার খরচ মেটাতে তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। পুরুষদের কাছে অনুনয় করতে হবে, যাতে তারা কাছে আসে ও শয্যাসঙ্গী হয়।’

ট্রয়ের দাবি, মোসিগা এত দিন এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পেরেছেন কারণ, তিনি আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রে কখনো নিজের নাম ব্যবহার করতেন না। গাড়িচালক, গাড়ি ও বাড়ি ভাড়াসহ সব কাজে ট্রয় এবং তাঁর মতো অন্যদের নাম ব্যবহার করা হতো।

মাইকেল (ছদ্মনাম) নামে মোনিকের এক আত্মীয় বিবিসিকে বলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মোসিগার কাছে মোনিকের প্রায় ২৭ হাজার ডলার ঋণ জমে গিয়েছিল। মোনিকে প্রায়ই মাইকেলকে কাঁদতে কাঁদতে ভয়েস নোট পাঠিয়ে এ কথাগুলো বলত।

মিয়া বলেন, তাঁদের গ্রাহকদের বেশির ভাগই ছিলেন ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ মানুষ। এদের অনেকের চরম বিকৃত যৌন চাহিদা ছিল। নিচু গলায় তিনি বলেন, একজন গ্রাহক মেয়েদের ওপর মলত্যাগ করে সেটা খেতে বলতেন।

লেক্সি নামের (ছদ্মনাম) আরেক নারী বলেন, অন্য একটি চক্রের ফাঁদে পড়ে তিনি এই কাজে জড়িয়েছেন। তিনিও বলেন, গ্রাহকেরা প্রায়ই এমনটা করতে চাইতেন। একজন গ্রাহকের অমানুষিক ঘৃণাপূর্ণ বিকৃত চাহিদা বর্ণনা করেন তিনি। বলেন, এমন অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর বিশ্বাস জন্মেছে যে, এসব চরম বিকৃত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে জাতিবিদ্বেষ বা বর্ণবিদ্বেষের ব্যাপার থাকতে পারে।

লেক্সি বলেন, ‘প্রতিবার যখন আমি বলতাম, এগুলো করতে চাই না, তাঁরা আরও মজা পেত। তাঁরা এমন কাউকে চাইত, যে কিনা কাঁদবে, চিৎকার করবে ও পালাতে চাইবে। এমন কেউ, যে হবে কৃষ্ণাঙ্গ।’

লেক্সি বলেন, তিনি পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে বলেছিল, ‘তোমরা আফ্রিকানরা একে অপরের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছ। আমরা এতে জড়াতে চাই না। তারপর তাঁরা ফোন কেটে দেয়।

মোনিকের পরিবার তাঁর লাশ পায়নি। বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, তাঁকে দুবাইয়ে আলকুসাইস কবরস্থানের ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ অংশে দাফন করা হয়েছে।

দুবাই পুলিশের কাছে বিবিসি এই অভিযোগ তুলে ধরলেও তারা কোনো উত্তর দেয়নি।

পরবর্তী সময়ে অবশ্য লেক্সি উগান্ডায় ফিরতে সক্ষম হন। বর্তমানে তিনি এ ধরনের চক্রের ফাঁদে পড়া নারীদের উদ্ধার ও সহায়তায় কাজ করছেন।

চার্লস মোসিগাকে খুঁজে পাওয়ার কাজটি সহজ ছিল না। বিবিসির অনুসন্ধানকারী দলটি শুধু অনলাইনে তাঁর একটি ছবি পেয়েছিল। সেটিও ছিল পেছন থেকে তোলা, তা ছাড়া, নানা নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন মোসিগা।

উন্মুক্ত উৎস থেকে নেওয়া তথ্য, ছদ্মবেশে অনুসন্ধান এবং মোসিগা চক্রের এক সাবেক সদস্যের দেওয়া তথ্য—সব মিলিয়ে অনুসন্ধানকারী দল তাঁকে দুবাইয়ের মধ্যবিত্ত এলাকা জুমেইরাহতে খুঁজে পায়।

আরও পড়ুনদুবাইয়ের যৌনপল্লি থেকে তরুণী উদ্ধার, আসামিদের অব্যাহতি চায় পুলিশ২৭ মার্চ ২০২২

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছিল, মোসিগার ব্যবসা মূলত অবমাননাকর যৌনকর্মের জন্য নারীদের সরবরাহ করা। বিষয়টি যাচাই করতে অনুসন্ধানী দল একজন ছদ্মবেশী প্রতিবেদককে পাঠায়। তিনি নিজেকে একজন অনুষ্ঠান আয়োজক হিসেবে পরিচয় দেন, যিনি বিলাসবহুল পার্টিগুলোর জন্য নারী খুঁজছেন।

অনুসন্ধানকারী দল যখন মোসিগার সঙ্গে তাঁর ব্যবসার বিষয়ে কথা বলছিল, তখন তাঁকে শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছিল।

মোসিগা বলেন, ‘আমাদের কাছে ২৫ জনের মতো মেয়ে আছে। এদের অনেকেই মুক্তমনা…তারা প্রায় সবকিছুই করতে পারে।’

খরচের ব্যাপারে মোসিগা বলেন, রাতপ্রতি একেকজনের জন্য এক হাজার ডলার থেকে শুরু। তবে অস্বাভাবিক কাজের জন্য বেশি অর্থ দিতে হবে। তিনি বিবিসির রিপোর্টারকে একটা নমুনা রাতের দাওয়াত দেন।

মোসিগা বলেন, এই ব্যবসা তাঁর অতি প্রিয়। লটারিতে ১০ লাখ পাউন্ড জিতলেও তিনি এ ব্যবসা চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ‘এটি এখন আমারই একটি অংশ হয়ে গেছে।’

ট্রয় নামের এক ব্যক্তি দাবি করেন, তিনি মোসিগার চক্রের অপারেশনস ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। চক্রটি কীভাবে পরিচালিত হয় সে বিষয়ে তিনি বিবিসির অনুসন্ধানী দলকে তথ্য দেন।

ট্রয় বলেন, মোসিগা বিভিন্ন নৈশক্লাবের নিরাপত্তাকর্মীদের টাকা দেন, যাতে তাঁর পাঠানো নারীরা ভেতরে ঢুকে গ্রাহক খুঁজতে পারে।

আরও পড়ুনদুবাইয়ে ধর্ষণের শিকার নরওয়েজীয় নারীর কারাদণ্ড২১ জুলাই ২০১৩

ট্রয়ের দাবি, মোসিগা এত দিন এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পেরেছেন কারণ, তিনি আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রে কখনো নিজের নাম ব্যবহার করতেন না। গাড়িচালক, গাড়ি ও বাড়ি ভাড়াসহ সব কাজে ট্রয় এবং তাঁর মতো অন্যদের নাম ব্যবহার করা হতো।

২০২২ সালের ২৭ এপ্রিলে দুবাইয়ে প্রবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় আবাসিক এলাকা আল বারশায় একটি সেলফি তুলে পোস্ট করেছিলেন মোনিক। এর চারদিন পরই তিনি মারা যান। দুবাইয়ে আসার চার মাসের মাথায় তাঁর মৃত্যু হয়।

মিয়ার বলছেন, মোনিক যত দিন ছিলেন, মোসিগার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত ঝগড়া হতে দেখেছেন। মোনিক মোসিগার চাহিদা পূরণ করতে অস্বীকার করছিলেন এবং চক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে পেয়েছিল।

মিয়া বলেন, মোনিক একটি চাকরি পেয়েছিলেন। তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। ভেবেছিলেন, অবশেষে ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পাবেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।

মোসিগার ভাড়া করা ফ্ল্যাট ছেড়ে প্রায় ১০ মিনিট হাঁটা দূরত্বে অন্য একটি ফ্ল্যাটে চলে যান মোনিক। ২০২২ সালের ১ মে ওই বাসার বারান্দা থেকে তিনি নিচে পড়ে যান।

মোনিকের আত্মীয় মাইকেল তখন দুবাইতে ছিলেন। তিনি বলেন, মোনিকের মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশ তাঁকে বলেছিল, তারা তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ, মোনিকের বাসা থেকে মাদক ও অ্যালকোহল পাওয়া গেছে। বারান্দায় শুধু মোনিকের আঙুলের ছাপ ছিল।

আরও পড়ুনদুবাইয়ের ড্যান্স বারে বাংলাদেশ থেকে তরুণী পাচার, বাধ্য করা হচ্ছে যৌন পেশায়২২ নভেম্বর ২০১৯

মাইকেল হাসপাতাল থেকে মোনিকের মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এতে উল্লেখ ছিল না, তিনি কীভাবে মারা গেছেন।

মোনিকের পরিবারের জন্য এখন শোকের সঙ্গে ভয় মিলেমিশে গেছে। ভয় অন্য পরিবারগুলোর জন্য, যারা একই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।

বিবিসি চার্লস অ্যাবি মোসিগার কাছে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে চায়। তিনি অবৈধ যৌন ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এগুলো সব মিথ্যা।’

এদিকে মোনিকের পরিবার তাঁর লাশ পায়নি। বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, তাঁকে দুবাইয়ে আলকুসাইস কবরস্থানের ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ অংশে দাফন করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনার অতি আগ্রহের কারণ কী, প্রশ্ন টিআইবির
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • মুসলিম পরিবারে শিশুর নিরাপত্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • পুরোপুরি বিলুপ্তির পর উগান্ডায় আবার ফিরল গন্ডার
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু : পুলিশের দাবি, বাড়ির ছাদ থেকে পড়েছেন, হত্যার অভিযোগ পরিবারের