ত্রাণ বিতরণের সময় ফিলিস্তিনিদের হত্যা: স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জাতিসংঘের
Published: 3rd, June 2025 GMT
গত রবিবার (১ জুন) গাজায় একটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে ফিলিস্তিনিদের হত্যার ঘটনায় স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ত্রাণ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষারত লোকজনের উপর ইসরায়েলি বাহিনী গুলি চালিয়েছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর জাতিসংঘের মহাসচিব স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানালেন।
মঙ্গলবার (৩ জুন) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত রাফাহ কেন্দ্র থেকে খাবারের জন্য অপেক্ষা করার সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
আরো পড়ুন:
ফিলিস্তিনকে ‘পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলো আইএলও
গাজায় নিহতের সংখ্যা ৫৪ হাজার ৪০০ ছাড়াল
রেড ক্রস জানিয়েছে, এ ঘটনায় ১৭৯ জন হতাহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ২১ জন মারা গেছে। হামাস পরিচালিত সিভিল ডিফেন্স সংস্থার তথ্যমতে নিহতের সংখ্যা ৩১।
রবিবার, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বা ত্রাণ কেন্দ্রের ভেতরে বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালানোর ঘটনা অস্বীকার করেছে এবং বলেছে যে, এই ধরনের প্রতিবেদন মিথ্যা।
জিএইচএফ জানিয়েছে, প্রতিবেদনগুলো ‘সম্পূর্ণ বানোয়াট’ এবং তাদের স্থাপনায় বা তার কাছাকাছি কোনো হামলার প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
বিবিসি বলছে, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোকে গাজায় প্রবেশ করতে দেয় না, যার ফলে এই অঞ্চলে কী ঘটছে তা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে।
সোমবার (২ জুন) এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, “গতকাল গাজায় সাহায্য চাইতে গিয়ে ফিলিস্তিনিদের নিহত ও আহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। আমি এই ঘটনার তাৎক্ষণিক ও স্বাধীন তদন্ত এবং দোষীদের জবাবদিহি করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
জাতিসংঘ প্রধানের এই মন্তব্যকে ‘অপমানজনক’ বলে অভিহিত করে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং হামাসের কথা উল্লেখ না করার জন্য তার সমালোচনা করেছে।
সোমবার, জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক বিবিসিকে বলেন, গাজায় যেভাবে এখন মানবিক সাহায্য সরবরাহ করা হচ্ছে তা ‘অগ্রহণযোগ্য’ এবং ‘অমানবিক’।
তিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজআওয়ার প্রোগ্রামে বলেন, “আমি মনে করি, ইসরায়েল গাজার ক্ষুধার্ত বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি চরম অবহেলা দেখাচ্ছে। আপনি কি কল্পনা করতে পারেন যে, প্রায় তিন মাস ধরে খাবার, ওষুধের জন্য একেবারেই মরিয়া মানুষ, তারপর তাদের তা পেতে দৌড়াতে হয় অথবা সবচেয়ে মরিয়া পরিস্থিতিতে তা পেতে চেষ্টা করতে হয়?”
তিনি বলেন, “ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞা এমন মানুষের উপর এক বিশাল অমানবিকতা প্রদর্শন করে যারা মানবিক সাহায্য খুব প্রয়োজন।”
গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থা জানিয়েছে, রবিবার ভোরে রাফায় আমেরিকান সাহায্য কেন্দ্রের কাছে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে ৩১ জন নিহত এবং ১৭৬ জন আহত হয়েছেন।
রাফাহর স্থানীয় সাংবাদিক মোহাম্মদ গারিব বিবিসিকে বলেন, স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ৪টার দিকে জিএইচএফ সাহায্য কেন্দ্রের কাছে আল-আলম গোলচত্বরের কাছে ফিলিস্তিনিদের একটি ভিড় জড়ো হয়েছিল, তখন ইসরায়েলি ট্যাংকগুলো এগিয়ে এসে নির্বিচার এসে গুলি চালায়।”
তিনি বলেন, “নিহত ও আহতরা দীর্ঘ সময় ধরে মাটিতে পড়ে ছিল। উদ্ধারকারীরা ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় প্রবেশ করতে পারেনি। এর ফলে বাসিন্দারা গাধার গাড়ি ব্যবহার করে আহতদের ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য হন।”
ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) রবিবার বিকেলে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে বলেছে, প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে যে, তাদের সৈন্যরা ‘মানবিক সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রের কাছাকাছি বা ভেতরে থাকা বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালায়নি এবং এই বিষয়ে রিপোর্টগুলো মিথ্যা’।
আইডিএফ মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফি ডিফ্রিন হামাসকে ‘গুজব ছড়ানোর’ এবং ‘গাজার জনগণকে সেই ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে পৌঁছাতে বাধা দেওয়ার জন্য সহিংস চেষ্টা করার’ অভিযোগ করেছেন।
রবিবার সন্ধ্যায় ইসরায়েলের একজন উধ্বর্তন সামরিক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, সৈন্যরা জিএইচএফ ত্রাণ কেন্দ্র থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে ‘বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনকে বাহিনীর কাছে যেতে বাধা দেওয়ার’ জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ত্রাণ বিতরণ শুরু হওয়ার আগেই।
তিনি বলেন, “সতর্কীকরণ গুলি চালানো হয়েছিল। প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনার সাথে আইডিএফের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগের কোনো যোগসূত্র নেই।”
সোমবার জিএইচএফ এক বিবৃতিতে বলেছে, “অভিযোগগুলো আন্তর্জাতিক মিডিয়া সম্প্রদায়কে সরাসরি মিথ্যা তথ্য এবং ভুল তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুতর। জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রে কোনো গুলিবর্ষণ, আহত বা প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।”
ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে এই বিষয়ে ‘বেপরোয়া ও দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রতিবেদন’ করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
এদিকে, সোমবার গাজার স্বাস্থ্য অফিস ও স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, রাফাহর তাল আল-সুলতান এলাকায় একই জিএইচএফ কেন্দ্রের কাছে ইসরায়েলি গুলিতে আরো তিনজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আন্তঃসীমান্ত আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে। তখন থেকে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৪ হাজার ৪৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ঢাকা/ফিরোজ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ইসর য় ল স ব ধ ন তদন ত ত র ণ ব তরণ জ এইচএফ ইসর য় ল রব ব র স মব র র জন য র উপর ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
গাজায় ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র আসলে ইসরায়েলের মারণকল
যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়, তখন তা শুধু ক্ষুধার নয়, বরং সমাজের ভাঙনেরও প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। এ অবস্থায় মানুষ আবর্জনার স্তূপ থেকে খাবার খুঁজে আনে। কেউ গোপনে রান্না করে; কেউ আত্মীয়দের থেকে খাবার লুকিয়ে রাখে, কোনো পরিবার হয়তো খাবারের জন্য তাদের দাদিমার গয়না বিক্রি করে দেয়।
দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মুখে কোনো অনুভূতি থাকে না। তাদের চোখে থাকে ফাঁপা দৃষ্টি। মানুষ পশুর মতো খাবারের জন্য লড়াই করে। এটিই হলো সামাজিক অবক্ষয় ও অপমানের চরম রূপ। এটিই হলো মানবিক মর্যাদার বিলোপ। এ অবস্থার মধ্য দিয়ে আজকের গাজাবাসী যাচ্ছে।
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফ নামে একটি নতুন সংস্থা (যেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে মে মাসে যাত্রা শুরু করে) নিজেদের কার্যক্রমকে একুশ শতকের আধুনিক ও সহানুভূতিশীল সংস্থা বলে দাবি করছে। তারা বলছে, তাদের চারটি ‘নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্র’ থেকে তারা প্রতিদিন ২০ লাখের বেশি প্যাকেট খাবার বিতরণ করছে। সেখানকার ছবিতে দেখা যায়, বাচ্চাদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন সংস্থার কর্মীরা।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।ইসরায়েলি মুখপাত্ররা বলছেন, জাতিসংঘের ট্রাকগুলো গাজার সীমানার ভেতরে আছে কিন্তু জাতিসংঘ নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বিতরণ করছে না। কিন্তু এ বক্তব্য খুব সহজ বিশ্লেষণেই ভেঙে পড়ে।
প্রথমত, সংখ্যা ঠিক মিলছে না। গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা হিসাব করে জানায়, ১৮ মাসের অবরোধ ও যুদ্ধের পর এবং দুই মাসের পূর্ণ ইসরায়েলি অবরোধের ফলে মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে গাজায় জীবন বাঁচানোর জন্য যে পরিমাণ খাবার দরকার, তার অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অর্থাৎ গাজার সব মানুষের খাদ্যের পুরো চাহিদা পূরণ করতে হবে এই ত্রাণ কার্যক্রমের মাধ্যমে। কিন্তু প্রতিদিনের ২০ লাখ প্যাকেট খাবার গাজার প্রয়োজনের অর্ধেকও নয়।
আরও পড়ুনইসরায়েল কেন গাজায় অস্ত্রধারী গুন্ডা পোষে ১১ জুন ২০২৫দ্বিতীয়ত, শুধু সংখ্যায় খাবার পৌঁছালেই দুর্ভিক্ষ বন্ধ হয় না; দুর্ভিক্ষ আঘাত করে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলোর ওপর। জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী, যখন ২০ শতাংশ পরিবার মারাত্মক খাদ্যসংকটে পড়ে, তখন সেটিকে ‘দুর্ভিক্ষ’ বলা যায়। এ অবস্থায় নারীরা, বিশেষ করে যাঁদের স্বামী নেই এবং যাঁদের অনেক শিশু বা বয়স্ক অভিভাবক আছেন, তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকেন। সেসব পরিবারকে চিনে ত্রাণ পৌঁছানোই আসল কাজ।
জিএইচএফ গাজায় চারটি বিতরণ কেন্দ্র চালায়—তিনটি রাফার ধ্বংসস্তূপে, আরেকটি গাজার মাঝখানে। সব কটিই সামরিক এলাকায়। এরা খুব অল্প সময়ের জন্য এবং খাবার বিতরণের খুব অল্প আগে সবাইকে জানিয়ে খোলে। মানুষ ধ্বংসস্তূপে শিবির করে বসে থাকে, কখন দরজা খুলবে সেই আশায়। তারা জানে, ইসরায়েলি সেনারা ভিড় সামলাতে গুলি চালাতে দ্বিধা করে না। যেসব দুর্বল মা, বয়স্ক মানুষ বা প্রতিবন্ধী এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন না, তাঁরা কীভাবে খাবার পাবেন?
আরও পড়ুনইসরায়েল এখন শেষ সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো১২ এপ্রিল ২০২৫তৃতীয়ত, মানুষের বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ দেওয়া দরকার। যেমন অপুষ্ট শিশুদের জন্য দরকার বিশেষ ধরনের খাবার (যেমন ‘প্লাম্পিনাট’, যা সাধারণ খাবার খেতে না পারা শিশুর জন্য তৈরি) দেওয়া দরকার। কিন্তু জিএইচএফের বক্সে থাকে ময়দা, পাস্তা, তেল, চাল, ডাল, তাহিনি (তিলবীজ থেকে তৈরি একধরনের মাখনবিশেষ)। জিএইচএফের ত্রাণের মধ্যে কোনো শিশুখাদ্য বা প্লাম্পিনাট নেই। কোনো প্রশিক্ষিত নার্স বা পুষ্টিবিদও নেই, যাঁরা অপুষ্ট শিশুদের সেবা দিতে পারেন।
আমরা গাজায় যা দেখছি, সেটি কেবল ক্ষুধা নয়, বরং একটি সমাজকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। ইসরায়েলি সরকার আদৌ চিন্তিত নয় যে ফিলিস্তিনিরা বাঁচবে, নাকি মরবে। তারা শুধু গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের অভিযোগ এড়াতে চায়। আর সেই ছদ্মাবরণ হিসেবে জিএইচএফ এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চোখে ধুলো দেওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছে, আমরা যেন তা বুঝতে পারি।
● অ্যালেক্স ডি ওয়াল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড পিস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক
দ্য গার্ডিয়ান, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত