কুমিল্লায় পশুহাটে ১৫০০ কোটি টাকার লেনদেনের সম্ভাবনা
Published: 3rd, June 2025 GMT
ঈদুল আজহা সামনে রেখে কুমিল্লায় জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে জেলার হাটগুলোতে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পশু কেনাবেচা হতে পারে।
প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, এ বছর কুমিল্লায় কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার। আর প্রস্তুত রয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭০টি পশু। এর মধ্যে গরু ১ লাখ ৯১ হাজারটি, ছাগল ৫৬ হাজার ৯৪০টি, ভেড়া ১১ হাজার ৮০৫টি, মহিষ ৬০৮টি এবং অন্যান্য পশু ৩১৭টি।
খামারিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় খাদ্য, ওষুধ ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পশুপালনের খরচ বেড়েছে ২৫-৩০ শতাংশ। ফলে গরু প্রতি গড়ে ১০-১৫ হাজার টাকা বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। গরুর দাম শুরু হয়েছে ৮০ হাজার টাকা থেকে, যা গিয়ে ঠেকেছে ৫ লাখ পর্যন্ত। ছাগলের দাম ১৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে।
আরো পড়ুন:
কুমিল্লায় পশুর হাটে দেশি মাঝারি আকারের গরুর প্রাধান্য
কালীগঞ্জ কাঁপাচ্ছে বিশাল আকৃতির ‘নিগ্রো’!
ক্রেতারা বলছেন, গরুর দাম গত বছরের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ বেশি। তবে প্রাকৃতিক উপায়ে মোটাতাজাকৃত গরুর প্রতি আগ্রহ থাকায় অনেকে কিছুটা বাড়তি দাম দিতেও রাজি আছেন।
জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত খামারির সংখ্যা প্রায় ৩৬ হাজার। তাদের উৎপাদিত পশু স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আশপাশের জেলাগুলোতেও সরবরাহ হচ্ছে। পশু খাতের এ মৌসুমি কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আছেন প্রায় ১ লাখ মানুষ।
সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক আব্দুল আল মনসুর বলেন, ‘‘এই মৌসুমি বিপণন স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় অঙ্কের নগদ অর্থপ্রবাহ সৃষ্টি করে। পশু বিক্রির অর্থ সরাসরি যায় খাদ্য উৎপাদক, ওষুধ সরবরাহকারী, পরিবহনকর্মী, খামারি ও শ্রমিকদের হাতে, যা ক্ষুদ্র অর্থনীতিকে চাঙা করে।’’
এ বছর প্রতিটি হাটে থাকছে মোবাইল ভেটেরিনারি ইউনিট, জালনোট শনাক্তকারী যন্ত্র, অস্থায়ী ব্যাংক বুথ এবং সিসিটিভি ক্যামেরা। পরিবেশ রক্ষা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে, যারা হাট শেষে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এলাকা পরিচ্ছন্ন করবে।
দাউদকান্দির খামারি মো.
চৌদ্দগ্রামের গরু ব্যবসায়ী রফিকুল হক বলেন, “বাড়িতে লালিত গরুর চাহিদা বেশি, তবে ক্রেতারা দর কষাকষিতে পিছু হটছেন না।”
কুমিল্লা সদরের ক্রেতা আব্দুল মান্নান বলেন, “মাঝারি গরুর জন্য ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম চাওয়া হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় ১৫-২০ শতাংশ বেশি হলেও ভালো গুণগত মানের গরুর জন্য কিছুটা বাড়তি দাম দেয়া যায়।”
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা চন্দন কুমার পোদ্দার জানান, খামারিরা এখন প্রাকৃতিক খাবারে গরু পালনে উৎসাহিত হচ্ছেন। এতে মানুষের আস্থা বাড়ছে। প্রতিটি হাটে মেডিকেল টিম, জালনোট শনাক্তকারী যন্ত্র, ব্যাংক বুথ এবং সিসিটিভি রয়েছে। কোনো পশুকে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা হয়েছে বলে সন্দেহ হলে, তা বিক্রির অযোগ্য ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়সার জানান, পরিবেশ রক্ষায় কঠোর নজরদারি চলছে। প্রতিটি হাটে নির্দিষ্ট ডাম্পিং জোন, মোবাইল ক্লিনিং টিম ও পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। হাট শেষে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এলাকা পরিষ্কার করা হবে।
ঢাকা/রুবেল/বকুল
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক রব ন র হ ট
এছাড়াও পড়ুন:
রাজশাহীতে আধুনিক ব্যবস্থাপনার এক খামার
রাজশাহীর পবা থানার মাহিন্দ্রতে প্রায় ৩০ বিঘার খামার ‘নাবা ডেইরি অ্যান্ড ক্যাটল ফার্ম’। খামারের সঙ্গে কয়েক শ বিঘা মাঠে দেখা যায় গবাদিপশুর জন্য ঘাস চাষ। ২০২০ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি স্বল্প সময়েই রাজশাহী অঞ্চল ছাপিয়ে বিভিন্ন জেলায় একটি আস্থা ও নির্ভরতার নাম হয়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ এবং নির্বাহী পরিচালক মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে নাবা ডেইরি নিরাপদ মাংস ও অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করছে।
আধুনিক খামার
আধুনিক ব্যবস্থাপনার এই খামার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. মাসুমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০২০ সাল থেকে গ্রাহকদের গবাদিপশুসহ বিভিন্ন ডেইরি পণ্য সরবরাহ করছি। শুরুতে আমাদের খামারে মাত্র ২০-৩০টি গরু ছিল। সেই সংখ্যা এখন কয়েক শ ছাড়িয়ে গেছে।’ নাবা ডেইরির অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বলা যায়, অনলাইনে গরু কেনার সুযোগ। কোরবানির ঈদের সময় গ্রাহকদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা দিচ্ছে এই ডেইরি ফার্ম। ফেসবুকে খামারের পেজের মাধ্যমে গ্রাহকেরা সহজেই তাঁদের পছন্দের গরু নির্বাচন ও ফরমাশ করতে পারেন। মাসুমুল হক বলেন, ‘এবারের ঈদুল আজহার সময় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা ১৫০টি গরু বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছি। এরই মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ গরু শুধু ফেসবুকের মাধ্যমেই বিক্রি হয়ে গেছে।’
শুধু ঈদের সময় নয়, নাবা ডেইরি সারা বছরই গরু বিক্রি করে থাকে। গত বছর কোরবানির ঈদের সময় খামার থেকে প্রায় ২৫০টি গরু বিক্রি করা হয়। অনলাইনে কেনাকাটার এই সুবিধা দূরদূরান্তের ক্রেতাদের জন্য সময় ও শ্রম বাঁচিয়ে দিচ্ছে। মুঠোফোনের মাধ্যমে উচ্চমানের গবাদিপশুর প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে। রাজশাহীর স্থানীয় গ্রাহকেরা অবশ্য খামারে এসে সরাসরি গরু দেখে কেনেন। পশু কেনাবেচার ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যাংকিংসহ মোবাইল ব্যাংকিং সেবা গ্রাহকেরা ব্যবহার করতে পারেন। তারা ২৫০-৪৫০ কেজি ওজনের কোরবানির গরুর মাংস ৪৩০-৪৪০ টাকা কেজি দরে ফার্ম থেকে সরাসরি বিক্রি করছে।
নিরাপদ উৎপাদনব্যবস্থা
নাবা ডেইরির সাফল্যের অন্যতম ভিত্তি নিরাপদ ও প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদনপ্রক্রিয়া। খামারে বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে পশুদের রাখা হয়। গবাদিপশুর কৃত্রিম বৃদ্ধির জন্য কোনো ধরনের স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক বা মেডিসিন ব্যবহার করা হয় না। এতে পশুর মাংস, দুধসহ দুগ্ধজাত পণ্যের বিশুদ্ধতা এবং গুণমান নিশ্চিত করা যাচ্ছে। মাসুমুল হক জানান, ‘আমরা গ্রাহকের সামনে দুধসহ ঘি, দই, মাঠার মতো বিভিন্ন অনুষঙ্গ প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি করে সরবরাহ করছি। প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদনব্যবস্থার মাধ্যমে ভোক্তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমরা।’ ফার্মের ব্যবস্থাপনায় টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উপায় অনুশীলন করা হচ্ছে। প্রায় ২০০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের ঘাস উৎপাদন করা হচ্ছে এই খামারের জন্য। প্রাকৃতিক উপায়ে গবাদিপশুর জন্য পর্যাপ্ত ও পুষ্টিকর খাদ্যের উৎস ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শীতকালে ঘাসের সংকট মোকাবিলায় তারা ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টন ঘাস সংরক্ষণ করা হয়। গরুর জন্য অ্যানথ্রাক্সসহ বিভিন্ন রোগের নিয়মিত ভ্যাকসিন ও টিকা দেওয়া হয়। খামারজুড়ে আধুনিক উপায় পশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও রোগের বিস্তার রোধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কর্মসংস্থান বিকাশ
নাবা ডেইরি অ্যান্ড ক্যাটলের খামারে বর্তমানে প্রায় ৮০০ পশু লালন-পালন করা হচ্ছে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে ৯০ জনের মতো কর্মী সরাসরি জড়িত। এই কর্মী বাহিনীতে স্থানীয় গ্রামীণ মানুষের একটি বড় অংশ অন্তর্ভুক্ত। খামারটি শুধু গবাদিপশু পালনের পাশাপাশি ঘাস উৎপাদন থেকে শুরু করে দুগ্ধজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং বাজারজাতকরণ পর্যন্ত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে।
বৈচিত্র্যময় গবাদিপশু ও দুগ্ধজাত পণ্য
নাবা ডেইরিতে দেশি গরুর পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নত জাতের গরু আধুনিক উপায়ে পালন করা হয়। এতে উৎপাদিত মাংস ও দুধের গুণমান ও পরিমাণ ভালো থাকে। কোরবানির ঈদের জন্য তারা শাহিওয়াল, সিন্ধি, পাবনা ব্রিড, রেড চিটাগংয়ের মতো জনপ্রিয় জাতের গরু সরবরাহ করে। সারা বছরের জন্য হলিস্টিক ফ্রিজিয়ান ক্রসসহ বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাতের গরু লালন–পালন করা হয়। বর্তমানে নাবা ডেইরি প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার লিটার দুধ উৎপাদন করে। এই দুধ থেকে উৎপাদিত হয় উচ্চমানের ঘি, দই, মাঠাসহ বিভিন্ন সুস্বাদু ও পুষ্টিকর দুগ্ধজাত পণ্য। এই পণ্যগুলো রাজশাহীর বিভিন্ন জেলায় সহজেই পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় মাংসের বাজারেও নাবা ডেইরির একটি শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। নাবা ডেইরি অ্যান্ড ক্যাটল শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। ভবিষ্যতে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দুগ্ধজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য রয়েছে খামারটির।