অধ্যাপক ইউনূসের মুখ থেকেই জনগণ জানতে চায়
Published: 3rd, June 2025 GMT
একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। চিন্তা করুন, দেশে সংসদ থাকলে কী যে তুলকালাম কাণ্ড হতো? সরকারের প্রধান নির্বাহী বা প্রধানমন্ত্রীকে দাঁড়িয়ে সংসদে জবাবদিহি করতে হতো। বিরোধী দল টেবিল চাপড়ে হইচই করত।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাপান সফর সম্পন্ন করেছেন। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। জাপান সরকার আমাদের বাজেটঘাটতি মিটাতে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ধার দিবে। বেশ কয়েকটি আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতার চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে।
বলা হয়েছে, জাপান আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে এক লাখের বেশি লোক নিয়োগ করবে। এই সফরের ফলাফল এই পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, তাতে বলা যায় এটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাবে। এতে জাপান সরকারের সহৃদয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত প্রভাবের প্রতিচ্ছবি। এই সফরের বিস্তারিত সফলতাগুলো কি দেশের জনগণ অধ্যাপক ইউনূসের মুখে সরাসরি শুনতে পারে না?
সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অভিমত জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, দেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণের অধিকার একটি নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস ও সেনাপ্রধান দুজনই সরকারের লোক। তারা কি এসব বিষয় আলাপ করে সুরাহা করতে পারেন না?
মব কিছুটা থেমেছে। এখন রাজনীতিবিদেরাই দল বেঁধে সরকারি ভবনে ঢুকে যাচ্ছেন, রাস্তায় রাস্তায় ধরনা দিচ্ছেন এবং সরকারি ভবনে তালা দিচ্ছেন। জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে। তাঁরাই কয়েক দিন আগে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে ফ্যাসিবাদ আর থাকবে না। এখন তাঁরা নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করছেন, শাহবাগে যান চলাচল বন্ধ করছেন। অধ্যাপক ইউনূসের কাছের লোকেরা বলেছেন তিনি এসব নিয়ে বিরক্ত। কেউ কেউ বলেছেন তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কেউ বলছেন তিনি দায়িত্ব পালন করে যাবেন। আমরা কি তাঁর ভাবনাগুলো তাঁর মুখ থেকে শুনতে পারব?
এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুব সহজ নয়। কারণ, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিজে নীরবে কাজ করতে পছন্দ করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপদেষ্টারা যা বলেন, তার থেকেই দেশের জনগণ উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। উপদেষ্টারা যা বলেছেন তাতেও অনেক বিষয়ে পরস্পর বিরোধী কথা বলছেন। আপনি কী ভাবছেন, জনগণ নিশ্চয়ই আপনার মুখ থেকেই জানতে চায় অধ্যাপক ইউনূস।
এমন কিছু সময় আছে দেশের সমস্যা ও সমাধানের পথগুলো দেশের প্রধান নির্বাহীর মুখে না শুনলেই নয়। সেই ক্রান্তিকালটাতে আমরা পৌঁছে গেছি। আর একটা বিষয় অবশ্যই জরুরি, অধ্যাপক ইউনূস যদি সংস্কার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা রোড ম্যাপ বা নীলনকশা তৈরি করে স্পষ্ট কণ্ঠে জানিয়ে দেন, এটাও হবে তার ‘বুলি পলপ্রিট’ বা হাঁকডাকের অংশ বিশেষ ।অধ্যাপক ইউনূসের জাপান সফরকালে কথিত পদত্যাগের বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া। জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, যেহেতু তিনি এই বিষয়ে বাংলাদেশে কোনো কথা বলেননি, তাই বিদেশে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তা ‘বড় সমস্যা’ হতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস এখন দেশে ফিরে এসেছেন, এখন কি তিনি কিছু বলবেন?
আমাদের দেশে এখন যা চলছে, নির্বাচন দিলেই কি সব মিটে যাবে? বিচারপতি শাহাবুদ্দিনও একটা ভালো নির্বাচন দিয়ে রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তারপর কী হলো?
আবার সরকারের বয়স প্রায় ১০ মাসে হয়ে গেল। কিন্তু সংস্কারের তেমন কিছুই হয়নি। এ নিয়েও প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক। জরুরি বিবেচনায় আমরা পুলিশি কাজে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিচ্ছি। বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচন ও রাজনীতিতেও তাদের পরামর্শ ও সাহায্য নেওয়া দোষের কিছু নয়। অধ্যাপক ইউনূসই একমাত্র পরিষ্কারভাবে জানাতে পারেন সরকার কী সংস্কার করতে চায় এবং কীভাবে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে পারে।
দেশের একটা বিরাট জনগোষ্ঠী অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কার উদ্যোগকে সমর্থন করেন। কিন্তু তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম ও কথাবার্তায় সৃষ্ট ধোঁয়াশা নিয়ে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। অধ্যাপক ইউনূসই স্পষ্টভাবে একাত্তরের স্বাধীনতার সপক্ষে কথা বলেন, এই বিষয় পরিষ্কার করতে পারেন।
আমাদের দেশে এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। জনগণকে আশ্বস্ত করা এবং শিক্ষাদানের একটা ব্যাপার আছে। দেশের প্রধান নির্বাহী কর্তার এই চুপচাপ থাকার খারাপ দিকও আছে। তিনি কি কিছু বিষয়ে সোচ্চার হতে পারেন না?
আমেরিকার রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট একটা কথার প্রচলন করেছিলেন—‘বুলি পলপ্রিট’। এর অর্থ হলো শাসক বা উচ্চ পদের ব্যক্তির বিশেষ অবস্থান, যেখান থেকে তিনি জনগণকে শিক্ষিত করতে পারেন, নৈতিক অনুপ্রেরণা দিতে পারেন। আজকালকার দিনে এই ‘বুলি পলপ্রিটের’ প্রয়োজন আরও বেড়েছে।
এখন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্যুৎ গতিতে প্রচার ও অপপ্রচার গড়াতে থাকে। সরকারের প্রধানকে জনগণের কাছে নিজের কাজ ও উদ্দেশ্যগুলো সার্বক্ষণিকভাবে প্রচার করতে হবে। নতুবা অন্যরা আপনার উদ্দেশ্য ও কাজকর্মকে তাদের মতো সংজ্ঞায়িত করবে। উপদেষ্টারা সরকারের ভাষ্য যেভাবে প্রকাশ করছেন, তাতে রয়েছে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা।
আমাদের সংবাদমাধ্যম ও টেলিভিশনে অধ্যাপক ইউনূসকে নিজ মুখে খুব বেশি কথা বলতে শোনা যায়নি। দেশি সংবাদমাধ্যমে হাতে গোনা কয়েকটি তিন–চারটা ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তবে অধ্যাপক ইউনূস যে সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে পছন্দ করেন না, তা–ও ঠিক নয়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিশ্বের গণমাধ্যমে তাঁর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল। পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে তাঁর সাক্ষাৎকার ফলাও করে প্রচার করা হতো।
এর মধ্যেই দেশে অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা দল বেঁধে সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। অধ্যাপক ইউনূস আপনি কি তা নিয়ে কিছু বলবেন? দেশের জনগণ গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়গুলো প্রধান উপদেষ্টার মুখেই শুনতে চান। সরকারপ্রধানের চুপচাপ থাকার একটা খারাপ দিক হলো, এতে সরকারকে দুর্বল দেখায়। প্রধান উপদেষ্টা কি কিছু বিষয়ে সোচ্চার হতে পারেন না?
এমন কিছু সময় আছে দেশের সমস্যা ও সমাধানের পথগুলো দেশের প্রধান নির্বাহীর মুখে না শুনলেই নয়। সেই ক্রান্তিকালটাতে আমরা পৌঁছে গেছি। আর একটা বিষয় অবশ্যই জরুরি, অধ্যাপক ইউনূস যদি সংস্কার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা রোড ম্যাপ বা নীলনকশা তৈরি করে স্পষ্ট কণ্ঠে জানিয়ে দেন, এটাও হবে তার ‘বুলি পলপ্রিট’ বা হাঁকডাকের অংশ বিশেষ ।
সালেহ উদ্দিন আহমদ সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল: [email protected]
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট র সরক র র বল ছ ন র জন ত আম দ র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
বাজেটে আগের আমলের ছাপ পরিলক্ষিত হয়েছে: গণ অধিকার পরিষদ
কালোটাকা সাদা করার সুযোগ সংবিধান–পরিপন্থী, বৈষম্যমূলক। এ বাজেটে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এতে আগের আমলের ছাপ পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়া জানাতে বুধবার সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন গণ অধিকার পরিষদের নেতারা।
দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান বলেন, এনবিআর রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ঠিক করেছে, তা পূরণে নতুন কোনো প্রস্তাব নেই। গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচন নিয়ে টানাপোড়েন, দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্বের কারণে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা আরও বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
গণ অধিকার পরিষদ জানায়, গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার কর্মসংস্থান নিয়ে বিশদ পরিকল্পনা প্রকাশ করবে বলে সবার ধারণা ছিল। কারণ, চাকরিতে কোটা সংস্কার বা বৈষম্য দূরীকরণের আন্দোলন থেকেই গণ–অভ্যুত্থান রচিত হয়। কিন্তু বেকারদের জন্য আলাদা কোনো ঘোষণা নেই।
দলটি আরও জানিয়েছে, মানুষের আয় ও ব্যয়ের তারতম্য কমানো বা বেকারত্ব-দারিদ্র্য দূরীকরণ নিয়ে বাজেটে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সন্তুষ্ট করতে তাঁদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে। সমাজ ও রাষ্ট্রে সাম্য প্রতিষ্ঠায় সরকারের চিন্তা এই বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি।
শিক্ষা ও চিকিৎসা খাত নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চিন্তা আওয়ামী সরকারের চিন্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে দলটি। তারা বলেছে, বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ সংবিধান পরিপন্থী ও বৈষম্যমূলক। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার এমন নীতি–বিবর্জিত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা এখনো ‘অপর্যাপ্ত’ উল্লেখ করে গণ অধিকার পরিষদ বলেছে, বাজেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রণোদনা নেই। বিশেষ করে শেয়ারবাজারে একের পর এক লোকসান অনেককে পথে বসিয়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে কার্যকর পরিকল্পনা দরকার ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন গণ অধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদ সদস্য ও গণমাধ্যম সমন্বয়ক আবু হানিফ, শহিদুল ইসলাম ফাহিম, আব্দুজ জাহের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিলু খান, যুব অধিকার পরিষদের সভাপতি মনজুর মোর্শেদ মামুন প্রমুখ।