একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। চিন্তা করুন, দেশে সংসদ থাকলে কী যে তুলকালাম কাণ্ড হতো? সরকারের প্রধান নির্বাহী বা প্রধানমন্ত্রীকে দাঁড়িয়ে সংসদে জবাবদিহি করতে হতো। বিরোধী দল টেবিল চাপড়ে হইচই করত।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাপান সফর সম্পন্ন করেছেন। জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। জাপান সরকার আমাদের বাজেটঘাটতি মিটাতে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ধার দিবে। বেশ কয়েকটি আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতার চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে।

বলা হয়েছে, জাপান আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে এক লাখের বেশি লোক নিয়োগ করবে। এই সফরের ফলাফল এই পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, তাতে বলা যায় এটা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাবে। এতে জাপান সরকারের সহৃদয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত প্রভাবের প্রতিচ্ছবি। এই সফরের বিস্তারিত সফলতাগুলো কি দেশের জনগণ অধ্যাপক ইউনূসের মুখে সরাসরি শুনতে পারে না?

সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অভিমত জানিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, দেশের ভবিষ্যৎ পথ নির্ধারণের অধিকার একটি নির্বাচিত সরকারেরই রয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস ও সেনাপ্রধান দুজনই সরকারের লোক। তারা কি এসব বিষয় আলাপ করে সুরাহা করতে পারেন না?

মব কিছুটা থেমেছে। এখন রাজনীতিবিদেরাই দল বেঁধে সরকারি ভবনে ঢুকে যাচ্ছেন, রাস্তায় রাস্তায় ধরনা দিচ্ছেন এবং সরকারি ভবনে তালা দিচ্ছেন। জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে। তাঁরাই কয়েক দিন আগে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে ফ্যাসিবাদ আর থাকবে না। এখন তাঁরা নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করছেন, শাহবাগে যান চলাচল বন্ধ করছেন। অধ্যাপক ইউনূসের কাছের লোকেরা বলেছেন তিনি এসব নিয়ে বিরক্ত। কেউ কেউ বলেছেন তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কেউ বলছেন তিনি দায়িত্ব পালন করে যাবেন। আমরা কি তাঁর ভাবনাগুলো তাঁর মুখ থেকে শুনতে পারব?

এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুব সহজ নয়। কারণ, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিজে নীরবে কাজ করতে পছন্দ করেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উপদেষ্টারা যা বলেন, তার থেকেই দেশের জনগণ উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। উপদেষ্টারা যা বলেছেন তাতেও অনেক বিষয়ে পরস্পর বিরোধী কথা বলছেন। আপনি কী ভাবছেন, জনগণ নিশ্চয়ই আপনার মুখ থেকেই জানতে চায় অধ্যাপক ইউনূস।

এমন কিছু সময় আছে দেশের সমস্যা ও সমাধানের পথগুলো দেশের প্রধান নির্বাহীর মুখে না শুনলেই নয়। সেই ক্রান্তিকালটাতে আমরা পৌঁছে গেছি। আর একটা বিষয় অবশ্যই জরুরি, অধ্যাপক ইউনূস যদি সংস্কার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা রোড ম্যাপ বা নীলনকশা তৈরি করে স্পষ্ট কণ্ঠে জানিয়ে দেন, এটাও হবে তার ‘বুলি পলপ্রিট’ বা হাঁকডাকের অংশ বিশেষ ।

অধ্যাপক ইউনূসের জাপান সফরকালে কথিত পদত্যাগের বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিল জাপানি সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া। জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, যেহেতু তিনি এই বিষয়ে বাংলাদেশে কোনো কথা বলেননি, তাই বিদেশে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে তা ‘বড় সমস্যা’ হতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস এখন দেশে ফিরে এসেছেন, এখন কি তিনি কিছু বলবেন?

আমাদের দেশে এখন যা চলছে, নির্বাচন দিলেই কি সব মিটে যাবে? বিচারপতি শাহাবুদ্দিনও একটা ভালো নির্বাচন দিয়ে রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তারপর কী হলো?

আবার সরকারের বয়স প্রায় ১০ মাসে হয়ে গেল। কিন্তু সংস্কারের তেমন কিছুই হয়নি। এ নিয়েও প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক। জরুরি বিবেচনায় আমরা পুলিশি কাজে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিচ্ছি। বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচন ও রাজনীতিতেও তাদের পরামর্শ ও সাহায্য নেওয়া দোষের কিছু নয়। অধ্যাপক ইউনূসই একমাত্র পরিষ্কারভাবে জানাতে পারেন সরকার কী সংস্কার করতে চায় এবং কীভাবে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দিয়ে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে পারে।

দেশের একটা বিরাট জনগোষ্ঠী অধ্যাপক ইউনূসের সংস্কার উদ্যোগকে সমর্থন করেন। কিন্তু তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম ও কথাবার্তায় সৃষ্ট ধোঁয়াশা নিয়ে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। অধ্যাপক ইউনূসই স্পষ্টভাবে একাত্তরের স্বাধীনতার সপক্ষে কথা বলেন, এই বিষয় পরিষ্কার করতে পারেন।

আমাদের দেশে এখন সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। জনগণকে আশ্বস্ত করা এবং শিক্ষাদানের একটা ব্যাপার আছে। দেশের প্রধান নির্বাহী কর্তার এই চুপচাপ থাকার খারাপ দিকও আছে। তিনি কি কিছু বিষয়ে সোচ্চার হতে পারেন না?

আমেরিকার রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট একটা কথার প্রচলন করেছিলেন—‘বুলি পলপ্রিট’। এর অর্থ হলো শাসক বা উচ্চ পদের ব্যক্তির বিশেষ অবস্থান, যেখান থেকে তিনি জনগণকে শিক্ষিত করতে পারেন, নৈতিক অনুপ্রেরণা দিতে পারেন। আজকালকার দিনে এই ‘বুলি পলপ্রিটের’ প্রয়োজন আরও বেড়েছে।

এখন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্যুৎ গতিতে প্রচার ও অপপ্রচার গড়াতে থাকে। সরকারের প্রধানকে জনগণের কাছে নিজের কাজ ও উদ্দেশ্যগুলো সার্বক্ষণিকভাবে প্রচার করতে হবে। নতুবা অন্যরা আপনার উদ্দেশ্য ও কাজকর্মকে তাদের মতো সংজ্ঞায়িত করবে। উপদেষ্টারা সরকারের ভাষ্য যেভাবে প্রকাশ করছেন, তাতে রয়েছে যথেষ্ট অস্পষ্টতা ও পরস্পর বিরোধিতা।

আমাদের সংবাদমাধ্যম ও টেলিভিশনে অধ্যাপক ইউনূসকে নিজ মুখে খুব বেশি কথা বলতে শোনা যায়নি। দেশি সংবাদমাধ্যমে হাতে গোনা কয়েকটি তিন–চারটা ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তবে অধ্যাপক ইউনূস যে সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে পছন্দ করেন না, তা–ও ঠিক নয়। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর বিশ্বের গণমাধ্যমে তাঁর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল। পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে তাঁর সাক্ষাৎকার ফলাও করে প্রচার করা হতো।

এর মধ্যেই দেশে অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা দল বেঁধে সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। অধ্যাপক ইউনূস আপনি কি তা নিয়ে কিছু বলবেন? দেশের জনগণ গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়গুলো প্রধান উপদেষ্টার মুখেই শুনতে চান। সরকারপ্রধানের চুপচাপ থাকার একটা খারাপ দিক হলো, এতে সরকারকে দুর্বল দেখায়। প্রধান উপদেষ্টা কি কিছু বিষয়ে সোচ্চার হতে পারেন না?

এমন কিছু সময় আছে দেশের সমস্যা ও সমাধানের পথগুলো দেশের প্রধান নির্বাহীর মুখে না শুনলেই নয়। সেই ক্রান্তিকালটাতে আমরা পৌঁছে গেছি। আর একটা বিষয় অবশ্যই জরুরি, অধ্যাপক ইউনূস যদি সংস্কার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা রোড ম্যাপ বা নীলনকশা তৈরি করে স্পষ্ট কণ্ঠে জানিয়ে দেন, এটাও হবে তার ‘বুলি পলপ্রিট’ বা হাঁকডাকের অংশ বিশেষ ।

সালেহ উদ্দিন আহমদ সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ই-মেইল: [email protected]

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: উপদ ষ ট র সরক র র বল ছ ন র জন ত আম দ র র একট

এছাড়াও পড়ুন:

‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান

ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।

এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?

আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?

হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’

আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!

তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।

একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।

টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।

একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।

যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্‌স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।

আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫

আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।

তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪

তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।

সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।

হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।

এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।

এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।

এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।

আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪

পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।

কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।

ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।

ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।

বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।

নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।

বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।

ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’

খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
  • সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত বন্দর গড়তে চাই : সাখাওয়াত
  • বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপগঞ্জে লিফলেট বিতরণ 
  • জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়াবেন না: টুকু
  • সবাই অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য
  • ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
  • সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে দেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে: তারেক রহমান
  • সরকারের একটি অংশ অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে: তারেক রহমান
  • ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন ৪০ শতাংশে ঠেকেছে
  • জাতিসংঘে সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ফিলিস্তিন ইস্যুতে উদ্বেগ