পশু কোরবানি করা হজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১৩তম তারিখে, বিশেষ করে ঈদুল আজহার দিন (১০ জিলহজ) মক্কায় হাজিরা কোরবানি সম্পন্ন করেন। তামাত্তু হজ ও কিরান হজ যাঁরা করেন, তাঁদের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব আর ইফরাদ হজ হলে কোরবানি
করা মুস্তাহাব।

এ বছর হজ অনুষ্ঠিত হবে ৫ থেকে ৯ জুন। কোরবানি শুরু হবে ৬ জুন। বাংলাদেশ থেকে এ বছর ৮৭ হাজার ১০০ হজযাত্রী হজে অংশ নেবেন, যাঁদের প্রায় সবাই একটি করে পশু কোরবানি দেবেন। বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ হাজি অংশ নিলে মক্কায় লাখ লাখ পশু কোরবানি হবে। এই বিশাল কার্যক্রম সৌদি সরকার ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়।

কোরবানির পদ্ধতি

হজের সময় কোরবানি সম্পন্ন হয় বিভিন্ন পদ্ধতিতে। হাজিরা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান ও জামারায় পাথর নিক্ষেপের পর কোরবানির প্রস্তুতি নেন। কোরবানির পশু হিসেবে ছাগল, দুম্বা, গরু বা উট বেছে নেওয়া যায়। তবে বাংলাদেশিরা সাধারণত ছাগল বা দুম্বা বেছে নেন। কোরবানির প্রধান তিনটি পদ্ধতি হলো:

১.

নিজে পশু কিনে কোরবানি করা: হাজিরা মুস্তাহালাকায় (পশুর হাট ও জবাইখানা) গিয়ে নিজে পশু কিনে কোরবানি করেন। এটি সময়সাপেক্ষ, তবে এতে নিজের পছন্দের পশু নির্বাচনের সুযোগ থাকে।

২. কোনো প্রবাসীর মাধ্যমে কোরবানি করা: কিছু হাজি, বিশেষ করে বয়স্করা, নিজ জেলার প্রবাসীদের মাধ্যমে কোরবানি করেন। এই প্রবাসীরা হজ উপলক্ষে পশু ব্যবসায় জড়িত থাকেন। তবে এই পদ্ধতিতে প্রতারণার ঝুঁকি থাকে। কিছু প্রবাসী কম খরচে (৪৫০-৫০০ রিয়াল) কোরবানির প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেন বা একাধিক ব্যক্তির টাকায় স্বল্পসংখ্যক পশু কোরবানি করেন।

৩. আইডিবির কুপনের মাধ্যমে কোরবানি করা: আইডিবি ৭২০ থেকে ৭৫০ রিয়ালের বিনিময়ে কোরবানির কুপন প্রদান করে, যা নিরাপদ, সময়সাশ্রয়ী এবং প্রতারণার আশঙ্কা থেকে মুক্ত। কুপন আল-রাজি ব্যাংক, পোস্ট অফিস, মসজিদুল হারাম বা মসজিদে নববির পাশের টংঘরে পাওয়া যায়। আইডিবি ১৯৮৩ সাল থেকে এই প্রকল্প পরিচালনা করছে, যেখানে ৪০ হাজারের বেশি কর্মী জড়িত। গত বছর ২৩টি মুসলিম দেশে তাদের উদ্যোগে মাংস বিতরণ করা হয়েছে।

আইডিবির কোরবানি ব্যবস্থাপনা

আইডিবির ‘ইউটিলাইজেশন ফর দ্য সেক্রিফিশিয়াল অ্যানিমেল’ প্রকল্প, যা আদাহি নামে পরিচিত, হজের কোরবানি ব্যবস্থাপনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ প্রকল্পে পশুর দাম, জবাইখানার খরচ, হিমাগারে সংরক্ষণ এবং বিশ্বব্যাপী দরিদ্রদের মধ্যে মাংস বিতরণের খরচ ৭৫০ রিয়ালের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ৩০ লাখ পশু কোরবানি করা হয়েছে, যার মাংস বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছেছে।

আইডিবি আদাহি প্রকল্পে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন বাংলাদেশের মোহাম্মদ আলতাফর রহমান। অবসর নিয়ে দেশে এসেছেন। এই প্রতিবেদককে তিনি আইডিবির পশু কোরবানির বিস্তারিত জানিয়েছেন। তিনি জানান, কোরবানির পশু (ভেড়া, ছাগল, গরু, উট) শরিয়াহ অনুযায়ী সুস্থ, নির্দোষ ও নির্দিষ্ট বয়সসীমার মধ্যে হতে হয়। ভেড়া বা ছাগল কমপক্ষে এক বছর, গরু কমপক্ষে দুই বছর এবং উটের বয়স কমপক্ষে পাঁচ বছর বয়সী হতে হবে। হাজিরা সাধারণত ভেড়া বা ছাগলের জন্য কোরবানি বেছে নেন, তবে গরু বা উটে একাধিক ব্যক্তি অংশ নিতে পারেন (সাতজন পর্যন্ত)।

মোহাম্মদ আলতাফর রহমান আরও জানিয়েছেন, আইডিবি মক্কা ও মিনার কাছাকাছি অবস্থিত আধুনিক জবাইখানায় কোরবানি সম্পন্ন করে। এই জবাইখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি ও শরিয়াহ মেনে পরিচালিত হয়। জবাইয়ের সময় পশুকে কিবলার দিকে মুখ করে শোয়ানো হয় এবং ‘বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করা হয়। আইডিবির নিয়োগ করা পেশাদার কসাই এই কাজ করেন।

কোরবানি ঈদুল আজহার দিন (১০ জিলহজ) থেকে শুরু হয় এবং তাশরিকের দিনগুলোতে (১১ ও ১২ জিলহজ, কিছু ক্ষেত্রে ১৩ জিলহজ) চলতে পারে। আইডিবি ভাউচারের ওপর ভিত্তি করে কোরবানির সময় নির্ধারণ করে এবং হজযাত্রীদের জানিয়ে দেয়। হাজিরা আইডিবির অনুমোদিত ব্যাংক, এজেন্ট বা হজ অফিসের মাধ্যমে কোরবানির জন্য ভাউচার কেনেন। ভাউচারের মূল্য পশুর ধরন ও বাজারমূল্যের ওপর নির্ভর করে। ভাউচার কেনার সময় হাজিকে তাঁর নাম, হজের ধরন ও কোরবানির বিবরণ প্রদান করতে হয়। এই ভাউচার কোরবানির প্রমাণ হিসেবে কাজ করে এবং নির্দিষ্ট সময়ে আইডিবি তাদের পক্ষে কোরবানি সম্পন্ন করে।

হাজিরা হজসংক্রান্ত অফিস, সৌদি আরবের স্থানীয় ব্যাংক বা আইডিবির অনুমোদিত এজেন্টদের মাধ্যমে ভাউচার কিনতে পারেন। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেও এই সুবিধা পাওয়া যায়। ভাউচারের মূল্য প্রতিবছর বাজারমূল্যের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। তবে একটি ভেড়ার মূল্য ৭২০ থেকে ৭৫০ সৌদি রিয়াল। আইডিবির ওয়েবসাইট এবং হজ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কোরবানি–সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়।

 আলতাফর রহমান জানিয়েছেন, কোরবানির মাংস তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়: হজযাত্রী, দরিদ্র মানুষ ও স্বজনদের জন্য। তবে হজের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মাংস দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। আইডিবি মাংস হিমাগারে সংরক্ষণ করে মক্কা, মদিনা ও বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে বিতরণ করে। মাংস ক্যানিং বা ফ্রিজিং করে আন্তর্জাতিকভাবে পাঠানো হয়। সৌদি আরবে ২৫০টি দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে মাংস বিতরণ করা হয়। বাংলাদেশে এই মাংস ‘দুম্বার মাংস’ নামে বিভিন্ন এলাকায় বিলি হয়। আইডিবি আধুনিক জবাইখানা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করে। প্রতিদিন ৫০০ টন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ করা হয় এবং চর্বি থেকে প্রাকৃতিক সার তৈরি করা হয়। এই ব্যবস্থা পরিবেশদূষণ
রোধে সহায়ক।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক রব ন র প ব তরণ কর র ক রব ন প রকল প আইড ব র প রব স র জন য জ লহজ র সময

এছাড়াও পড়ুন:

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া প্রশ্নে রুল

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি শেখ তাহসিন আলীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার এ রুল দেন। একই সঙ্গে যেকোনো অপারেটরকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব (নিযুক্ত) দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি অনুসারে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক বিডিং (দরপত্র আহ্বান) নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

আরও পড়ুননতুন ব্যবস্থাপনায় নিউমুরিং টার্মিনাল পরিচালনা শুরু০৭ জুলাই ২০২৫

নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের পক্ষে সংগঠনটির সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন রিটটি করেন। রিটে নৌসচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়।

‘নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে’ শিরোনামে গত ২৬ এপ্রিল প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এ প্রতিবেদনসহ এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে এনসিটি পরিচালনায় ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করার নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করা হয়।

আগের ধারাবাহিকতায় ৯ জুলাই রিটের ওপর শুনানি শেষ হয়। সেদিন আদালত ২৩ জুলাই আদেশের জন্য দিন রাখেন। ধার্য তারিখে আদালত আদেশের জন্য ৩০ জুলাই দিন রাখেন। এ অনুসারে আজ বিষয়টি আদেশের জন্য আদালতের কার্যতালিকার ৭ নম্বর ক্রমিকে ওঠে।

আজ মধ্যাহ্নবিরতির পর আদালত আদেশ দেন। আদালত বলেন, শুধু রুল দেওয়া হলো।

আদেশের সময় রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আহসানুল করিম এবং আইনজীবী কায়সার কামাল ও আনোয়ার হোসেন উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মহাদ্দেস-উল-ইসলাম।

পরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার নতুন দায়িত্ব নিয়েছে নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠান চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেড। টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাইফ পাওয়ারটেকের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ৬ জুলাই দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে এ দায়িত্ব নেয় জাহাজ মেরামতের এ প্রতিষ্ঠান। প্রথমবারের মতো বন্দরে টার্মিনাল পরিচালনায় যুক্ত হলো চিটাগং ড্রাইডক।

চট্টগ্রাম বন্দরের বৃহৎ এই টার্মিনাল নির্মিত হয় ২০০৭ সালে। টার্মিনালটি নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি সংযোজনে বন্দর কর্তৃপক্ষ ধাপে ধাপে মোট ২ হাজার ৭১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কনটেইনারের সিংহভাগ এই টার্মিনাল দিয়ে পরিবহন হয়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ