ইসলামি নীতিশাস্ত্রে সুখের ধারণা
Published: 18th, September 2025 GMT
ইসলামের একটি মৌলিক বিশ্বাস হলো, আল্লাহর কোনো চাওয়া-পাওয়া বা প্রয়োজন নেই। তিনি ফেরেশতা ও নবীদের মাধ্যমে যে ওহি দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণরূপে মানুষের কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য।
আল্লাহ মানুষকে একটি চুক্তি দিয়েছেন: এটি গ্রহণ করলে তাদের উপকার হবে, আর প্রত্যাখ্যান করলে ক্ষতি হবে তাদেরই। ইসলামি শরিয়ার নীতিই এমন, যা ক্ষতি দূর করার এবং দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটানোর নির্দেশ দেয়। (সুরা শারহ, আয়াত: ৫-৬)
তবে কষ্ট দূর করা আর সুখ অর্জন করা সমান কথা নয়। এমনকি সবচেয়ে বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও কষ্ট দূর করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও তার মাধ্যমে যে সুখ আসবে, তা নিশ্চিত করে না।
কষ্ট দূর করা আর সুখ অর্জন করা সমান কথা নয়। এমনকি সবচেয়ে বিশ্বাসী ব্যক্তিরাও কষ্ট দূর করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও তার মাধ্যমে যে সুখ আসবে, তা নিশ্চিত করে না।সুখ কেবল আনুষ্ঠানিক আনুগত্য বা আইনি পদ্ধতির মাধ্যমে অর্জিত হয় না। বরং ইসলামি সাহিত্যে ‘সাআদা’ বা সুখ নিয়ে ভিন্ন কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, জ্ঞান ও আলোকপ্রাপ্তির সঙ্গে সুখের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, এই কথাটায় জোর দেওয়া হয়েছে বারবার।
একজন বিশ্বাসী যত বেশি নিজেকে, অন্য মানুষকে, অন্য সংস্কৃতিকে এবং বিশ্বকে জানেন, তত বেশি তিনি নিজের ও অন্যের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ভারসাম্য বুঝতে পারেন।
এই দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার একটি কার্যকর উপায় হলো মহানবীর (সা.
কোরআন তাঁদের বর্ণনা করে এমন মানুষ হিসেবে যাঁরা পূর্ণ তৃপ্তি অনুভব করেন; তাঁরা আল্লাহর ওপর ভরসা করেন, আর আল্লাহ তাঁদের ওপর ভরসা করেন; তাঁরা আল্লাহকে ভালোবাসেন, আর আল্লাহ তাঁদের ভালোবাসেন। (সুরা রাদ, আয়াত: ২৮; সুরা মায়িদা, আয়াত: ১১৯)
এই সুখের অবস্থা তাঁদের অস্তিত্বের প্রতিটি দিকে ছড়িয়ে পড়ে। কোরআন তাঁদের আনন্দময় ও উজ্জ্বল মুখের বর্ণনা দেয়; তাঁরা তাঁদের হাতের তালুতে অভ্যন্তরীণ আলো নিয়ে পৃথিবীতে পদচারণ করেন, যা ঐশ্বরিক প্রজ্ঞার প্রতীক। (সুরা হাদিদ, আয়াত: ১২)
জাহিলিয়া: অসুখের কারণইসলামি ধর্মতত্ত্বে জ্ঞান, আলোকপ্রাপ্তি, ভারসাম্য, শান্তি ও প্রশান্তি হলো সুখের কেন্দ্রীয় ধারণা। কিন্তু সুখের অসম্পূর্ণতা প্রকাশ পায় ‘জাহিলিয়া’ ধারণায়, যা অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও অশুভতার অবস্থা। জাহিলিয়া কেবল নবীর মক্কায় প্রত্যাদেশের পূর্ববর্তী সময় নয়, বরং একটি নৈতিক ধারণা, যা অজ্ঞতা, অন্যায়, নিষ্ঠুরতা ও ঘৃণায় আচ্ছন্ন সমাজকে বোঝায়।
নবীজি শিখিয়েছেন, অন্ধ জাতিগত ও উপজাতীয় আনুগত্য জাহিলিয়ার অংশ। এটি আত্মকেন্দ্রিকতা, অহংকার ও অজ্ঞতার অবস্থা, যা আল্লাহর আলো ও ভালোবাসার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হওয়া উচিত। (সুরা হাজ্জ, আয়াত: ৪৬)
জাহিলিয়া কেবল নবীর মক্কায় প্রত্যাদেশের পূর্ববর্তী সময় নয়, বরং একটি নৈতিক ধারণা, যা অজ্ঞতা, অন্যায়, নিষ্ঠুরতা ও ঘৃণায় আচ্ছন্ন সমাজকে বোঝায়।জাহিলিয়া মানব ইতিহাসের প্রতিটি যুগে উপস্থিত। কুসংস্কার, বর্ণবাদ, ঘৃণা ও অত্যাচার এর বৈশিষ্ট্য। ইসলাম জাহিলিয়ার মিথ্যা আনন্দের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ভূমিকা পালন করে। ‘ইসলাম’ শব্দটি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এবং তাঁর মধ্যে শান্তি খুঁজে পাওয়া দুটি অর্থই বহন করে।
আল্লাহর মধ্যে শান্তি খুঁজে পাওয়া মানে আত্মাকে নিশ্চিহ্ন করা নয়, বরং আত্মা, অন্য এবং আল্লাহর মধ্যে ভারসাম্য বোঝার প্রজ্ঞা অর্জন। শরিয়াতে তো আল্লাহর অধিকার (হুকুক আল্লাহ) এবং মানুষের অধিকার (হুকুক আল-ইবাদ) স্বীকৃত। শান্তি খুঁজে পাওয়া মানে এই অধিকারগুলোর ন্যায্য ভারসাম্য বোঝা ও তা রক্ষার চেষ্টা করা।
আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের এই তত্ত্ব সুখের সন্ধানে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় স্তরে গভীর প্রভাব ফেলে। অজ্ঞতা ও ঘৃণার সামাজিক অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং অহংকারী আত্মাকে শৃঙ্খলিত করা এই ধর্মতত্ত্বের অংশ। আল্লাহর আলো দিয়ে দেখার জন্য অহংকারকে বুদ্ধিমান ও সক্রিয় বিবেকের মাধ্যমে শৃঙ্খলিত করতে হয়।
আরও পড়ুনসবচেয়ে সুখী মানুষ হওয়ার শিক্ষা নবীদের জীবন থেকে২০ জুলাই ২০২৫আধুনিক যুগের দুঃখপ্রতিটি যুগ জাহিলিয়ার নিজস্ব অংশ বহন করে। কুসংস্কার, ঘৃণা, অত্যাচার ও দুঃখ-কষ্টের অন্ধকার সব যুগেই ছিল। তবে আধুনিক যুগে এই নৈতিক ব্যর্থতাগুলো অসহনীয় ও ক্ষমার অযোগ্য হয়ে উঠেছে। আমাদের শেখার, যোগাযোগ করার ও জানার ক্ষমতা আগের যেকোনো যুগের চেয়ে উন্নত। তবু অজ্ঞতা, বর্ণবাদ ও ঘৃণা এখনো অব্যাহত।
আমরা যুদ্ধ ও ধ্বংসের ক্ষমতা অর্জন করেছি, যা ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তবু আমাদের পারস্পরিক নির্ভরতা ও অস্ত্রের বিপদ এই যুদ্ধগুলোকে অবোধ্য করে তুলেছে। আমাদের ব্যথা নিরসন ও আনন্দের সন্ধানের সরঞ্জাম থাকলেও দুঃখের অবসান ও সুখের প্রকৃত অর্জন এখনো দুরূহ।
সমস্যা আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় নয়, বরং আমাদের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও মানবিকতার বোঝাপড়ায়। আধুনিক যুগে আমাদের মানবিক অধিকার ও দুঃখের বোঝাপড়া বেড়েছে, কিন্তু আধ্যাত্মিক বোঝাপড়া কমেছে। এই কারণে দার্শনিকেরা এই যুগকে উদ্বেগ, অস্থিরতা ও ভিত্তিহীনতার যুগ বলে বর্ণনা করেছেন।
বিশ্বাসের শক্তিবিশ্বাসীদের জন্য, বিশ্বাস তাঁদের ঐশ্বরিক, চিরন্তন ও সুন্দরের দিকে পৌঁছাতে সক্ষম করে। প্রতি যুগের ইতিহাসেই ধর্ম মানুষের পরিবর্তনের একটি শক্তিশালী প্রেরণা।
এমনকি পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ একাডেমিয়াতেও সামাজিক তাত্ত্বিকেরা ধর্মের ইতিবাচক ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন। (খালেদ আবু এল ফাদল , ‘ইসলামিক এথিকস অ্যান্ড হ্যাপিনেস’, পৃ. ৪২, ইউসিএলএ প্রেস, লস অ্যাঞ্জেলেস, ২০১৮)
আধুনিক যুগে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি শারীরিক আরাম বাড়িয়েছে, কিন্তু আত্মার অস্থিরতা বেড়েছে। বিশ্বাস এই অস্থিরতার বিরুদ্ধে একটি নোঙর হিসেবে কাজ করে।
সমস্যা আমাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় নয়, বরং আমাদের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও মানবিকতার বোঝাপড়ায়। আধুনিক যুগে আমাদের মানবিক অধিকার ও দুঃখের বোঝাপড়া বেড়েছে, কিন্তু আধ্যাত্মিক বোঝাপড়া কমেছে।ধর্মের অপব্যবহারধর্মকে কখনো কখনো নৈতিক উদাসীনতা, নিষ্ক্রিয়তা বা এমনকি নৈরাশ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক মুসলিম ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের ওপর জোর দিয়ে নৈতিক উদাসীনতাকে ন্যায্যতা দেয়, যা ধর্মের অপব্যবহার। আরও গুরুতর অপব্যবহার হলো ইসলামকে এমনভাবে ব্যবহার করা, যা ঘৃণা, কুসংস্কার ও দুঃখ-কষ্ট ছড়ায়।
ইসলামকে জাহিলিয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা—যেমন ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা বা অহংকার প্রচার করা—একটি নৈতিক ব্যর্থতা। কোরআন ঘোষণা করে, আল্লাহ সকল মানুষের মর্যাদা নির্ধারণ করেছেন। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৭০)।
মোট কথা, ইসলামি নীতিশাস্ত্র আধুনিক বিশ্বে সুখের সন্ধানে একটি গতিশীল পথ দেখায়। এটি কেবল আনুষ্ঠানিক আনুগত্য নয়, বরং নিজেকে ও অন্যকে জানার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে।
জাহিলিয়ার অন্ধকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ন্যায়, করুণা ও শান্তির সাধনা ইসলামি সুখের মূল। আধুনিক যুগের উদ্বেগ ও অস্থিরতার মধ্যে, ইসলাম বিশ্বাসীদের একটি নোঙর প্রদান করে, যা তাদের ঐশ্বরিক সৌন্দর্য ও সুখের দিকে নিয়ে যায়।
সূত্র: এবিসি ডট নেট
আরও পড়ুনপবিত্র কোরআনের পাঁচটি আশার আলো ছড়ানো আয়াত২১ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ভ রস ম য ব যবহ র আম দ র ক ত গত ম নব ক র জন য আল ল হ র অবস ক রআন ক ষমত র একট অবস থ ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনের দিন অমোচনীয় কালি সরবরাহ না হলে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকবে: ছাত্রদল
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনে অমোচনীয় কালি সরবরাহ না করলে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতারা। এ ছাড়া এমফিল কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা না দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ছাত্রদলকে ভোট প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
রোববার উপাচার্যের সভাকক্ষে রাজনৈতিক ও সক্রিয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত জকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫–এর আচরণবিধিবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় ছাত্রদলের নেতারা এমন মন্তব্য করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সদস্যসচিব শামসুল আরেফিন বলেন, ‘নির্বাচনে যদি কোনো ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটে, তাহলে আমরা একচুল ছাড় দেব না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যদি কোনো ধরনের অনিয়ম হয়— কোনো ছাড় হবে না। নির্বাচনের সময় অমোচনীয় কালি ব্যবহার করতে হবে। যদি নির্বাচন কমিশন অমোচনীয় কালি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকবে।’
ভোটের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ‘ম্যানুয়ালি’ ভোট গণনার দাবি জানিয়ে শামসুল আরেফিন বলেন, ‘কত ব্যালট ছাপানো হলো, কত ভোট গণনা হলো, কত ব্যালট নষ্ট হলো—এসব তথ্য স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করতে হবে। কারণ, আমরা ডাকসুতে ব্যালট কেলেঙ্কারির অভিযোগ সম্পর্কে জানি।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ বিধিমালায় এমফিল শিক্ষার্থীদের ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা না দিয়ে ছাত্রদলকে ‘মাইনাস’ করার একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জকসু গঠন ও পরিচালনা বিধিমালায় বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার পর নিয়মিত শিক্ষার্থী ভোটার কিংবা প্রার্থী ছাড়া কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অন্যদিকে এমফিল শিক্ষার্থীদের ভোটার ও প্রার্থীর যোগ্যতা না দিয়ে আমাদের মাইনাস করা ছিল মাস্টারপ্ল্যান—আর সেই মাস্টারপ্ল্যান সফল হয়েছে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা হাসানের সভাপতিত্বে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য রেজাউল করিম, প্রক্টর, সিন্ডিকেটের সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ ও হল শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন ২০২৫-এর নির্বাচন কমিশনার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।