সারা দিন ধরে একটানা তুষার পড়ছে! কাশফুল রঙে ঢেকে আছে আকাশ। আকাশের চেহারা বলে দেয়, তুষারের এ ধারা জলদি থামবে না! এরূপ তুষার নামা দিনে কামকাজে মন বসে না আমার। দিন কাটে অলসতার ঘোরে। একসময় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামে। দিনের অলসতা মধ্যরাত অবধি জাগিয়ে রাখে আমাকে! একসময় টের পাই একনাগাড়ে সারা দিন ঘরে অবরুদ্ধ থেকে হাঁপিয়ে উঠেছি। বসার ঘরের প্রশস্ত জানালার ঘোমটা টেনে তুলি বাইরবাড়ির উঠোন দেখব বলে। আকাশে একাদশীর চাঁদ উঠেছে। কুয়াশার চাদর ছাড়িয়ে চাঁদের সে রহস্যময় আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। চোখে বিভ্রম ঠেকে—সাদা শুভ্র নীহারের তলে জগৎ সংসারের এই মুল্লুক তলিয়ে আছে! জানালার ওপাশের পাহাড়ি গাছগুলো উধাও! এক দিনে ভোল বদলে শুভ্রসাদা কতগুলো পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
অবশ্য ক্যালিফোর্নিয়ার এই পাহাড়ি অঞ্চলে শীতকালে হিমাদ্রির ভেতর এমনভাবে আটকা পড়া ব্যতিক্রম কোনো ঘটনা নয়! আমি দোর খুলে বাইরে পা বাড়াই। চাঁদের গাম্ভীর্যপূর্ণ আলোর সাথে তুষারের আলিঙ্গন, এই মধ্যরাতকে ঝকঝকে মেঘমুক্ত দিন বানিয়ে দিয়েছে। তবে তুষার আধিক্যে প্রতিদিনের চেনাজানা পথঘাট ঠাওর করতে পারি না! দূরে আমার বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে প্রতিবেশীর বাড়িটি মনে হয় যেন কৈলাস শৃঙ্গের চূড়া, যেদিকে যাওয়ার কোনো পথ নেই! পথের দুধারে সারিবাঁধা পাইনের চিহ্ন ধরে ধরে বাড়ি ছেড়ে মূল সড়ক ধরে এগিয়ে যাই। সড়কের বাঁ দিকে এপাড়ার গলফ খেলার মাঠ। বছরের বেশির ভাগ সময়ে তা বরফের নিচে ঢাকা পড়ে থাকে! এক পাল হরিণ তুষারডোবা খোলা মাঠ পেয়ে নির্ভারে হেঁটে চলেছে। ডান দিকের নীল জলের লেকটি, সেও ওই সাদা বরফের নিচে তলিয়ে গেছে!
পা অবধি লম্বা উলের জাম্পারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে খানিকক্ষণ সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি অনেকটা বরফে ঢাকা পাইনগাছটির মতো নিঃশব্দে। নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে দেখি, অবর্ণনীয় অপার্থিব সৌন্দর্য! দূর পাহাড়চূড়া হীরকখণ্ডের মতো চিকচিক করছে চাঁদের আলোতে। চোখ ঝলসে ওঠা সৌন্দর্যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা মুশকিল! আমি অগোছালো পায়ে তুষার মাড়িয়ে আরও একটু সামনের দিকে এগিয়ে যাই। সহসা লেবু ফুলের গন্ধের মতো ব্যাখ্যাতীত এক সুগন্ধের রেশ টের পাই! লেবু উষ্ণ অঞ্চলে জন্মে, এমন বরফের দেশে এ গাছ জন্মানোর কথা নয়।
তারপরও সুগন্ধির উৎস তালাশ করতে তুষারে নিমজ্জিত রাস্তার ঢালু বেয়ে হ্রদের দিকে এগিয়ে যাই। সেখানে লেবু বুর সাথে দেখা হয়! লেবু বু অথবা লেবু বুবু আদতে আমার বোন নয়। এবং তার সঠিক নামটিও লেবু নয়। সম্পর্কে সে আমার বাবার ছোট বোন। আমার বাবার পর তারা পিঠাপিঠি চার বোন। ছোট বোনেরা বড়দের বুবু ডাকে। আমিও তাদের দেখাদেখি মায়ের শেখানো ফুফু পাল্টে তাদের বুবু ডাকতে শুরু করি। শহরে আমাদের বাস হলেও বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে বছরে বেশ কয়েকবার গ্রামে দাদাবাড়ি বেড়াতে যাওয়া হয়। পাঁচ বছর বয়সী এই আমি তাদের নামের সাথে মানুষটাকে মেলাতে পারি না! কচি মস্তিস্কে বুদ্ধি আঁটে। আমি আমার মতো করে ফুফুদের আলাদা চিনতে কৌশল বের করি! এবং সে নামে তাদের ডাকি। যেমন বাবার এ বোনের মাথায় দিঘল একগাছি কোঁকড়ানো কেশ রয়েছে। এই কেশকন্যার কেশের রূপ দেখলে যে কেউ মোহিত হয়ে পড়ে। কেশ পিঠে এলিয়ে যখন সে হেঁটে বেড়ায়, মনে হয় যেন আকাশ থেকে একখণ্ড বৈশাখী ঝড় ওঠা মেঘ এসে তার পিঠে ভর করেছে। তবে দিনের বেশির ভাগ সময় সে তার চুল কপালের মাঝবরাবর সিঁথি কেটে বাগান-খোঁপা করে রাখে। বিকেলের দিকে একটি লম্বা বেণি আকাশিগাছের ন্যায় পিঠ আঁকরে ঝুলে থাকে। তবে কেশ যে বিন্যাসে থাকুক, সে সব সময় চুলের ভাঁজে ভাঁজে লেবু ফুল গুঁজে রাখে। কেশ দুলিয়ে সে যখন হেঁটে যায়, লেবু ফুলের সুগন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তার শরীরেও সে সুগন্ধের আবেশ। আমি তাতে বিভোর হয়ে সারাক্ষণ তার পিছু পিছু ছুটে বেড়াই। সে–ও আমাকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দেয়। এবং আমি তাকে লেবু বু বলে ডাকতে শুরু করি।
তুষার দুহাতে সরিয়ে আমি লেবু বুর হাত ধরে এগিয়ে যাই। হ্রদের জল জমে পাথরের মতো শক্ত বরফ হয়ে আছে। লেবু বু চোখের ইশারায় হ্রদের ওপারের পথ দেখায়। আমি নির্দ্বিধায় তার হাতটি শক্ত করে ধরে বরফ রাস্তায় হেঁটে এপারে চলে আসি! এপারে সুগন্ধের তীব্রতা বাড়ে। আমি মোহগ্রস্তের মতো লেবু বুর পেছন পেছন ছুটি! জনবসতির কোনো চিহ্ন নেই! ফাঁকা ধু ধু করছে! চোখের সীমানার পুরোটা প্রান্তর পাহাড় সমান তুষারে এমনভাবে ঢেকে আছে যে আসমান–জমিন তফাত করার জো নেই! এ যে ভিন্ন কোনো গ্রহ, যার সাথে পৃথিবীর কোনো সাদৃশ্য নেই! আমি আর লেবু বু ছাড়া এই গ্রহে কেউ নেই! আমরা বরফের সাদা ডানার ওপর ভর করে উড়ে উড়ে দিগন্ত বরাবর এগিয়ে যাই। লেবু বুর গায়ের লেবু ফুলের সুগন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে এক পাল হরিণের দেখা পাই। ধবধবে সাদা স্বচ্ছ কাচের মতো হরিণ। সুগন্ধমাখা পথ ধরে এরাও চার পায়ে আমাদের আগে আগে কোথায় উড়ে চলে যায়! আমরা হরিণ পালের দেখানো পথ ধরে তাদের সাথে সমানে দৌড়ে চলে যাই, ধু ধু প্রান্তের দিকে! একসময় হরিণের পাল মেঘের ভেতর হারিয়ে যায়! আমরা দুজন পথভ্রষ্টের মতো দাঁড়িয়ে যাই! টের পাই এমন ধকলে আমরা অতিরিক্ত ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। এবং খানিক জিরাব বলে সম্মুখে সবুজে ঢাকা দূর্বাঘাসের মাঠে বসে পড়ি। আকস্মাৎ উত্তর দিকে চোখ ফেরাতে দাদাবাড়ির সেই মঠটি চোখে পড়ে!
দাদাবাড়ির এই মঠটির জন্ম ইতিহাস নিয়ে রহস্য থাকলেও তার পাশের জমিদারবাড়িটি অবিদিত নয়। আমার দাদাবাড়ি বিক্রমপুরে, পদ্মা নদীবিধৌত অঞ্চলে। অবশ্য তার পৈতৃক বাড়ি ভারতের আসামে। দাদার পরিবার সাতচল্লিশে দেশভাগের পর বিক্রমপুরে চলে আসে। বিক্রমপুরের এই বাড়িটি ছিল দাদার বাবা জামসেদ খানের বন্ধু জমিদার পুত্র গৌতম রায়ের। গৌতম রায়ের জামসেদ খানের সাথে আসামে ব্যবসা ছিল। ভারতবর্ষ তখনো কাচপাত্রের মতো লন্ডভন্ড হয়ে ভাগ হয়ে যায়নি! প্রকৃত মানুষগুলো তখন কঠিন ধর্মীয় জাতপাতের ছুত এড়িয়েও একত্রে বসবাসে অভ্যস্ত ছিল। সে সময় তারা দুজন খুব কাছের বন্ধু হয়ে ওঠে। তাদের বন্ধুত্বের আবেশ সুগন্ধি ফুলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দুই পরিবারের মধ্যে। এবং ক্রমে দুই পরিবার একে অপরের বন্ধু–স্বজন হয়ে ওঠে। দুই বাড়ির লোকজনের এ-ওর বাড়িতে নির্ভারে যাতায়াতও ছিল। দেশভাগের পরপর সাধারণ মানুষ যখন ব্রিটিশ এবং দেশীয় কুচক্রী নেতাদের হাতের পুতুল বনে গেল, তখন প্রাণে বাঁচতে জামসেদ খান তার বন্ধু গৌতম রায়ের সাথে বাড়ি বদল করে এপারে চলে এল।
জমিদার বাড়ির চেহারা সুরত সাধারণত যেমন হয়, এ বাড়িটি সে রকমই একটি জমিদারবাড়ি। অবধারিতভাবে নদীর ধারে বিশাল জায়গা নিয়ে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িভর্তি বিরল প্রজাতির প্রাচীন গাছগাছড়ায় ভরা। প্রধান দালানটি ছাড়াও জমিদারবাড়ির নানান দিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে আরও ক’খানা দালানঘর। সে রকম একটি ঘর, জমিদার বাড়ির কাছারিঘর। প্রায় নদী ঘেঁষে এখনো কোনোমতে মাজাভাঙা গাঁয়ের বয়স্ক মুরব্বির মতো টিকে আছে। এককালে এই কাছারিঘরটি খুব সরব ছিল। এ তল্লাটের জ্ঞানীধ্যানী লোকের আলাপ পরামর্শে বিভোর হয়ে থাকত বাড়িটি। জমিদারি প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হতে এই কাছারিঘরটি বেকারের খাতায় নাম লেখায়। আর এ সুযোগে বাড়ির চারপাশে আকামি গাছপালা গজিয়ে প্রায় জঙ্গলে রূপ নেয়। এই কাছারিঘরের পাশে পুরোনো কালের একটি লাল ইটের মঠ। মঠটির মাথা ভাঙা। মঠটির প্রকৃত ইতিহাস জানা যায় না। এলাকার লোকেরা মঠটি নিয়ে বিভিন্ন মিথের জন্ম দিয়েছে। তা ছাড়া বাড়ির সামনে–পেছনে অনিবার্য পাকাঘাটলা টানা বিশাল আকারের দুটি পুকুর রয়েছে। ঘাটলার সিমেন্ট বালু ক্ষয়ে ক্ষয়ে ইট–সুরকি বেরিয়ে গেছে। সবুজ শ্যাতলা-জমা পিচ্ছিল ঘাটলা কেউ আজ আর পাড়ায় না। সব মিলিয়ে বাড়িটির পরিবেশ যথেষ্ট অতিপ্রাকৃত গোছের। দাদার পরিবার এমন গা ছমছম বাড়িতে এসে প্রথম প্রথম ভয়ে সারা রাত ঘুমাতে পারত না! যদিও আসামে তাদের বাড়িটির বিশালত্বও কোনো অংশে কম ছিল না কিন্তু জমিদার বাড়ির মতো এমন নিভৃত তো ছিল না।
আমার দাদা তার মায়ের থইলা-ঝাড়া সন্তান। দাদার দুই বছর বয়সে তার পরিবার এপারে চলে আসে। কাজেই তার মস্তিষ্কে নিজ দেশ আসামের কোনো স্মৃতি নেই! তবে বয়সকালে দু–চারবার আসামে গেলেও তার ভেতরে জন্মভূমির জন্য আলাদা কোনো টান দেখা যায় না; কিন্তু জামসেদ খান নিজ ভূমি আসাম ছেড়ে এসে জন্মভূমির মায়া কাটিয়ে উঠতে পারে না। তার আত্মা পড়ে থাকে বন্ধু-স্বজনদের কাছে সেই আসামে। তবে নিজ দেশে ফেরার সমস্ত পথও তত দিনে বন্ধ হয়ে যায়! দুই দেশেই তখন ধর্মের ভিত্তিতে চরমভাবে রায়টের দাপট চলছে! দেশভাগের পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো যে সেই মুহূর্তে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। পরিবারের দুজন মানুষ কলিকাতা রায়টে প্রাণ হারাল। তখন প্রাণে বেঁচে থাকাটা একমাত্র জরুরি বিধায় গোপনে এপারে এসে স্বধর্মীয়দের কাছে আশ্রয় খোঁজা ছাড়া বিকল্প ছিল না! কিন্তু দেশ এবং সব বন্ধু–স্বজন ছেড়ে যাদের ভরসায় এরা এ দেশে চলে আসে, সেই দেশের মানুষ তাদের কাছের করে নিতে পারে না! স্থানীয় লোকজন নিজধর্মীয় এবং একই ভাষা হওয়া সত্ত্বেও তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নানাভাবে এ পরিবারকে তারা হেনস্তা করতে থাকে। বিষয় সম্পত্তি জোর করে দখল করে। মেয়ে–বউদের লাঞ্চিত করে। দেশে বিচারব্যবস্থা তখন এতটাই ঠুনকো যে জোরদখল, খুনখারাবি অহরহ নির্ভারে ঘটছে এবং এসবের কোনোরকম বিচার সুরাহা হয় না।
সবকিছু মিলিয়ে দেশভাগের পর লম্বা সময় ধরে জামসেদ পরিবারটিকে একটি বিমর্ষ-অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যায়। এরূপ ধকল এবং জন্মভিটের অমোঘ টানে পরিবার প্রধান জামসেদ খানের মানসিক অবস্থা ক্রমে অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। একসময় সে জীবনের খেই প্রায় হারিয়ে ফেলে। আধপাগল হয়ে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। লোকজনের এমনকি আপনজনের সংস্পর্শ সহ্য করতে পারে না। তাদের কাছারিঘরটি জমিদার পরিবার চলে যাওয়ার পর থেকে অকেজো হয়ে পড়ে আছে! সাপগোপ পশুপাখি আস্তানা বেঁধেছে। গাঁয়ের লোকজন নাকি দিনদুপুরে সেখানে ভূতের আনাগোনা দেখে! মন্দলোকের অভয়ারণ্য সেই কাছারিঘর এবং মঠের আশপাশে জামসেদ খান একা একা ঘুরে বেড়ায়। এবং একদিন তাকে এই মঠের পাশে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার শরীরে যথেষ্ট জখমের দেখা মেলে। এবং খুনের সুস্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া গেলেও গাঁয়ের লোক তাকে ভূতে মেরেছে বলে গুজব রটায়। জামসেদ পরিবার বিরূপ পরিস্থিতির কারণে গাঁয়ের লোকের এমন মনগড়া অভিপ্রায় মেনে নিতে বাধ্য হয়। কাছারিঘরের পাশে উঠোনে জামসেদ খানকে দাফন করা হয়। সেই থেকে কাছারি বাড়িটির নাম হয়ে যায় ভূতের বাড়ি!
জামসেদ খান মারা গেলে দাদাদের সাত ভাইয়ের মধ্যে বিশাল এই জমিদারবাড়ি ভাগ হয়ে যায়। আমার দাদার ভাগে এই ভূতের বাড়ির অংশও পড়ে। কিন্তু তারা প্রধান বাড়ির অংশে বাস করায় ভূতের বাড়ি আগের মতো খালি পড়ে থাকে। পারতপক্ষে মানুষজন খুব ঠেকায় না পড়লে সে বাড়ি মাড়ায় না। দিনের বেলা ছুটা গরু–ছাগল চরে বেড়ায়। বিকেলবেলায় গাঁয়ের দুষ্ট লোকের তাসের আড্ডা বসে। বেশি রাতে মাঝেমধ্যে জুনিপোকার আলোর সাথে কুপিবাতির আলোও দেখা যায়। মদ–তাড়ির আড্ডা এবং চোর ধাওরের আস্তানা যাকে বলে! ভূতের বাড়িতে ভূতের সাথে পশুপাখি এবং গাছপালা বাস করে। প্রাচীন সব গাছপালার সাথে সমানে পাল্লা দিয়ে জংলা প্রকৃতির গাছপালাও জন্মায়। কিন্তু জামসেদ খানের কবরের চারপাশের উঠোনজুড়ে এক গাদা পাতিলেবুগাছ একত্রে কী করে গজাল, তার সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারে না! তবে পাতিলেবুগাছগুলো যে কোনো মানুষ লাগায়নি, তা বেশ স্পষ্ট! লোকের ধারণা, এসব পাতিলেবুগাছ এক রাতে জিনে লাগিয়েছে। জিনেরা বিরাট শক্তিশালী এবং কর্মঠ। এক দফায় মেশিনের আদলে এরা কাজ করে! তাই অকালে মরার ভয়ে জিনে লাগানো এসব গাছের লেবু কেউ ছুঁয়েও দেখে না!
কিন্তু লেবু বু এসব বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করে না। তা ছাড়া ভূতপ্রেতে তার একদম ভয় তো নেই-ই, বিশ্বাসও নেই! সকাল-বিকেল সে ভূতের বাড়িতে পড়ে থাকে। ভূতের বাড়ির ব্যাঙের ছাতার মতো উঁচু ঢিবির উঠোনে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। উদাস হয়ে গান গায়। জামসেদ খানের সমাধি পাশের লেবুবাগানের লেবু ফুল কুড়ায়। আমিও দাদাবাড়ি বেড়াতে এসে লেবু বুর পিছু পিছু ভূতের বাড়ি বেড়াতে যাই। আমি অবশ্য ভূতের ভয়ে লেবু বুর ওড়নার আঁচল শক্ত করে ধরে রাখি! সে আমাকে দুই হাতে আগলে রাখে। তার কাছে ভূতের বাড়ির গল্প শুনি। এবং কোঁচর ভর্তি করে পাতিলেবুর ফুল কুড়াই। লেবু বু লম্বা সুতার মালা গাঁথে। তার বাগান-খোঁপায় কিংবা বেণিতে পাতিলেবুর ফুলের মালা ঝুলে থাকে। সে মালার সুগন্ধ ছেয়ে যায় পুরো গাঁয়ে।
একসময় ভূতের বাড়ির সীমানা কমতে শুরু করে! অবশ্য এই শুরুটা হালের কালে নয়, অনেককাল আগে থেকে শুরু হয়েছে! গৌতম রায়ের বাবা দরদি জমিদার ছিলেন। একদিন পদ্মাপাড়ে বেড়াতে গিয়ে এক নদীভাঙা অসহায় পরিবারের সাথে তার দেখা হয়। সে তাদের বিশাল জমিদারবাড়ির কাছারিঘরের পাশের জমির এক কোনায় ঘর তুলে থাকার ব্যবস্থা করেন। এবং পরিবারটিকে তার অধীনে বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দেন। এরা কাজে বেশ সরস। অল্প দিনে জমিদারের মন জয় করে ভৃত্যশ্রেণির কাজ থেকে পাইক–পেয়াদার কাজে নিয়োগ পেয়ে যায়। জমিদারের মৃত্যুর পর তার ছেলে গৌতম রায়ের প্রশ্রয়ে জমিদার পরিবারের খুব কাছাকাছি চলে আসে। একসময় দেখা যায় গৌতম রায়ের সম্পদের দেখভালের পুরো দায়িত্ব এই পরিবারের কাছে চলে আসে।
কিন্তু গৌতম রায় দেশভাগের পর ওপারে চলে গেলে জামসেদ খানের কাছ থেকে এরা তেমন সুযোগ–সুবিধা পায় না। অবধারিতভাবে তাদের আয়রোজগারে ভাটা পড়ে। বিধায় জামসেদ খান স্বধর্মের লোক হলেও শুরু থেকে এই পরিবার তাদের বিরুদ্ধে। এবং গোপনে জমিদারের বেঁধে দেওয়া জায়গা ছাড়িয়ে এরা কাছারিঘর এবং এর আশপাশের জায়গা দখল নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। জামসেদ খান অবশ্য তাদের উদ্দেশ্য টের পান এবং উকিল ধরে এর একটি বন্দোবস্ত করতে চেষ্টা করেন। এবং স্পষ্ট যে এ বিষয়ের জের ধরেই জামশেদ খানকে খুন হতে হয়।
তিনি উগ্র হিন্দুদের কাছ থেকে প্রাণে বাঁচতে স্বধর্মের লোকদের দেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন। প্রতিদানে তারা তাকে হত্যা করে! ‘জামসেদ পরিবারটি মুসলিম হলেও এরা ভারতীয় এবং এদের রক্তে-সংস্কৃতিতে হিন্দুত্ববাদ রয়ে গেছে’—এমন একটি কুসংস্কারে গাঁয়ের প্রায় সবাই বিশ্বাস করে! এবং এ সুযোগে গাঁয়ের প্রায় সবাই অনায়াসে জামসেদ খানের মৃত্যুর কারণ ভূতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস পায়। জামসেদ খানের মৃত্যুর পর জমিদারবাড়ির জায়গাজমি দখল আরও সহজ হয়ে যায়। আমার দাদার ভূতের বাড়ির অংশও রেহাই পায় না! জমিদারের বাড়ির এক কোনায় আশ্রয় পাওয়া পরিবারটি এখন জনে-বলে পরিপুষ্ট, তা ছাড়া এরা স্থানীয় আর আমাদের গায়ে ওপারের দেশের গন্ধ লেগে আছে! গাঁয়ের বেশির ভাগ লোক সে দলে ভিড়ে থাকে। বিভিন্নভাবে এরা জামসেদ পরিবারকে হয়রান করে! এরা ভূতের বাড়ির বড় বড় গাছ কেটে প্রায় সাফ করে ফেলে! এবং সেখানে গোয়ালঘর, হাঁস–মুরগির খামার করে জায়গাটি নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়! বাধ্য হয়ে আমার দাদা গ্রাম্য বিচার–সালিস ডাকে। সালিসে কোনো রকম সুরাহা না হলে তাকে থানা–পুলিশ করতে হয়! থানায় মামলা চলতে থাকে। বছর ঘুরে বছর আসে! মামলা চলতেই থাকে! মামলার কোনো কূলকিনারা হয় না।
কিন্তু এত কিছুর পরও লেবু বু–কে কিন্তু ভূতের বাড়ি থেকে ফেরানো যায় না। প্রতিদিনের মতো সেদিনও সে বিষণ্ন মনে ভূতের বাড়ির উঠোনে পা ঝুলিয়ে বসে থাকে। উঠোনজুড়ে লেবুবাগানের বেশির ভাগ লেবুগাছ এরই মধ্যে নাই হয়ে গেছে। কেবল জামসেদ খানের কবরের পাশে গুটিকয় পাতিলেবুর গাছ অবশিষ্ট আছে। তাতে তুষার ফুলের মতো ধবধবে সাদা ফুল ফুটেছে। লেবু বুর বেণিতে সে ফুলের মালা ঝুলছে এবং সেখান থেকে সুগন্ধের রেশ ছড়িয়ে পড়ে পুরো দুনিয়াময়। বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামে। লেবু বু বাড়ি ফেরে না! পুব আকাশে কাঁসার থালার মতো মস্ত বড় একটি চাঁদ ভেসে ওঠে। চাঁদের আলোতে সন্ধ্যার আঁধার মিলিয়ে দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে পৃথিবী। রাত বাড়ে, চাঁদের আলোর ঝলক বাড়ে! প্রকৃতি ধবল বকের ডানার মতো শুভ্র–সাদা চাদরে ঢেকে যায়। ফকফকা পরিষ্কার সে আলোতে ভূতের বাড়ির উঠোনে লেবু বুর বিবস্ত্র লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়! সেই লাশের নিতম্ব-ছেঁড়া রক্তধারায় ভিজে ওঠে ভূতের বাড়ির নির্মম উঠোন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ই ক ছ র ঘর গ তম র য় র দ র পর ব র ই পর ব র আম র দ দ র ঘর র প পর ব র র রব ড় র র বন ধ আম র ব দ র আল প রক ত ল কজন বরফ র র এমন অবশ য
এছাড়াও পড়ুন:
ভারত–পাকিস্তান লড়াই: একসময় আগুন জ্বলত, এখন শুধু ধোঁয়া
ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক সব সময়ই দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশল অনুযায়ী এগিয়েছে।
অতীতেও দ্বিপক্ষীয় সিরিজে লম্বা বিরতি দেখা গেছে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৮—টানা ২৪ বছর পাকিস্তান সফরে যায়নি ভারত। আবার ১৯৬০ সালের পর পাকিস্তানও প্রথমবারের মতো ভারতে খেলতে যায় ১৯৭৯ সালে।
এরপর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান নিয়মিত মুখোমুখি হয়েছে। এই সময়ে ভারত তিনবার পাকিস্তান সফরে গিয়ে খেলে ১২ টেস্ট, পাকিস্তানও ভারতে গিয়ে খেলে ৮ টেস্ট।
দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান তিন টেস্ট খেলতে ভারতে যায়। এর মধ্যে একটি ছিল কলকাতার ইডেন গার্ডেনে প্রথম এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। ভারত ফিরতি টেস্ট সিরিজ খেলতে পাকিস্তানে যায় ২০০৪ সালে, যা ছিল ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকারের অভিষেকের পর প্রথমবার।
২০০৪ সালের পাকিস্তান সফরে কড়া নিরাপত্তায় ব্যাটিংয়ে নামেন শচীন টেন্ডুলকার