সরকারিভাবে নদী মারার ফল ‘ভবদহ জলাবদ্ধতা’
Published: 5th, June 2025 GMT
নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক না রাখলে পরিণতি কত ভয়ংকর হতে পারে, তা যশোরের ভবদহে দেখে এলাম। গণমাধ্যমসূত্রে দীর্ঘকাল ধরে যশোরের ভবদহের জলাবদ্ধতার কথা শুনে আসছি। সরেজমিন সেই জলাবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধান করে এলাম। ভবদহে জলাবদ্ধতার যে ধরন দেখে এলাম, দেশে সরকারিভাবে এমন জলাবদ্ধতা তৈরি করার দৃষ্টান্ত অনেক আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজে সিদ্ধহস্ত।
ভবদহ জলাবদ্ধতা বোঝার আগে আমাদের সেখানকার নদী সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। যশোর সদর উপজেলা থেকে মুক্তেশ্বরীর নামে একটি নদী চলে এসেছে অভয়নগরের দিকে। মাঝপথে একটি প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হয়ে মুক্তেশ্বরীর নাম হয় টেকা।
অভয়নগর বাজারের ঠিক পাশেই শ্রী নামে একটি নদী এসে মিলিত হয়েছে টেকা নদীর সঙ্গে। এরপর টেকা নাম বদলে হয়েছে হরি নদ। ঠিক যেখানে হরি নাম হয়েছে, তার বাঁ তীর থেকে শ্রী নামে আরেকটি নদী বিল ডাকাতিয়া দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। হরি নদের ভাটিতে আপারভদ্রা নামে আরেকটি নদী এসে মিলিত হয়েছে। তখন হরি নদের নাম হয়েছে তেলিগাতী গ্যাংরাইল, যা শিবসা নদী হয়ে চলে গেছে সমুদ্রে।
ভবদহ বাজার থেকে নদীর ভাটিতে প্রচুর পলি জমেছে। নদীটির দুই দিকে অনেকাংশ অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে গেছে। মাছের ঘের, দোকানপাট, বাড়িসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে নদীতে। দেখলাম, পানি উন্নয়ন বোর্ড হরি নদের মাটি তুলে নদের ভেতরে ফেলেছে। ফলে নদটি অনেক সংকুচিত হয়েছে। জোয়ারের সময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি উজানে চলে আসে। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ষাটের দশকে হরি নদের ভবদহ নামক স্থানে জোয়ারের পানি যাতে আসতে না পারে, সে জন্য ২১ ভেন্টের একটি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। কেবল তা–ই নয়, শ্রী নামের উপনদী এবং শাখানদী—উভয় অংশের মুখ বন্ধ করা হয়েছে। হরি নদের শাখা হিসেবে যে অংশ প্রবাহিত হতো, সেটিও ৪০০-৫০০ ফুট প্রশস্তের।
২১ ভেন্টের স্লুইসগেট তৈরি করার মাধ্যমে সমুদ্রের লোনাপানি টেকা নদী ও শ্রী নদীতে যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। এতে প্রথম কয়েক বছর লবণাক্ত জোয়ারের পানির প্রবাহ বন্ধ করে চাষাবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছিল। ১৫-২০ বছরের মধ্যেই স্লুইসগেটের ভাটিতে প্রচুর পলি জমা হয় এবং বর্ষার পানি স্লুইসগেট খুলে দিলেও আর নিচে নামে না। কারণ, ভাটিতে পলি পড়ে অনেক উঁচু হয়েছে। গত শতকের আশির দশক থেকে ক্রমে জলাবদ্ধতা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
ভবদহ এলাকায় অনেক নিম্নাঞ্চল আছে। ভবদহের যে স্থানে ২১ ভেন্টের স্লুইসগেট আছে, তার উজানে ৫২টি নিম্নাঞ্চল আছে। নদীর ডান তীর–সংলগ্ন আরও ১২৯টি নিম্নাঞ্চল আছে। আগে এগুলোতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করত। এখন লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে না। কিন্তু ভাটি উঁচু হওয়ার কারণে অভয়নগর থেকে শুরু করে যশোর জেলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়। জলাবদ্ধতায় কয়েকটি উপজেলায় বাড়িঘর-সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়।
নদীকে নদীর মতো থাকতে দেওয়া না গেলে ভবদহ জলাবদ্ধতা দূর হবে না। বর্তমানে ভবদহ এলাকায় ঘেরপদ্ধতিতে প্রচুর মাছ চাষ করা হয়ে থাকে। নদী উন্মুক্ত থাকলে ঘেরপদ্ধতিতে মাছ চাষ করা কঠিন হবে না। ভবদহ সংকট নিরসনে দীর্ঘ মেয়াদে পরিবেশ-প্রতিবেশের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবেভবদহ জলাবদ্ধতা থেকে উত্তরণে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুবার ড্রেজার মেশিনও আনা হয়েছিল খননের জন্য। এ ছাড়া কয়েকবার খনন করা হয়েছে। কিন্তু খননের কয়েক বছরের মধ্যে আবার পলি পড়ে ভরাট হয় নদী। একবার এ নদীর জোয়ারের পানি একটি বিলের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় ব্যক্তিদের ভাষ্য অনুযায়ী, সেটাতে কিছুটা ভালো ফল পাওয়া গেছে।
ভবদহ এলাকায় দেখলাম, ২১ ভেন্ট এবং ৬ ভেন্টের উজানে মোট ২০টি পাম্প দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পানি তুলে ভাটিতে দেওয়া হয়। আরেকটি ৩ ভেন্টের স্লুইসগেট তৈরি করেছে বিএডিসি। স্থানীয় লোকজন বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ সাপেক্ষে সেখানেও পাম্প চালু করেছে। কেবল পাম্প করে পানি তুলে জলাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব নয়।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবদহে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২১ ভেন্টের এই স্লুইস গেটটি ভবদহ জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ২১ ভ ন ট র স ল ইসগ ট লবণ ক ত র ভবদহ এল ক য় নদ র ভ প রব হ ত হয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
এ যেন এক অন্তহীন দুর্ভোগ
যশোরের ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতার বিষয়টি অনেক বছর ধরে প্রথম আলোর নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসছে। এ নিয়ে অনেকবার সম্পাদকীয়ও করা হয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকারের নীতিনির্ধারণে পরিকল্পনাহীনতা ও সমন্বহীনতার অন্যতম দৃষ্টান্ত হতে পারে ভবদহের সংকট। টানা বৃষ্টির ফলে ভবদহের ৩০টি গ্রাম আবারও তলিয়ে গিয়ে চরম জলাবদ্ধতা তৈরি করেছে। দুর্ভোগ থেকে এ অঞ্চলের মানুষের কি মুক্তি মিলবে না কোনো দিন?
প্রতিবছর বর্ষা এলেই ভবদহ অঞ্চলের মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। আর এবার তো জুলাই মাসের ২৭ তারিখেই বৃষ্টির পরিমাণ ৫১৪ মিলিমিটারে পৌঁছেছে, যা গত জুনের গড় বৃষ্টিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফলস্বরূপ, ৫২টি বিল প্লাবিত হয়ে সেই পানি উপচে পড়ছে আশপাশের গ্রামে। বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি ধর্মীয় স্থাপনাও রক্ষা পাচ্ছে না।
এ দুর্ভোগের মূল কারণ কী? ভবদহ অঞ্চলের পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা মূলত মুক্তেশ্বরী, টেকা, হরি ও শ্রী নদীর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বছরের পর বছর ধরে পলি জমে এ নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে পানি ধারণ ও নিষ্কাশনক্ষমতা কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিত বাওয়ালির অভিযোগ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ২১ ভেন্ট স্লুইসগেটের মাত্র ছয়টি গেট খোলা রাখা হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, টিআরএম (জোয়ারাধার) চালু না করলে এ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি নেই।
তবে আশার আলো বলতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কিছু উদ্যোগের কথা জানিয়েছে। আগামী আগস্ট মাস থেকে প্রায় ৮১ কিলোমিটার নদী খননের কাজ শুরু করবে সেনাবাহিনী। এ ছাড়া আমডাঙ্গা খাল সংস্কারে ৪৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও হাতে নেওয়া হয়েছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানিয়েছেন, জোয়ারের সময় স্লুইসগেটের বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সেচে বের করা হচ্ছে এবং ভাটার সময় গেটগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে।
নদী খনন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। আমডাঙ্গা খালের সংস্কারকাজও দ্রুত শুরু হওয়া জরুরি। কিন্তু এ মুহূর্তে যে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন, তাঁদের তাৎক্ষণিক স্বস্তির জন্য কী করা হচ্ছে? ২১ ভেন্ট স্লুইসগেটের সব গেট খুলে দেওয়ার দাবি কেন পূরণ হচ্ছে না? টিআরএম চালুর বিষয়টি কেন এখনো উপেক্ষিত?
ভবদহের এ সংকটের বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সবাই ভালোভাবেই অবগত। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সবাই সে এলাকা পরিদর্শন করেছেন। এ অঞ্চল নিয়ে নানা সময়ে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই এ অঞ্চলের সংকট নিরসন হয় না। ভবদহের কান্না কবে ফুরাবে, এটিই শুধু আমাদের প্রশ্ন।