‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারিকা লাক।’ অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা ভাষাভাষী মুসলিমদের মুখে একই ধ্বনি। তাঁদের চোখ অশ্রুসিক্ত, হৃদয় বিগলিত। তাঁদের সুমধুর এই কণ্ঠস্বরে আছে গভীর আনুগত্য, আছে পাপমুক্তির আর্তি। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁরা সমবেত হয়েছিলেন আরাফাতের প্রান্তরে।
গতকাল বৃহস্পতিবার আরাফাতের ময়দানে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে। হজের
তিন ফরজের অন্যতম একটি হচ্ছে হাজিদের আরাফাতের ময়দানে অবস্থান। তাই তো সাদা ইহরামে মোড়ানো পুরুষ এবং যথাযথ নিয়ম
মেনে পোশাক গায়ে নারী হাজিরা মিনায় একটি
রাত কাটিয়ে গতকাল সকালে ট্রেনে বা বাসে
চড়ে অথবা হেঁটে আরাফাতের প্রান্তরে সমবেত হয়েছেন।
আল্লাহর মেহমানরা আরাফাতের ময়দানে
গিয়ে কেউ পাহাড়ঘেঁষা স্থানে, কেউ মসজিদে নামিরার পাশে বা জাবালে রহমতের নিচে অবস্থান নেন। এই একটি দিনে সবার একটাই চাওয়া—আল্লাহর নৈকট্য লাভ।
আত্মশুদ্ধির অভূতপূর্ব সমাবেশ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক.
আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে ছিলেন মিসরের মারওয়া আল-সাঈদ নামের এক নারী। তিনি ছিলেন আবেগাপ্লুত। তিনি আরব নিউজকে বলছিলেন, ‘যেই জায়গায় মহানবী (সা.) দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানে নিজে দাঁড়ানোর অনুভূতি অন্য রকম। আর এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে যাওয়ার মাহাত্ম্য কতটা তা আল্লাহ নিজেই বলেছেন। এখানে যাঁরা আসেন তাঁদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, “তোমার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে।” এটি সত্যিই হৃদয়কে বিগলিত করে। আমরা আন্তরিকভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করি এবং আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ইনশা আল্লাহ, আমাদের ক্ষমা করে দেওয়া হবে। এই দৃশ্যটা রাজকীয়, এত মানুষের ভিড় আপনাকে সত্যিই শিহরিত করবে।’
এবার হজের খুতবা দেন সৌদি আরবের শুরা কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারম্যান, উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়াহ অনুষদের সাবেক ডিন এবং মসজিদুল হারামের প্রবীণ ইমাম ও খতিব শায়েখ সালেহ বিন হুমাইদ।
বিগত বছরের মতো এবারও বাংলায় খুতবার লাইভ অনুবাদ করা হয়। বাংলা অনুবাদক ও লাইভ ভাষ্য দেন বাংলাদেশের মুহাম্মদ খলিলুর রহমান মাক্কী।
হজের খুতবাশায়েখ সালেহ বিন হুমাইদ হজের খুতবায় বলেন, এ দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ। এই দিনে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে অসংখ্য বান্দাকে মুক্তি দেন। এই দিনে তিনি বান্দার নিকটবর্তী হন। ফেরেশতাদের কাছে আরাফাতের ময়দানে পুণ্যার্থীদের নিয়ে গর্ব করেন।
এই দিনে বেশি বেশি করে আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁকে স্মরণ করতে হাজিদের প্রতি আহ্বান জানান শায়েখ সালেহ। আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করার পরামর্শ দিয়ে খতিব বলেন, আরাফাতের ময়দান এমন এক স্থান, যেখানে দোয়া কবুল হয়।
শায়েখ সালেহ খুতবায় আল্লাহর কাছে বিশ্বের পূর্ব ও পশ্চিম তথা মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় দোয়া করেন। সবার মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা তৈরি করতে দোয়া চাওয়া হয়।
খুতবায় ফিলিস্তিনিদের প্রসঙ্গটিও আসে। শায়েখ সালেহ খুতবায় ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার এবং তাঁদের সার্বিক বিষয়ের তত্ত্বাবধান চেয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য দোয়া করেন। শত্রুর অনিষ্ট থেকে যেন আল্লাহ তাঁদের রক্ষা করেন, সেই দোয়া করা হয়।
শায়েখ সালেহ বিন হুমাইদ মুসলিম শাসকদের সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।
গরম থেকে রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থাআল্লাহর মেহমানদের যাতে গরমে সমস্যা না হয়, সে জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। এবার হজে ১৫ লাখ মুসলিম অংশ নিচ্ছেন।
গত সপ্তাহে সৌদি হজমন্ত্রী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছিলেন, গরমে যাতে ছায়া পাওয়া যায়, সে জন্য ছায়াযুক্ত এলাকার পরিমাণ ৫০ হাজার বর্গমিটার (১২ একর) বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রচুর চিকিৎসক প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং চার শতাধিক কুলিং ইউনিট বসানো হয়েছে।
নিবন্ধন নেই, এমন হজযাত্রীদের ব্যাপারে সৌদি সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কারণ, তাঁদের অনেকেই হজের পূর্ণ সুবিধা পান না। তা ছাড়া গত বছর যেসব হজযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের ৮০ শতাংশের বেশি ছিলেন এ ধরনের।
গতকাল মিনা থেকে আরাফাতের পথে হাঁটা হাজিদের মধ্যে বরফের প্যাকেট বিতরণ করা হয়। অনেকেই গরম থেকে বাঁচতে সেই ছোট ব্যাগগুলো মাথায় রাখেন।
আরাফাতের ময়দানে তাপমাত্রা প্রায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছিল। এ সময় পাহাড়ের কাছাকাছি কেউ দীর্ঘ সময় থাকলে কর্মকর্তারা তাঁদের সরিয়ে নিচ্ছিলেন। পাহাড়ের পাদদেশে কুয়াশার মতো পানি ছিটানো ও ঠান্ডা বাতাস ছাড়তে কুলিং পাখা বসানো ছিল।
জোহর ও আসরের জামাত একসঙ্গেআরাফাতের ময়দানে অবস্থিত ঐতিহাসিক মসজিদ নামিরা। সেখানে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে জামাতে আদায় করেন হাজিরা। সেখানে এক আজানে, দুই ইকামতে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে আদায় করেন তাঁরা।
আরাফাতের ময়দান: ইতিহাস ও মাহাত্ম্য
এই আরাফাতের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে প্রায় ১৪০০ বছর আগে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর সেই বাণী এখনো মুসলিম উম্মাহর পথনির্দেশ। আরাফাতের ময়দান দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে প্রায় দুই মাইল, তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত। রয়েছে হাজারও অস্থায়ী তাঁবু, খাদ্য ও পানীয়র ব্যবস্থা, শৌচাগার, স্বাস্থ্যসেবা।
ইসলামি শরিয়তে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আরাফাতে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত না হলে হজ পূর্ণ হয় না। তাই মক্কার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাজিদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে স্বল্প সময়ের জন্য এখানে আনা হয়।
গন্তব্য মুজদালিফাগতকাল সূর্যাস্তের পর হাজিরা রওনা হন মুজদালিফার উদ্দেশে। পথে মাগরিবের সময় হলেও নামাজ পড়া যাবে না—এটাই শরিয়তের নির্দেশনা। মুজদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে আদায় করেন তাঁরা। সেখানে খোলা আকাশের নিচে তাঁরা রাত্রিযাপন করেন।
আজ শুক্রবার মুজদালিফায় ফজরের নামাজ পড়ে হাজিরা পাথর সংগ্রহ করবেন এবং আবার মিনায় ফিরে যাবেন। সেখানে জামারাতে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করবেন আজ। এরপর সূর্যোদয়ের আগেই ফিরে যাবেন মিনার তাঁবুতে।
জামারায় পাথর নিক্ষেপআজ সকালে মিনায় ফিরে হাজিরা বড় জামারাতে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করবেন। এরপর পশু কোরবানি করা হবে। অধিকাংশ হাজি আগেই কোরবানির টাকা ব্যাংকে জমা দিয়েছেন। কেউ কেউ নিজ উদ্যোগেও কোরবানি দেবেন। এরপর বিধান অনুযায়ী পুরুষ হাজিরা মাথা মুণ্ডন করবেন।
১১ ও ১২ জিলহজ তিনটি জামারাতে (ছোট, মাঝারি ও বড়) পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। এরপর আবার পবিত্র মক্কায় ফিরে ফরজ তাওয়াফ সারবেন হাজিরা। এর মাধ্যমে হজের আনুষ্ঠানিতা শেষ হবে। এরপর যাঁরা মদিনায় যাননি, তাঁরা মদিনায় যাবেন।
পবিত্র হজের প্রতিটি পর্বে জড়িয়ে আছে আত্মত্যাগ, সহনশীলতা, সংযম আর মানবিকতা। আরাফাতের ময়দানে এক দিনের উপস্থিতি, একসঙ্গে নামাজ, মোনাজাত—সব মিলিয়ে বৃহস্পতিবার ছিল মুসলিম উম্মাহর ফজিলতপূর্ণ সবচেয়ে বড় মহিমান্বিত দিন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প র ন তর আর ফ ত র প ব যবস থ একসঙ গ র জন য আল ল হ গতক ল করব ন অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতের অর্থনীতি মৃত, ট্রাম্প ঠিকই বলেছেন: রাহুল
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক কথাই বলেছেন, ভারতের অর্থনীতি মৃত।
আজ বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে রাহুল এই মন্তব্য করার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সেও একই কথা লেখেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই ভারতের অর্থনীতিকে মেরে ফেলেছেন।
গতকাল বুধবার নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ স্যোশালে ট্রাম্প লেখেন, ‘ভারত ও রাশিয়া—দুই দেশের অর্থনীতিই মৃত। দুই দেশের মধ্যে কী বোঝাপড়া হয়েছে, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তারা একই সঙ্গে মৃত অর্থনীতি নিয়ে রসাতলে যেতে পারে। ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য খুবই কম। ওদের শুল্কহার প্রচণ্ড চড়া। পৃথিবীর সর্বোচ্চ। রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য হয় না বললেই চলে। অতএব, ও নিয়ে না ভাবলেও চলবে।’
আজ সংসদ ভবন চত্বরে গণমাধ্যম রাহুলকে ট্রাম্পের ওই মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ভারতের অর্থনীতি যে মৃত, তা সবাই জানেন। আপনারা জানেন না? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ ছাড়া এই সত্য সবার জানা। আমি খুশি যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সত্যি কথাটা বলেছেন। গোটা পৃথিবী জানে ভারতের অর্থনীতি মৃত। আদানিকে সাহায্য করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে বিজেপি।’
এরপর রাহুল একই কথা ‘এক্স’ মারফতও জানান। সেখানে তিনি লেখেন, ‘ভারতের অর্থনীতি মৃত। মোদি মেরে ফেলেছেন।’ এরপর পাঁচটি কারণ দেখিয়ে রাহুল ব্যাখ্যা করেন, কেন ও কী কারণে ভারতের অর্থনীতির পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে—১. আদানি-মোদি অংশীদারত্ব; ২. নোট বাতিল ও ত্রুটিযুক্ত জিএসটি; ৩. ভারতে যন্ত্রাংশ জোড়া লাগানো বা ‘অ্যাসেম্বল ইন ইন্ডিয়া’ নীতি; ৪. মধ্যম ও ক্ষুদ্র শিল্প ধ্বংস করে দেওয়া এবং ৫. কৃষকদের নাভিশ্বাস তুলে দেওয়া।
এই পাঁচ কারণ দেখানোর পর রাহুল লেখেন, ‘দেশের যুব সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ মোদি তছনছ করে দিয়েছেন। কারণ, কোথাও কোনো চাকরি নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কনীতি নিয়ে রাহুল বলেন, ‘দেখে নেবেন, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তি হবে। ট্রাম্পই সেই চুক্তির সংজ্ঞা ঠিক করবেন, মোদি স্রেফ তাঁর নির্দেশ মেনে নেবেন।’
রাহুল আরও বলেন, ‘মোদি স্রেফ এক ব্যক্তি বিশেষের জন্য কাজ করেন। শিল্পপতি গৌতম আদানি। দেশের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও পররাষ্ট্রনীতি তিনি ধ্বংস করে দিয়েছেন।’