চট্টগ্রামে চামড়া কিনে বিপাকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা, দাম পাচ্ছেন না
Published: 7th, June 2025 GMT
ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ বেলাল দুই দশক ধরে চামড়ার ব্যবসা করেন। তবে স্থায়ী ব্যবসায়ী তিনি নন, ঈদের দিনই চলে তাঁর বিক্রিবাট্টা। গত বছর চামড়া বেঁচে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা লোকসান দিয়েছিলেন তিনি। তাই এ বছর বেশি চামড়া কেনেননি। বড়-ছোট মিলিয়ে শ খানেক চামড়া কিনেছেন। কেনা পড়েছে গড়ে ৪৫০ টাকা।
আজ শনিবার বিকেল চারটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদের চৌমুহনী এলাকায় গিয়ে মোহাম্মদ বেলালের সঙ্গে দেখা হয়। চামড়ার পাশে চেয়ার পেতে বসে ছিলেন তিনি। দরদাম কেমন, এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আড়তদারেরা প্রতিটি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় কিনতে চাইছে। এখনো বিক্রি করছি না। তবে পাঁচটার আগেই বিক্রি করব।’
মোহাম্মদ বেলাল পেশায় ফল ব্যবসায়ী। থাকেন নগরের মিস্ত্রিপাড়ায়। গতবার লোকসানের পরও এবার কেন ব্যবসায় ফিরেছেন, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল মোহাম্মদ বেলালের কাছে। তিনি বলেন, অনেক দিন ধরেই চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি। ঈদের দিন সকাল থেকে চামড়া সংগ্রহ করা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এ কারণে এটি ছাড়তে পারছেন না। তবে আশা করেছিলেন রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় এবার দাম পাবেন। কিন্তু আড়তদারেরা দাম কম বলছেন।
ঈদের দিন বেলা ১১টা থেকেই চৌমুহনী এলাকাটি জমজমাট হয়ে ওঠে। মোহাম্মদ বেলালের মতো শতাধিক মৌসুমি বিক্রেতা চামড়া নিয়ে জড়ো হন এ এলাকায়। সড়কের ওপর চামড়া রেখে তাঁরা আড়তদার ও তাঁদের প্রতিনিধির জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। নতুন ও পুরোনো মৌসুমি বিক্রেতারা চামড়া নিয়ে ভিড় করেছেন। এ রকম ১৫ জন বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা বলেছেন, আড়তদারেরা দাম দিচ্ছেন না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরু ও মহিষের কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অর্থাৎ সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতিটি ১ হাজার ১৫০ টাকা।
আরেক মৌসুমি ব্যবসায়ী মনজু মিয়া এবার ২২টি বড় আকারের চামড়া কিনেছেন। তাঁর কেনা ৬০০ টাকা। তবে আড়তের প্রতিনিধিরা ৪০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছেন। দামের বিষয়টি উল্লেখ করে মনজু মিয়া বলেন, টেলিভিশনে দেখেছি দাম এবার ১ হাজার ১০০ টাকার মতো। ভেবেছিলাম অন্তত ৮০০ টাকা পাব। লাভ হবে। কিন্তু পরিস্থিতি ভালো নয়। লোকসান গুনতে হবে। মোহাম্মদ ফাহিম নামের আরেক বিক্রেতা দাবি করেন, তাঁর ৪০০ টাকা কেনা পড়েছে। ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে।
রাইড শেয়ার করে সংসার চলে মোহাম্মদ সুজনের। আজ ঈদের দিন কিছু বাড়তি টাকা আয় করতে তিনি ৫০টি চামড়া কেনেন। কেনা পড়েছে গড়ে ৪৫০ টাকা। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত এই চামড়া বিক্রি হয়নি।
আড়তদারেরা কী বলছেন
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মো.
মুসলিম উদ্দিন বলেন, লবণ ছাড়া চামড়া বেশি দামে কেনার সুযোগ নেই। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এ ছাড়া এবার চামড়ার দাম এখনো পর্যন্ত ভালো পাওয়া যাচ্ছে। ৬০০-৭০০ টাকাও দাম উঠেছে।
আড়তদারেরা বলছেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ লবণযুক্ত চামড়ার দামের সঙ্গে কাঁচা চামড়ার দাম গুলিয়ে ফেলেন। এতে অনেক সময় তাঁরা বেশি দামে চামড়া কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এবারও সেটা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবার সমবায় সমিতির আওতায় ২৫ জন আড়তদার চামড়া সংগ্রহে অংশ নিচ্ছেন। এ ছাড়া আরও ৩০-৩৫ জন আড়তদার আছেন, যাঁরা নিজ উদ্যোগে চামড়া কিনে থাকেন। সমিতির তথ্য অনুযায়ী, আগে এই সংখ্যা ছিল ১১২। ২০১৯ সালের পর ট্যানারিমালিকদের কাছে বকেয়া পাওনা পরিশোধ না হওয়ায় অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দেন। বর্তমানে সক্রিয় আড়তদারের সংখ্যা কমে এসেছে।
সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মৌসুমি বিক্রেতাদের তাঁরা বারবার সতর্ক করেছেন। মূলত সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। বিক্রেতারা সেটি গুলিয়ে ফেলেছেন।
চট্টগ্রামে রিফ লেদার নামের একটিমাত্র ট্যানারি থাকলেও বেশির ভাগ চামড়া ঢাকার ট্যানারিগুলোতেই যায়। ঈদের পর ঢাকার ট্যানারিমালিকেরা এসে চামড়া কিনে নিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন আড়তদারেরা।
এবার চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ চার লাখ গরু ও মহিষের চামড়া সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ ছাড়া ছাগলসহ অন্যান্য পশুর কিছু চামড়াও হয়। তবে সেগুলোর দাম একেবারে নগণ্য। কিছু চামড়া উপজেলা পর্যায়ে লবণ দিয়ে রাখা হয়। বেশির ভাগ চামড়া চলে আসে নগরের আতুরার ডিপোর আড়তে। এ ছাড়া গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশও কিছু চামড়া সংগ্রহ করে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম হ ম মদ ব ল ল আড়তদ র র লবণয ক ত ঈদ র দ ন ব যবস য় স গ রহ
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে পাঙাশের বৃহত্তম আড়ত দ্বীপনগর, পাওয়া যায় দেশি-বিদেশি অনেক মাছ
রাজধানীর গাবতলী–মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে বিজিবি মার্কেটে গড়ে ওঠা দ্বীপনগর মাছের আড়ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বেশ জমজমাট থাকে। এই তিন ঘণ্টায় বিক্রি হয় দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসে এসব নানা জাতের দেশি-বিদেশি মাছ।
এ আড়তে গরিবের মাছখ্যাত পাঙাশ থেকে শুরু করে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়। নদীর পাশাপাশি সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছ পাওয়া যায়। ওমান, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা মাছ সরাসরি এখানে আসে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৬ সালে প্রথমে বিজিবি মার্কেটে মাছ বিক্রি শুরু হয়। তবে ২০০৯ সালে এ বাজারে দ্বীপনগর আড়তের যাত্রা শুরু হলেও বাজার জমে ওঠে ২০১৫ সালের পর থেকে। পরে পাঁচটি হিমাগার ও একটি বরফকল নিয়ে এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ মৎস্য আড়তে পরিণত হয়, যেখানে ছোট–বড় প্রায় ৪০০ পাইকারি দোকান রয়েছে।
আড়তদার ও বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, দ্বীপনগর আড়তে জ্যান্ত মাছের পাইকারদের বিনা মূল্যে পানি সরবরাহ করায় তাঁদের প্রত্যেকের প্রায় ৫০০ টাকা করে সাশ্রয় হয়। তার ওপর যাতায়াতের সুবিধা ভালো, ওজনে কেউ মাছ কম দেয় না, চুরিও হয় না এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশে বেচাকেনা করা যায়। এসব কারণে এটি এরই মধ্যে ঢাকার অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় আড়তে পরিণত হয়েছে। ফলে এখানে দিন দিন পাইকার বাড়ছে এবং মোকামও আশপাশে বিস্তৃত হচ্ছে।
দ্বীপনগর আড়তের ‘অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি’র সভাপতি মো. ইনসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে দৈনিক প্রায় ৪০ হাজার কেজি পাঙাশ বিক্রি হয়, যা কারওয়ান বাজারেও হয় না। সব ধরনের মাছ মিলিয়ে দৈনিক দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়।’
* দ্বীপনগর আড়তে পাঙাশ, রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, কই, শিং, টাকি, মাগুর, পুঁটি, বাইম, চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি ও চাষের মাছ পাওয়া যায়।* নদী ও সাগরের বাইলা, চাপিলা, সুরমা, পোয়া, রিঠা, লইট্টা, টুনা প্রভৃতি মাছও বিক্রি হয়।
* প্রতিবেশী ভারত থেকে শুরু করে ওমান, সুদান, জর্ডান, চীন ও জাপান থেকে আমদানি করা মাছ এখানে বিক্রি হয়।
আড়তদার ও পাইকারদের দাবি, এটি দেশে পাঙাশ মাছের সবচেয়ে বড় আড়ত। এখানে দিনে ৩৫ থেকে ৪০ ট্রাক পাঙাশ মাছ আসে। এসব ট্রাকে ৩০ থেকে ৪০টি করে পাঙাশের ড্রাম থাকে। এর একেকটিতে ৪০ কেজি মাছ থাকে। গড়ে ৩৫টি ট্রাকে ৩৫টি করে ড্রাম এবং প্রতি ড্রামে ৪০ কেজি ধরে হিসাব করলে দেখা যায়, এখানে দৈনিক ৪৯ হাজার কেজি পাঙাশ মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৬৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
বিশেষ করে রাজধানীর মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, শ্যামলী, গাবতলী, সাভার, উত্তরা এবং আবদুল্লাহপুর এলাকার পাইকারেরা দ্বীপনগর আড়তে মাছ কিনতে আসেন। অটুট বন্ধন মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মনির হোসেন বলেন, কম দামে পাওয়া যায় বলে পাইকারেরা এখানে মাছ কিনতে আসেন। তাঁর নিজস্ব বরফকল রয়েছে। ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বরফের পাটা বিক্রি করেন। তাই বাইরে থেকে বরফ আনতে হয় না।
সম্প্রতি সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার আগেই বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা মাছ কিনতে দ্বীপনগর আড়তে চলে আসেন। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত নিলামের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে ওঠে পুরো আড়ত। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা তাজা ও হিমায়িত মাছের পাশাপাশি বিদেশ থেকে আনা মাছের বেচাবিক্রি শেষ হয়ে যায়। ৯টার পরপরই সব ব্যস্ততা শেষে ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়ে যায়।
সাভার নবীনগর থেকে আসা পাইকার ফরিদুল ইসলাম জানান, তিনি এখান থেকে দৈনিক ১৫০–২০০ কেজি সাগরের মাছ নিয়ে এলাকার বাজারে বিক্রি করেন।
আড়তদারেরা জানান, দেশের সিলেট, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নওগাঁ, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, টেকেরহাট, খুলনা, রাজশাহী, মোংলা, সাতক্ষীরাসহ সব অঞ্চল থেকেই মিঠাপানি এবং নদী ও সাগরের মাছ আসে দ্বীপনগর আড়তে। ওমান, সুদান, জর্ডান, জাপান, চীন এবং ভারত থেকেও সামুদ্রিক মাছ আনা হয়।
মেসার্স ঢাকা গাবতলী ফিশ আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দৈনিক ৫ টনের মতো মাছ বিক্রি হয়, যার দাম ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মতো।’ তাঁদের হিমাগারে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ২ মাস পর্যন্ত মাছ ঠিক থাকে। প্রয়োজনে তাপমাত্রা আরও কমানো যায় বলে জানান তিনি। তবে আড়তদারদের হিসাবে এসব হিমাগার থেকে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হয়।
৫৫০ টাকা করে বাইম মাছ কেনার পর আদাবর বাজারের একজন পাইকার প্রথম আলোকে জানান, তিনি এই মাছ বিক্রি করবেন ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকায়। পোয়া মাছ কিনেছেন ৩৩০ টাকা কেজি দরে, বেচবেন ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়। ওই পাইকার আরও জানান, আগে কারওয়ান বাজার থেকে মাছ কিনলেও এখন সুবিধা থাকায় দ্বীপনগরে আসেন। প্রতিদিন পাঙাশ, তেলাপিয়া, রুই মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ থেকে ৭০ কেজি মাছ কেনেন।