গত দুই দশকে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির সূচকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যাবে বাংলাদেশ। এখানে বিনিয়োগও এখন এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এমন নিরাশার কথা শুনিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির সর্বশেষ পূর্বাভাস হচ্ছে, চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। তবে আগামী দুই অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এর মধ্যে ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ ও ২০২৬–২৭ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হবে।

বিশ্বব্যাংকের গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্ট’ বা ‘বিশ্ব অর্থনৈতিক সম্ভাবনা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও কাঁচামাল তথা মূলধনি পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়াকে এদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে বেসরকারি বিনিয়োগে বাধা তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে এর আগে সর্বশেষ ২০১৯–২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৩ শতাংশের নিচে নেমেছিল। সেবার জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছিল ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। তখন প্রবৃদ্ধি কমার মূল কারণ ছিল কোভিড–১৯ মহামারির প্রকোপ। সেই অস্বাভাবিক অর্থবছরটি বাদ দিলে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০০১–০২ অর্থবছর, ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, মূলধনি পণ্যের আমদানি হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশের শিল্পোৎপাদনে ধীরগতি দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি এখনো ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। কয়েক দফা সুদের হার বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার নিচে নেমে আসেনি।

বহুজাতিক সংস্থাটির মতে, বিশ্বজুড়ে নীতিগত অনিশ্চয়তা বাড়লেও বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রবাহ আবারও জোরালো হতে পারে। তবে এ জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ও ব্যবসাবান্ধব সংস্কার কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়নকে অন্যতম শর্ত হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় গড় মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমেছে। বেশির ভাগ দেশে সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যেই রয়েছে। এর ফলে নীতি সুদহার কমানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভারতে গত ২০২৩ সালের শুরু থেকে অপরিবর্তিত থাকা সুদের হারও চলতি ২০২৫ সালের শুরুতে কমানো হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, ভুটান ও নেপালে উন্নয়ন ব্যয় বাড়বে। বাংলাদেশে এই খাতে ব্যয় কমতে পারে। চলতি ব্যয় ও ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়ে ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া হবে।

যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এরই মধ্যে জানিয়েছে, চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছর শেষে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এই অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে হবে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। একই সময়ে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি সামান্য বাড়লেও সেবা খাতে কমবে।

মাথাপিছু আয় বাড়বে দক্ষিণ এশিয়ায়

গতকাল প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ২০২৫ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয়ে গড় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে স্থির থাকতে পারে, যা এই অঞ্চলে দারিদ্র্য আরও কমাতে সহায়তা করবে। এ ছাড়া ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশকে বাদ দিলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে হবে ২ দশমিক ১ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে বেড়ে ৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।

তবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার করোনা–পূর্ব দশকের চেয়ে কম থাকবে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। অর্থাৎ এসব দেশে দারিদ্র্য কমার গতি আগের চেয়ে ধীর হতে পারে। আফগানিস্তানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বিস্তৃত আকারেই থেকে যাবে। সেখানে বৈদেশিক সাহায্য কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের প্রবাহ শক্তিশালী হয়েছে। তবে পর্যটন খাতে বড় ধরনের আয় হওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি কিছুটা কমেছে। তবে ভারতে চলতি বছরের এপ্রিলে পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে। কারণ, সে সময় দেশটিতে জ্বালানি তেল আমদানি দ্রুত বাড়লেও রপ্তানি ততটা বাড়েনি।

পাকিস্তানেও এপ্রিলে পণ্য বাণিজ্যের ঘাটতি বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ ছিল রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়া। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, এপ্রিলের শুরুতে পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক বাড়ানোর পদক্ষেপ। এতে পাকিস্তানের রপ্তানিতে সরাসরি প্রভাব পড়েছে।

নেপাল–ভুটানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে

আগামী অর্থবছরগুলোয় নেপাল ও ভুটানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির হিসাবে, নেপাল আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৫ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। নেপালের হাইড্রো পাওয়ার উৎপাদনে অগ্রগতির ফলে শিল্পোৎপাদন বাড়বে। ফলে ভারতসহ নেপালের প্রতিবেশী দেশগুলোয় বিদ্যুৎ রপ্তানির সুযোগ তৈরি হবে।

অন্যদিকে ভুটানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে উঠতে পারে, যা জানুয়ারির পূর্বাভাসের চেয়ে ১ শতাংশ বেশি। এর পেছনে মূল চালিকাশক্তি হবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করা ও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। এটি দেশটির বিনিয়োগ ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রব দ ধ ব শ বব য ৩ দশম ক র প রব আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

সোনালী ও রূপালী মুনাফায়, অগ্রণী ও জনতা লোকসানে

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গত বছরের শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে দুটিই বড় ধরনের লোকসানে পড়েছে। বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ায় দেশের শীর্ষ লোকসানি ব্যাংকে পরিণত হয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটি গত বছর শেষে একাই লোকসান করেছে ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংক লোকসান করেছে ৯৮২ কোটি টাকা।

তবে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে সোনালী ব্যাংক, গত বছর শেষে ব্যাংকটি মুনাফা করেছে ৯৮৮ কোটি টাকা; আর রূপালী ব্যাংক মুনাফা করেছে ১১ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রমালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ও জনতা মিলে গত বছর শেষে লোকসান করেছে ৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। আর সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক মিলে মুনাফা করেছে ৯৯৯ কোটি টাকা। তবে চার ব্যাংকই মন্দঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নিজেদের চাহিদামতো ছাড় পেয়েছে। এ কারণে কাগজে–কলমে জনতা ও অগ্রণী লোকসান কিছুটা কম দেখাতে পেরেছে; আর সোনালী ও রূপালীর মুনাফা বেড়েছে। কারণ, নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় মুনাফা থেকে। নিয়ম অনুযায়ী, মন্দঋণের বিপরীতে যথাযথ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্র আরও খারাপ হতো। ব্যাংক চারটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। দেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক মোট ছয়টি। উল্লেখিত চারটির বাইরে বাকি দুটি হচ্ছে–বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল।

নানা অনিয়ম–দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন এসব ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়লে বিভিন্ন সময় সরকার জনগণের করের টাকায় মূলধন জোগান দিয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদকালে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি সরকারঘনিষ্ঠ আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে ব্যাংকগুলোতে বন্ধ হয়নি অনিয়ম–দুর্নীতি। এখন লোকসানে থাকা জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক একীভূত করা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে।

মুনাফায় শীর্ষে সোনালী ব্যাংক

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক কয়েক বছর ধরে তাদের মুনাফার ধারা অব্যাহত রেখেছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৩৭১ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয় ৬৫১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে সোনালী ব্যাংকের মুনাফা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৯৮৮ কোটি টাকায়। ২০১২ সালে হল-মার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটি বড় ধরনের সংকটে পড়েছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে সোনালী ব্যাংক।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছিল হল–মার্ক গ্রুপ। এ ঘটনা ছিল সে সময় দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ অনিয়মের সবচেয়ে বড় ঘটনা। তাই দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল হল–মার্ক কেলেঙ্কারি। শেষ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাকে জেলে যেতে হয়েছিল। এই ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর ব্যাংকটি পুনর্গঠন শুরু হয়। তাতে ধীরে ধীরে দেশের সবচেয়ে বড় এই ব্যাংকের প্রতি আবারও আস্থা ফিরতে শুরু করে আমানতকারীদের।

বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। ২০১২ সালে ব্যাংকটির ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের ঋণের ৩৩ শতাংশই সরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া।

হল-মার্কের ঘটনার পর সোনালী ব্যাংক তাদের ঋণের গতি কমিয়ে দেয়। কৌশলও পাল্টে ফেলে। আগ্রাসী ঋণ না দিয়ে ব্যাংকটি সরকারি বিভিন্ন পণ্যে বিনিয়োগ করতে থাকে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার বদলে অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিয়ে সুদ আয়ের পথ বেছে নেয়। আর তাতে ব্যাংকটির আর্থিক ভিত্তি মজবুত হয়। বেড়েছে গ্রাহকও। এক যুগ আগে ব্যাংকটির গ্রাহক ছিল এক কোটির ঘরে। এখন সেই সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়েছে।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শওকত আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণের সুদ ও ট্রেজারি খাত থেকে গত বছর আমাদের ভালো আয় হয়েছে। তবে আয়ের ক্ষেত্রে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ট্রেজারি খাতে। আবার অবলোপন করা ঋণ থেকেও ভালো আদায় হয়েছে, যা মুনাফায় যুক্ত হয়েছে। বেসরকারি ঋণের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এরপর মুনাফা এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।’

রূপালী ব্যাংকের মুনাফা কমেছে

রূপালী ব্যাংক ২০২২ সালে ২৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। ২০২৩ সালে সেই মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ কোটি টাকায়। তবে ২০২৪ সালে তাদের মুনাফা কমে ১১ কোটি টাকায় নেমে আসে। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকায়, যা আগের বছর ছিল ৬৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৪১ শতাংশের বেশি ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে। এর ফলে যে পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কথা, তা সংরক্ষণ করতে হলে ব্যাংকটি লোকসানে পড়ত। তবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যাংকটিকে ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে গত বছরের শেষে ব্যাংকটি ১১ কোটি টাকা মুনাফা দেখানোর সুযোগ পায়।

এ নিয়ে রূপালী ব্যাংকের এমডি কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমে গেছে। এসব ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এখন কম সুদের আমানত এনে ভালো ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।

রেকর্ড লোকসানে জনতা ব্যাংক

রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জনতা ব্যাংকের। ২০২২ সালে ১১৩ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে ৬২ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। আর ২০২৪ সাল শেষে ব্যাংকটি রেকর্ড ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এই লোকসান রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লোকসানের রেকর্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্যাংকটি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় নিয়েছে। যদিও খেলাপিঋণের বিপরীতে ওই পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হতো, তাহলে লোকসানও কয়েক গুণ বেড়ে যেত। ব্যাংকটি এই চরম দুর্দশায় পড়েছে বিদায়ী সরকারের মেয়াদে লাগামহীন ঋণ দেওয়ার কারণে, যেসব ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে।

গত মেয়াদে ব্যবসায়ীদের কয়েকজন ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যাংকটি থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছেন। ফলে ১০টি শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকটির ৫৫ শতাংশ ঋণ আটকা পড়েছে। প্রভাবশালী এসব গ্রাহকের দেওয়া বেশির ভাগ ঋণ ফেরত আসছে না, এতে গত বছরের শেষে ব্যাংকটির ৬৬ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬৭ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ব্যাংকটির পরিস্থিতি এমন নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে যে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। কারণ, এসব ঋণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আদায় হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবার গ্রাহকদের অনেকেই লাপাত্তা, কেউ জেলে আবার কারও কারখানা বন্ধ।

জনতা ব্যাংক একসময় ছিল দেশের ভালো ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যাংকটির অর্থায়নে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তা। রপ্তানি বাণিজ্যতেও শীর্ষ পর্যায়ে ছিল। সেই ব্যাংক এখন নাজুক পরিস্থিতিতে। কারণ, গত ১৫ বছরে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকটিতে। যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ব্যাংকটির কিছু কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সময়ে পর্ষদে থাকা আওয়ামীপন্থী পরিচালকেরা। যদিও এসব অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

২০২৪ সাল শেষে জনতা ব্যাংকের আমানত কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে ঋণ ছিল ৯৮ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, যা গত বছর শেষে বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮০০ কোটি টাকা। তবে চলতি বছর ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে। তবে গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে আবার ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

জনতা ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে খেলাপি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খেলাপি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এরপর শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা। শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেওয়া অ্যাননটেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্টের খেলাপি ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের খেলাপির পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংকও লোকসানে

মুনাফার দিক থেকে অগ্রণী ব্যাংক একসময় ভালো অবস্থানে থাকলেও ২০২৪ সালে ব্যাংকটি বড় ধরনের লোকসান করেছে। ২০২২ সালে ১১০ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে ৬৯ কোটি টাকা মুনাফা করা ব্যাংকটি ২০২৪ সালে ৯৮২ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং ঘাটতি এবং অদক্ষতাই এই লোকসানের অন্যতম কারণ। গত বছরের শেষে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৯৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, ঋণ ছিল ৭৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। গত জুন শেষে ব্যাংকটির আমানত বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। আর এ সময়ে ঋণ বেড়ে হয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের মতো অগ্রণী ব্যাংকও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ দিয়ে এখন সংকটে পড়েছে।

ব্যাংকটির সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৫ বছরে নিয়মের বাইরে যেভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছে, এখন তা বেরিয়ে আসছে। নিরাপত্তা সঞ্চিত সংরক্ষণে ছাড় না নিলে ব্যাংকটির লোকসান আরও অনেক বেশি হতো। যদি প্রকৃত লোকসানের চিত্র সবাই জানত, তাহলেই ভালো হতো। এই ব্যাংকের ঋণের অনেক টাকা বাইরে চলে গেছে। এ জন্য ঘুরে দাঁড়াতে বেশ সময় লাগবে। ব্যাংকটির গ্রাহকদের মধ্যে যাঁরা এখন দেশে আছেন, ব্যবসা চালাচ্ছেন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছেন, তাঁদের আরও সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। তাহলে ব্যাংকটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ
  • সেপ্টেম্বরের ১৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ হাজার কোটি টাকা
  • রাশিয়ার প্রয়াত বিরোধী নেতা নাভালনির শরীরে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল: স্ত্রীর দাবি
  • রূপালী লাইফের আর্থিক হিসাবে ৬৯ কোটি টাকার গরমিল
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তি ইউনিটে ভর্তি: মাইগ্রেশন, বিষয় ও প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ প্রকাশ
  • হেলথ টেকনোলজি কোর্সে ভর্তি, অপেক্ষমাণ থেকে তৃতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ
  • তাপমাত্রা বেড়ে দেশের ক্ষতি ২১ হাজার কোটি টাকা, কীভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে
  • শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ দিল ঢাকা ইন্স্যুরেন্স
  • সোনালী ও রূপালী মুনাফায়, অগ্রণী ও জনতা লোকসানে
  • বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনে ২৬ ব্যাংক থেকে ৩৫ কোটি ডলার কিনল কেন