রোগীরা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যান মূলত চিকিৎসকের ভরসায়। এখন হাসপাতালে যদি সেই চিকিৎসকই না থাকেন, তাহলে সেই হাসপাতালের গুরুত্বই–বা কোথায়? পর্যাপ্ত চিকিৎসক ছাড়া উপজেলা পর্যায়ের অনেক সরকারি হাসপাতাল চলছে। শুধু তা–ই নয়, বছরের পর বছর এই সংকট বিরাজ করছে অনেক জায়গায়। যেমনটি দেখা যাচ্ছে লক্ষ্মীপুর জেলায়। সেখানকার ১৪৬টি চিকিৎসক পদের মধ্যে ৬০টিই শূন্য, যা মোট পদের প্রায় ৪১ শতাংশ। বিষয়টি হতাশাজনক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, লক্ষ্মীপুর ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালে ২৩টি চিকিৎসক পদের মধ্যে ৮টিই খালি। হাসপাতালটিতে নেই নাক, কান ও গলার (ইএনটি) চিকিৎসক। একইভাবে খালি পড়ে রয়েছে সার্জারি, গাইনি, মেডিসিন আর চক্ষুরোগের চিকিৎসকের পদও।
ফলে প্রতিদিন ছয় থেকে সাত শ রোগী আসা সত্ত্বেও তাঁদের প্রয়োজনীয় সেবা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে, এমনকি অনেককে হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এটি কেবল স্বাস্থ্যসেবার মানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং রোগীদের মৌলিক অধিকারকেও লঙ্ঘন করছে। উপজেলা পর্যায়ের রায়পুর, রামগঞ্জ, কমলনগর ও রামগতি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ১৭টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রেরও একই দশা। হায়দারগঞ্জ উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো অনেক স্থানে তো নিয়মিত চিকিৎসকই নেই, যার কারণে দরিদ্র রোগীরা ওষুধের দোকানের কর্মচারীদের পরামর্শ অনুসারে তাঁদের কাছ থেকে ওষুধ কিনে খাচ্ছেন। এটি একটি এলাকার স্বাস্থ্যসেবার জন্য খুবই উদ্বেগজনক।
দীর্ঘ পাঁচ থেকে সাত বছর ধরে এই পদগুলো শূন্য থাকা সত্ত্বেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় নিয়মিত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলেও সমস্যার সমাধান অধরাই থেকে গেছে। সিভিল সার্জন নিজেও স্বীকার করেছেন যে সারা দেশেই চিকিৎসকের সংকট রয়েছে; কিন্তু এই অজুহাতে লক্ষ্মীপুরের জনগণের দুর্ভোগকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, এটি এক–দুই মাস বা দু–এক বছরের সংকট নয়, আরও বেশি সময় ধরে এ পরিস্থিতি চলমান আছে।
সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। লক্ষ্মীপুরসহ যেসব জেলায় দীর্ঘদিন ধরে পর্যাপ্ত চিকিৎসক নেই, সেখানকার শূন্য পদগুলো কীভাবে পূরণ করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকা ও বিভাগীয় শহরগুলো থেকে চিকিৎসকদের জেলা–উপজেলায় পাঠানোর বিষয়ে তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসকদের যেতে উৎসাহিত করতে সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সংকটগুলো নিরসন করাও প্রয়োজন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: লক ষ ম প র ত চ ক ৎসক
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।
জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।
মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।