ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংসের দায় কে নেবে?
Published: 17th, June 2025 GMT
ঈদুল আজহার ছুটির মধ্যে পুরান ঢাকার চারটি স্থাপনা ধ্বংসের অভিযোগ উঠেছে। একটি বা দুটি হলেও একে কাকতালীয় বলা যেত। কিন্তু চারটি স্থাপনায় হাত দেওয়ার বিষয়কে সাধারণ হিসেবে দেখার অবকাশ কোথায়! আরবান স্টাডি গ্রুপ বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে নিয়ে এসেছে, যেখানে মঙ্গলবার সমকালও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে এ খবর। এর মধ্যে অন্যতম নারিন্দা স্যুয়ারেজ পাম্পিং স্টেশন। এ স্টেশন ঢাকার প্রথম আধুনিক স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার অংশ। এই স্থাপনাটি সংরক্ষণে উচ্চ আদালতের রায় আছে। তা উপেক্ষা করেই এটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেও স্যুয়ারেজের এই স্টেশনটি অবশিষ্ট নেই।
পুরান ঢাকার ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডে আছে শতবর্ষী শঙ্খনিধি হাউস। এর একটি অংশ রাধাকৃষ্ণ মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঈদুল আজহার আগে এই স্থাপনাটির ঝুলবারান্দাসহ সামনের অংশ ধসে পড়ে। এর কারণও বের করেছে আরবান স্টাডি গ্রুপ। তাদের বিবেচনায়, এ স্থাপনায় অতিরিক্ত একটি বাথরুম নির্মাণ করা হয়েছে। তা ছাড়া কয়েক দশক ধরে শঙ্খনিধি হাউস জবরদখল ও অবৈধ পরিবর্তনের শিকার। যে কারণে ঐতিহাসিক এ ভবনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। অর্থাৎ ভবনটি পুরোপুরি ধ্বংস না হলেও এর দ্বারপ্রান্তে। উল্লেখ্য, শঙ্খনিধি হাউস বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঐতিহ্যবাহী ৩২টি ভবনের মধ্যে অন্যতম।
পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের আরেকটি ঐতিহাসিক ভবন মঙ্গলালয়। ঈদুল আজহার ছুটিতে এই ভবনটিরও কিছু অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। সমকালের প্রতিবেদনে এসেছে, ভবনটির আলংকারিক অংশগুলো ভাঙা হয় কৌশল হিসেবে, যাতে ঐতিহ্য হিসেবে এর আবেদন না থেকে। ভাঙার বিষয়টি জানতে পেরে আরবান স্টাডি গ্রুপ থানায় সাধারণ ডায়েরি করলে পুলিশ ভাঙা কার্যক্রম স্থগিত করে।
ঈদের ছুটির পর শুক্রবার রাতে নাসিরউদ্দীন স্মৃতি ভবন ভাঙচুর শুরু হয়। পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় অবস্থিত ভবনটি হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণে ২০১৭ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। এটি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মুসলিম জাগরণের অন্যতম ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন এবং তাঁর কন্যা নূরজাহান বেগমের বাসভবন। ভবনটিকে বহুতল করার উদ্দেশ্যে বেআইনি ভাঙচুর শুরু হয়। অথচ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ ভবনগুলোর অন্যতম এই ভবন। ২০১৮ সালে হাইকোর্ট থেকে ঐতিহ্য সংরক্ষণের রায় ঘোষণা হলেও প্রশাসন সেভাবে ব্যবস্থা নেয়নি। যা হোক, নাসিরউদ্দীন স্মৃতি ভবন এত দিন শুটিং হাউস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। আরবান স্টাডি গ্রুপ সাম্প্রতিক ভাঙার ঘটনা শুনে সেখানে যায় এবং থানায় সাধারণ ডায়েরির পর আপাতত ভাঙার কাজ স্থগিত থাকে।
ঐতিহ্যবাহী এসব স্থাপনার অবস্থান প্রায় কাছাকাছি এবং ঈদের ছুটির মধ্যেই সেগুলোতে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এর মধ্যে নারিন্দা স্যুয়ারেজ পাম্পিং স্টেশনটি রক্ষা করা গেল না। কারণ, ঢাকা ওয়াসার মতো শক্তিশালী সংস্থার মাধ্যমে এটি ভাঙা হয়েছে। দেখার বিষয়, ঈদের ছুটির মধ্যে এ কাজ করার একটা যুক্তি হতে পারে, সে সময় মানুষের নজর কম থাকবে। প্রশাসনিক অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় হয়তো নির্বিঘ্নে দখল কিংবা ভাঙচুর সম্ভব হতো। সংবাদমাধ্যমেরও নজর এড়িয়ে সহজে হস্তক্ষেপকারীদের কাজ সম্পন্ন হতো। বিশেষত ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো সংরক্ষণে যেহেতু আদালতের রায় আছে, সে জন্যই নীরবে স্থাপনাগুলো ধ্বংস করতে চেয়েছে।
ঐতিহ্য একটি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের ধারক-বাহক বলেই তা সংরক্ষণের দাবি ওঠে। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা শিকড়ের সন্ধান পাই। এসব স্থাপনা ধ্বংসের মাধ্যমে চিরদিনের মতো ঐতিহ্যের সেই স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে যায়। আমরা জানি, রাজধানী হিসেবে ঢাকার বয়স ৪০০ বছর। ১৬১০ সালে মোগল শাসকের প্রতিনিধি সুবেদার ইসলাম খাঁ ঢাকাকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। ঢাকা মোটামুটি এ উপমহাদেশের প্রাচীন শহরগুলোর অন্যতম। সেই ঢাকা অবশ্য বলতে গেলে আজকের পুরান ঢাকা, যেখানে আলোচ্য স্থাপনাগুলোর অবস্থান।
স্বাভাবিক কারণেই ঐতিহাসিক পুরান ঢাকায় ঐতিহ্যবাহী অনেক স্থাপনা ইতোমধ্যে বেদখল হয়ে গেছে কিংবা বলা যায়, পুরোনো স্থাপনার জায়গায় নতুন নতুন দালানকোঠা গড়ে উঠেছে। এর পরও অল্প যেসব স্থাপনা রয়েছে, এসবের মধ্যে নারিন্দা স্যুয়ারেজ পাম্পিং স্টেশন, শঙ্খনিধি হাউস, ঢাকার ফরাশগঞ্জের মঙ্গলালয় ও নাসিরউদ্দীন স্মৃতি ভবন উল্লেখযোগ্য। অবশ্য পাম্পিং স্টেশন আর অবশিষ্ট নেই। বাকি তিনটি স্থাপনাও এভাবে কতদিন থাকবে, বলা মুশকিল। কারণ ঐতিহ্যবাহী এসব স্থাপনা সংরক্ষণে সরকারকে যেমন তৎপর থাকতে হবে, তেমনি জরুরি নাগরিক দায়িত্ববোধ। আরও জরুরি প্রতিবেশীর সচেতনতা এবং উত্তরাধিকারীদের সদিচ্ছা। একেকটি স্থাপনার সঙ্গে ইতিহাসের একেক অধ্যায় জড়িত। এগুলো এত সহজে হাতছাড়া করা উচিত নয়।
আমরা দেখেছি, ঐতিহ্যমণ্ডিত ভবন জাদুঘর হিসেবে প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রশাসনিকভাবে যেন ঐতিহাসিক এসব স্থাপনা সংরক্ষণে তৎপর হয়। বিশেষ করে পুরান ঢাকার আলোচ্য স্থাপনাগুলো সংরক্ষণে তাদের জোর তৎপরতা কাম্য।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ
সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আরব ন স ট ড ন স রউদ দ ন
এছাড়াও পড়ুন:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিক নিহত
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে আবারও এক শ্রমিক নিহতের ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার রাত আটটার দিকে সাভারের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।
নিহত মো. রাকিব (২৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের জন্য নির্মাণাধীন বহুতল ভবনে কাজ করতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে।
এর আগে চলতি বছরের ১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন লাইব্রেরি ভবনের চারতলা থেকে পড়ে মো. আরিফুল নামের এক শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন। এর তিন মাসের মাথায় আবারও এক শ্রমিকের মৃত্যু হলো।
ভবনটির নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের জন্য নির্মাণাধীন ওই ভবনের ৯ম তলায় আস্তরের কাজ করছিলেন রাকিব। শুক্রবার বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে দিকে ভবনের জানালা দিয়ে তিনি ময়লা-আবর্জনা ফেলতে গিয়ে নিচে পড়ে গুরুতর আহত হন। পরে তাঁকে ভবনের কর্মচারীরা উদ্ধার করে সাভারের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। রাত আটটার দিকে তিনি সেখানে মারা যান।
ভবনটিতে সাইট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, ভবনের ৯ম তলায় আস্তরের কাজ চলছিল। রাকিব ভবনের জানালা দিয়ে ময়লা ফেলতে গিয়ে পড়ে যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত এই বহুতল ভবনটির কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমিন ট্রেডার্স। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের মধ্যে কাজ চলছিল। ভবনটির বাইরের কাজ শেষ তাই ‘সেফটি নেট’ খুলে ফেলা হয়েছে।
মো. আজিজ জানান, রাকিবের মরদেহ তাঁর গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভবনটিতে কর্মরত ফোরম্যানের তত্ত্বাবধানে তাঁর মরদেহ বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। আমরা বারবার তাদেরকে যথাযথ সেফটি (নিরাপত্তা) নিশ্চিত করে তারপর কাজ করতে বলি। কিন্তু অনেক সময় এসব কর্মচারীরা মানে না। এ বিষয়ে প্রকল্প অফিস ও প্রশাসন থেকে বারবার তাদের তাগাদা দেওয়া হয়। এরপরও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেল।’