ঘুরে বেড়াতে সবারই ভালো লাগে। সেই সময়ে সঙ্গে যদি প্রিয় মানুষটি থাকে তাহলে আনন্দটা দ্বিগুণ হয়ে যায়। শুটিংয়ের প্রয়োজনে দেশের বাইরে প্রায়ই যাওয়া হয়। তবে কোনো শুটিংয়ে নয়, এবার ঈদের ছুটিতে দক্ষিণ এশিয়ার সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলাম ঘুরতে। জল-পাহাড়ে কেটেছে দারুণ কিছু সময়। আমার সঙ্গে ছিলেন স্বামী সনি পোদ্দার। নাশতা করে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছি দু’জনে। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়েছে। নিরিবিলি সময় কেটেছে দু’জনের। স্মৃতি রোমন্থন হয়েছে।
সুন্দর জায়গার লোভ সামলাতে পারিনি বলে মুহূর্তগুলো বন্দি করে রাখতে পেশাদার ফটোগ্রাফার দিয়ে নিজেদের ছবিও তুলেছিলাম। হাতে হাত রেখে সনির সঙ্গে এক পা, দু পা, চার পা করে পাশাপাশি কত পথ যে হেঁটেছি, তার ইয়ত্তা নেই। সময় কাটানোর জন্য এত সুন্দর জায়গা দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ফুলেল নকশার ক্যাজুয়াল স্লিভলেস গাউন, গোলাপি টি শার্টসহ আরও কয়েকটি ড্রেস পরেছিলাম। বেশ কয়েকটি ড্রেস পরিবর্তন করে ছবি তুলেছি। সুন্দর কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে ভক্ত শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে শেয়ার করি সবসময়। যেজন্য এবারও ঘোরাঘুরির বেশ কিছু ছবি শেয়ার করেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এর আগে গিয়েছিলাম দ্বীপদেশটির সমুদ্রসৈকতে। এ ছাড়া দেশটির পাহাড়ি এলাকা আর জলপ্রপাতে ঘুরে বেড়ানোর ছবিও পোস্ট করেছিলাম। এবারের ভ্রমণটি অন্যরকম ছিল।
সবুজে ঘেরা শ্রীলঙ্কার কান্ডালামে লেকঘেঁষা এক রিসোর্টের সুইমিং পুলে জলকেলিতে মেতে উঠেছিলাম। এক পাশে পাহাড়, অন্য পাশে নীল জলরাশি। প্রকৃতির এমন অসাধারণ আবহে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেছি। পুলে মাথায় টুপি পরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। কোনো প্রিয় জায়গায় গেলে সেখানকার স্থানীয় ফুড আমার চাই-ই চাই। ইতিহাস-ঐতিহ্য জানার চেষ্টা করি। শ্রীলঙ্কার নানারকম সুস্বাদু খাবার খেয়েছি দু’জনে। আরও কিছু জায়গা ঘোরার বাকি আছে। সবকিছু মিলিয়ে অন্যরকম মুগ্ধতা নিয়ে দেশে ফিরতে পারব বলে আশা করছি। শুধু কী দেশের বাইরে ঘুরতে গেলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই তা কিন্তু নয়।
দেশের মধ্যে যতগুলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান আছে সেখানেও ঘুরতে ভালো লাগে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে অনেকবার যাওয়া হয়েছে। সেখানের সৌন্দর্য আমাকে বেশ টানে। পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত অনেক হোটেল, বাংলাদেশ পর্যটনকেন্দ্র নির্মিত মোটেল ছাড়াও সৈকতের কাছেই রয়েছে বেশ কয়েকটি পাঁচতারকামানের হোটেল।
এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্রসৈকত, যা ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। সাগরের নীল জলরাশি আর ঢেউয়ের গর্জন সঙ্গে হিমেল হাওয়ায় মনোমুগ্ধকর এক পরিবেশ। নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত এটি। সৃষ্টিকর্তা যেন রূপসী বাংলার সব রূপ ঢেলে দিয়েছে বালুর আঁচলে। প্রতিদিনই অসংখ্য পর্যটক আসেন এখানে। সময় পেলেই ঘুরতে যাই। v
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ন দর য
এছাড়াও পড়ুন:
ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন
কমলাপুর রেলস্টেশনের ভাঙাচোরা প্ল্যাটফর্মে বোতল কুড়িয়ে কিংবা হাত পেতে খাবার জুটত হাসান আলী মুসাফিরের। বয়স তখন পাঁচ কিংবা ছয়। রাতে স্টেশনের পাশে ঘুমিয়ে থাকলে মাঝে মাঝেই তাড়িয়ে দিত পুলিশ।
এক রাতে স্টেশনের ইঞ্জিনের ছাদে উঠে পড়ে সে-তার ছোট্ট বন্ধুও সঙ্গে ছিল। বন্ধুকে টানতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায় সে। গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। চিকিৎসার সময় খোঁজ নেওয়া হয় তার পরিবারের, কিন্তু কোনো সন্ধান মেলে না।
একপর্যায়ে দায়িত্ব নেয় অলাভজনক সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এলইইডিও)। তখন থেকেই তাদের আশ্রয়ে বড় হয় হাসান। এখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে। শিখেছে গ্রাফিক ডিজাইনসহ নানা হাতের কাজ। স্বপ্ন-একদিন পুলিশ হয়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াবে।
দুই দশকে ৩০-৩৫ হাজার শিশুর পুনর্বাসন
হাসানের মতো হাজারো শিশুর জীবনের বাঁক ঘুরেছে এলইইডিও-র হাত ধরে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায় আড়াই দশকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত ও পরিবারহারা শিশুকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের চেষ্টা করেছে তারা। কেউ কেউ ফিরে গেছে পরিবারের কাছে, আবার কেউ থেকে গেছে সংগঠনের আশ্রয়ে-গড়ে তুলেছে নিজের ভবিষ্যৎ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) এমন ৩০০ শিশু-কিশোরকে নিয়ে আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী আনন্দভ্রমণের। স্থান ছিল ঢাকার ধামরাইয়ের মোহাম্মদী গার্ডেন। সকাল থেকে চলেছে চকলেট দৌড়, পিলো পাসিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সব মিলিয়ে উৎসবমুখর এক দিন।
পথ থেকে আশ্রয়ে
এলইইডিওর সংগঠকরা জানান, ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাদের লক্ষ্য ছিল পাচার, নিখোঁজ ও ভাসমান শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়ন। কর্মীরা প্রতিনিয়ত ঘুরে বেড়ান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। যেসব শিশুর পরিবারের সন্ধান মেলে না, তাদের উদ্ধার করে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যদি পরিবারের হদিস না মেলে, প্রথমে নেওয়া হয় ‘শেল্টার হোমে’, পরে ‘পিস হোমে’।
ঢাকার কমলাপুর ও কদমতলীতে রয়েছে দুটি শেল্টার হোম, আর ওয়াশপুরে একটি পিস হোম। শেল্টার হোমে প্রায় ২৫ জন ও পিস হোমে প্রায় শতাধিক শিশুর থাকার ব্যবস্থা রযেছে। শেল্টার হোমে থাকা শিশুদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে, ব্যর্থ হলে পাঠানো হয় সরকারি ছোট মনি নিবাসেও। পিস হোমে থাকা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানো হয়, শেখানো হয় বিভিন্ন কারিগরি কাজ।
এছাড়া ঢাকার কদমতলী, সদরঘাট, এয়ারপোর্ট, মিরপুর, কমলাপুর ও তেজগাঁওয়ে ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’ নামে ছয়টি মুক্ত বিদ্যালয় পরিচালনা করছে সংগঠনটি। খোলা আকাশের নিচে বসে পথশিশুরা সেখানে শেখে অক্ষর আর জীবনের নতুন দিশা।
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পথশিশুরা
‘এলইইডিও’র উদ্যোগে এই শিশুরাই অংশ নিয়েছে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেও। ২০২২ সালে কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপে, আর ২০২৩ সালে ভারতে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেমিফাইনাল পর্যন্ত খেলার গৌরবও অর্জন করেছে তারা।
বিশেষ শিশুর গল্প: মালেকা আক্তার
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থেকে ট্রেনে উঠে ঢাকায় চলে এসেছিল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু মালেকা আক্তার। স্মৃতিশক্তি দুর্বল, জন্মগতভাবে এপিলেপসিতে আক্রান্ত। তাকে উদ্ধার করে ‘এলইইডিও’।
এখন সে সংগঠনের পিস হোমে থাকে, স্কুলে যায়। শেখানো হয়েছে সেলাই ও ক্রাফটের কাজ। একসময় হাঁটতেও কষ্ট হতো তার, এখন নিয়মিত চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ। হাসতে হাসতে বলল, “এখানে আমি নিরাপদ, নিজের মতো করে বাঁচতে পারি।”
যে স্কুলে পড়েছেন, এখন সেই স্কুলেই শিক্ষক
মো. নিজাম হোসেনের গল্প যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। রায়েরবাজারের ছেলেটি বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঘরহারা হয়। একসময় ভাসমান জীবনে জড়িয়ে পড়ে। ‘এলইইডিও’র কর্মীরা খুঁজে পেয়ে তাকে ভর্তি করান স্কুলে। এরপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়।
বর্তমানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগে পড়ছেন নিজাম। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামে পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছেন। এখন ‘এলইইডিও’র স্ট্রিট স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।
নিজামের ভাষায়, “আমি যে স্কুলে পড়েছি, আজ সেই স্কুলেরই শিক্ষক। এখানে ভাসমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করাই।”
তার আঁকা ছবি সংগ্রহ করেছেন ফুটবলার হামজা চৌধুরী, ছাপা হয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্যালেন্ডারেও। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
দিনভর হাসি, আনন্দ
বিকেলের দিকে মঞ্চে পুরস্কার বিতরণ। মাইকে নাম ঘোষণা হতেই শিশুদের উল্লাস-পিলো পাসিংয়ে কমলাপুরের বিজয়, চকলেট দৌড়ে হাবিবা, পিস হোম থেকে শামীম। মাঠ জুড়ে হাততালি আর হাসি।
প্রতি বছরই এমন আয়োজন করে ‘এলইইডিও’। অংশ নেয় ‘স্কুল আন্ডার দ্য স্কাই’-এর শিক্ষার্থী, শেল্টার ও পিস হোমের শিশুরা।
এদিন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন, বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান, এবং ফ্রেন্ডস অব স্ট্রিট চিলড্রেনের চেয়ারম্যান মাইক শেরিফ।
ফরহাদ হোসেন বলেন, “আড়াই দশক ধরে আমরা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে আছি। এবার ৩০০ শিশুকে নিয়ে এসেছি। রাষ্ট্র যদি আমাদের সঙ্গে এগিয়ে আসে, এই শিশুরাই ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের সম্পদ হয়ে উঠবে।”
শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে শিশুরা গেয়েছে দেশাত্মবোধক ও জনপ্রিয় গান। অতিথি মাইক শেরিফ গাইলেন ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’ শিশুদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। বিকেলের রোদে সবার যৌথ ছবি তোলার মধ্য দিয়ে শেষ হয় উৎসবের দিনটি- ভাসমান শিশুরা ফিরল মুখভরা হাসি নিয়ে, নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
ঢাকা/এস