সেরা প্রধান শিক্ষিকা: শিক্ষক হয়ে ওঠার কারিগর বাবা
Published: 25th, June 2025 GMT
সরকারি ভালো চাকরি পেলেও বাবা করতে দেননি। শিক্ষক হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা তাঁর থেকে পেয়েছি। শিক্ষাজীবনে এমন কয়েকজন শিক্ষক পেয়েছি, যারা আমাকে শিখিয়েছেন– সফলতা পেতে হলে সব সময় সৎ, কর্মঠ ও প্রগতিশীল মানুষ হতে হবে। এসব ভালো মানুষের আশীর্বাদ দেশসেরা হতে সহায়তা করেছে।
কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর সৈয়দপুরের সাবর্ডিনেট কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শিউলি সুলতানা। তিনি সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ক্যাটেগরিতে প্রথম হয়েছেন।
সরেজমিন দেখা যায়, একই স্কুলড্রেসে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে যাচ্ছে। শিক্ষকরাও পরেছেন অ্যাপ্রোন। পরিপাটি শ্রেণিকক্ষ। পড়ার উপকরণের অভাব নেই। বিদ্যালয় মাঠের কোনায় ফুলের বাগান। সুন্দর খেলার মাঠ। প্রধান শিক্ষকের কক্ষের শোভা বাড়িয়েছে সিটিজেন চার্টার ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার।
শিউলি বাংলাদেশ ডাকবিভাগে উচ্চ পদে চাকরি পান। তাঁর বাবা অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মকর্তা আব্বাস আলী চেয়েছেন, তাঁর মেয়ে শিক্ষক হোক। এজন্য যোগদান করতে দেননি। ২০০৭ সালে বাবার ইচ্ছাপূরণ হয়। শিউলি জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ দুরাকুঠি বাহাগিলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। পরে ২০০৯ সালে বদলি হয়ে আসেন সাবর্ডিনেট কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
গত ১০ মে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে শিউলিকে জাতীয় শিক্ষাপদক দেওয়া হয়। তবে গর্বের পদকটি বাবার হাতে তুলে দিতে পারেননি তিনি।
পদকটি নিয়ে ট্রেনে করে রাজধানী থেকে গ্রামের বাড়ি নওগাঁর আত্রাইয়ের শাহাগোলায় ফিরছিলেন শিউলি। জয়দেবপুর রেলস্টেশনে পৌঁছে তাঁর ৮৫ বছর বয়সী বাবার মৃত্যুর সংবাদ পান। বাবার দাফনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সম্প্রতি শিউলি ফিরেছেন প্রিয় কর্মস্থলে।
সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরা সংবর্ধনার প্রস্তুতি নিলেও শিউলির অনুরোধে তা বাতিল করা হয়। তবে আগেই তারা বাবার মৃত্যুতে সমবেদনার পাশাপাশি দেশসেরা হওয়ায় ফোন করে ও এসএমএস পাঠিয়েছেন।
শিক্ষকতাকে শিউলি চাকরি নয়, ব্রত মনে করেন। শিক্ষক তাঁর ছাত্রের কাছের বন্ধু, তাঁর জীবনের দর্শন এমনকি পরিচালকও। ফলে শিক্ষককে চিন্তাচেতনা ও নৈতিকতায় সেভাবে গড়ে উঠতে হয়। শিউলি মনে করেন, বর্তমানে শিক্ষকরা এ দর্শন থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন। আবার শাসনের পরিমাণও অনেক কমে গেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক স্খলনের প্রবণতা বেশি। পরিস্থিতির উত্তরণ এবং সুন্দর সমাজ গঠনে অভিভাবকসহ সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশসেরা সাফল্যের বিষয়ে শিউলি সুলতানা জানান, পেশাদারিত্বে তিনি কোনো আপস করেন না। ফজর নামাজের পর থেকে শুরু করেন দিনের কর্মসূচি। শিক্ষার্থীদের আজ নতুন কী শিখাবেন, সে চিন্তা থেকে অন্তত একটি ভিডিও কনটেন্ট বানান। তাঁর মৌলিক পাঁচ শতাধিক শ্রেণি পাঠদানের কনটেন্ট রয়েছে।
স্কুলে এসে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম তদারকির পর দাপ্তরিক কাজ করেন। ক্লাস শুরুর আগে সহকর্মী শিক্ষকদের নিয়ে সারাদিনের পাঠদানের পরিকল্পনা ঠিক করেন। সহকারী শিক্ষকরা ক্লাস নিচ্ছেন কিনা, তা তদারকি করেন। দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা পাঠদানের ব্যবস্থা করেন। এমনকি বাড়িতে গিয়ে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন শিক্ষার্থীর। অভিভাবক সমাবেশ, উঠান বৈঠক ও সমাজের দক্ষ মানুষের পরামর্শ নিয়ে স্কুলের কার্যক্রম পরিচালনা করে সফলতা পেয়েছেন বলে জানান শিউলি।
সৈয়দপুরের সাবর্ডিনেট কলোনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৪০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। অবকাঠামো সংকটের কারণে গত তিন বছর তৃতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
সৈয়দপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল আলম জানান, শিউলি সুলতানা মেধাবী ও সৃজনশীল প্রধান শিক্ষিকা। দেশসেরা হতে যেসব সূচক প্রয়োজন, সবই অর্জন করেছেন তিনি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে উদ্যোক্তা সাজ্জাদের সফলতা
সাজ্জাদ হোসেন, জন্ম নেন গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রামে। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েও তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা।
তার গল্প শুধু একজন উদ্যোক্তার নয়, বরং একটি অনুপ্রেরণার গল্প। যেখানে প্রতিটি প্রতিবন্ধকতা জয় করার শক্তি ও সংকল্পের প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যয়ন করছেন, পাশাপাশি পরিচালনা করে যাচ্ছেন নিজের ব্যবসাও। তবে তার এই সফলতার পিছনে রয়েছে অনেক সংগ্রাম, পরিশ্রম এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি।
সাজ্জাদ হোসেনের শৈশবকাল ছিল অনেক কষ্টের। ছোট থেকেই তার শারীরিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। পরিবার ছিল সাধারণ, তবে তাদের মধ্যে ছিল দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং সাহসিকতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ। তার মা-বাবা তাকে সবসময় সাহস জুগিয়েছেন এবং তার প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন।
আরো পড়ুন:
জুলাই আয়োজনে উপেক্ষিত প্রথম পুলিশি হামলার শিকার কুবি
কোটা প্রথা বহালের প্রতিবাদের ইবিতে মানববন্ধন
গাইবান্ধার সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন সাজ্জাদ। একটা পর্যায়ে গিয়ে তার শারীরিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। সাইকেল চালিয়ে কলেজে যাওয়ার সময় যে স্বাভাবিকতা শুরু হয়, তা আর ভালো হয়নি। তবে, এসব প্রতিকূলতার মাঝেও তার পড়াশোনার আগ্রহ ও ইচ্ছা কখনো ভাটা পড়েনি।
সাজ্জাদ দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সোনাতলা টেকনিক্যাল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। স্নাতক তৃতীয় বর্ষে এসে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তবে প্রতিটি উপেক্ষা করে সাজ্জাদ চালিয়ে যান তার পড়াশোনা; তার কাছে শিক্ষাই ছিল মূল লক্ষ্য। পরিবার থেকে পড়াশোনার জন্য অনেক সহায়তা পেলেও, এক সময় তা কমতে শুরু করেছিল।
তার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আসে, যখন তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হলেও, দ্বিতীয় বছর শেষে তার অর্থনৈতিক সমস্যা শুরু হয়। বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর সামর্থ্য কমে যাওয়ার ফলে তার পড়াশোনার খরচ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজেই কিছু একটা করার। কিন্তু টিউশন কিংবা কোচিংয়ের মাধ্যমে তার আয়ের সুযোগ ছিল না। এজন্য তিনি অনলাইনে বই বিক্রির করার সিদ্ধান্ত নেন।
ব্যবসার শুরুটা ছিল খুবই সাধারণ। তার কাছে তেমন পুঁজি ছিল, তবে আত্মবিশ্বাস ছিল অটুট। ফেসবুক পেজ খুলে শুরু করেন বই বিক্রি। প্রথম দিকে তার ব্যবসা খুবই সীমিত থাকলেও ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
বই সংগ্রহ এবং বিক্রি করার প্রক্রিয়াটি সাজ্জাদের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। প্রথমে পুরোনো বই সংগ্রহ করে বিক্রি করা শুরু করেন। পরে তিনি নতুন বইও সংগ্রহ করতে শুরু করেন।
সাজ্জাদের একটাই লক্ষ্য ছিল—বিক্রির মাধ্যমে তার ব্যবসাকে আরো বড় করা। এক সময় তার মাসিক আয় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে পৌঁছাতে থাকে। প্রথম দিকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। বই সংগ্রহ, গ্রাহকদের সেবা, কুরিয়ার ব্যবস্থা—সবকিছু একাই সামলাতে হয়েছে। তবে এর প্রতিটি কাজ তাকে আরো পরিশ্রমী এবং দায়িত্বশীল করেছে।
ব্যবসা এখন তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বইয়ের ব্যবসার মাধ্যমে তিনি শুধু নিজের পড়াশোনার খরচই বহন করেন না, বরং নিজের স্বপ্নও পূর্ণ করতে চলেছেন। তার বিশ্বাস ছিল, শুধু পড়াশোনায় সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনে অন্যকিছু করতে হবে। আজ তিনি সেই পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেছেন। তার স্বপ্ন ছিল বড় উদ্যোক্তা হওয়ার, বর্তমানে তিনি তার সেই স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
তবে তার এই সফলতার পথ মোটেই সহজ ছিল না। সাজ্জাদ জানান, প্রতিটি পদক্ষেপে অনেক বাধা এসেছে, কিন্তু তিনি কখনো হাল ছাড়েননি। তার অটুট মনোবল, পরিশ্রম এবং সততার ফলস্বরূপ, আজ তিনি সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তার বিশ্বাস, যত বেশি পরিশ্রম, তত বেশি সফলতা আসে।
সাজ্জাদ হোসেনের স্বপ্ন শুধু উদ্যোক্তা হওয়া ছিল না, তিনি আরো বড় কিছু করতে চান। তিনি বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং নিজের কাজের মাধ্যমে দেশকে কিছু ভালোর দিকে নিয়ে যেতে চান।
সাজ্জাদ শুধু একজন উদ্যোক্তা নন, তিনি এক অনুপ্রেরণার উৎস। তার জীবন আমাদের শিখিয়েছে যে, প্রতিবন্ধকতা আসবে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য পূরণের জন্য সেটা কখনো বাধা হতে পারে না। তার সংগ্রাম, পরিশ্রম এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি তাকে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে সহায়তা করেছে। তিনি সবাইকে শিখিয়েছেন- “যত বেশি পরিশ্রম, তত বেশি সফলতা।”
ঢাকা/মেহেদী