দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিবর্ণ চিত্র লইয়া বরাবরই আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া আসিতেছি। দুঃখজনক হইলেও সত্য, উহা যেন অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত; পরিস্থিতির প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয় না বলিলেই চলে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যানে প্রতিভাত– চলতি বৎসরের জানুয়ারি হইতে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সমগ্র দেশে বিভিন্নভাবে দেড় সহস্রাধিক নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হইয়াছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্ষণের শিকার। সংবাদমাধ্যমের খবর বিশ্লেষণ করিয়া সংস্থাটি এই তথ্য প্রকাশ করিয়াছে, যাহার অর্থ প্রকৃত নির্যাতনের চিত্র নিশ্চয় আরও অধিক হইবে। এহেন নারী নির্যাতনকে আর চলিতে দেওয়া যায় না। ইহাকে শূন্যে অবনমনই প্রত্যাশিত।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যাহা মহিলা পরিষদের বিবৃতিতে উঠিয়া আসিয়াছে; নারী ও কন্যা নিপীড়নের এই পরিস্থিতিতেও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কেহ প্রতিক্রিয়া দেন নাই। নির্যাতনের বাড়বাড়ন্ত পরিস্থিতিতেও কীভাবে তাহারা নীরব রহিয়াছেন? আমরা দেখিয়াছি, মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ মামলায় অত্যন্ত দ্রুততায় বিচার হইয়াছে বটে, কিন্তু যথাযথ তদন্ত না হইবার কারণে পরিবার সন্তুষ্ট হইতে পারে নাই। আমরা ইহাও দেখিয়াছি, দেশে ধারাবাহিক ধর্ষণের ঘটনায় মার্চ মাসে দেশব্যাপী যখন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চলিতেছিল তখন অন্তর্বর্তী সরকার ধর্ষণ মামলার বিচারকার্য দ্রুত নিষ্পন্নকরণে বিদ্যমান আইনে পরিবর্তন আনয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিচারকার্য বিলম্বিত না করা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা মনে করি, এই প্রকার বিচারে দ্রুততার সহিত নির্ভুলতাও জরুরি। এমনকি আলোচ্য পরিসংখ্যানে উঠিয়া আসিয়াছে, উত্ত্যক্তের শিকার দুইজন আত্মহত্যা করিয়াছেন। অগ্নিদগ্ধ ও এসিডদগ্ধের বীভৎসতা এখনও বিদ্যমান। এমনকি যৌতুকের কারণে এখনও নারীগণ নির্যাতিত হইতেছেন। পারিবারিক সহিংসতায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হইতেছেন নারীরা এবং বহুল বিস্তৃত আন্তর্জালে সাইবার অপরাধ হইতেও নারীর যেন নিষ্কৃতি নাই। নিপীড়নের এই সকল ধরনই বলিয়া দিতেছে, সমাজে এখনও কতটা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা প্রকট। কীভাবে নারী প্রায় সর্বত্রই অনিরাপদ।
আমরা জানি, দেশের নারীগণ সমাজের বহু যুগের বন্ধ অর্গল ভাঙিয়া অগ্রগামী। নারী নির্যাতন তাহাদের এই অগ্রগামিতাকে ভয়ানকভাবে রুদ্ধ করিতেছে। আমরা চাই, নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধ করিয়া উহাদের অগ্রসর হইবার পথ উন্মুক্ত করা হইবে। স্মরণে রাখিতে হইবে, দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী এবং তাহাদের পশ্চাতে রাখিলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হইতে বাধ্য। নারী যাহাতে পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তিরূপে ভূমিকা রাখিতে পারে, তজ্জন্য তাহাদের দমন-নিপীড়নমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করিতে হইবে।
বলা বাহুল্য, নারী নির্যাতন বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা জরুরি। প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ে যাহারা দায়িত্ব পালন করেন তাহাদের নারীর প্রতি সংবেদনশীল হওয়া আবশ্যক। ধর্ষণসহ সকল নির্যাতনের ঘটনায় বিদ্যমান কঠোর আইন তাহাদের সদিচ্ছাতেই বাস্তবায়ন সম্ভব। সমাজের জাগরণও এই ক্ষেত্রে জরুরি।
ইহা নিপীড়কদের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিয়া থাকে। স্বীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিপীড়নের শিকার হইলে সঙ্গে সঙ্গে যাহাতে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারে, তজ্জন্য সচেতনতাও জরুরি। সেই ক্ষেত্রে নারীর শিক্ষা নিশ্চিত করিতেই হইবে। সম্প্রতি বাল্যবিবাহের কারণে বিদ্যালয় হইতে নারী শিক্ষার্থীর ঝরিয়া পড়িবার যেই চিত্র দেখা গিয়াছে, উহা গ্রহণযোগ্য নহে। এই বিষয়েও কর্তৃপক্ষের নজরদারি জরুরি।
সাইবার অপরাধ নারী নির্যাতনের নূতন যেই ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত, সেইখানেও সামাজিক মাধ্যমসহ আন্তর্জাল ব্যবস্থাপনায় তাহাদের সতর্ক হইতে হইবে। সর্বোপরি আমরা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহি নিশ্চিত করিলে নারী নির্যাতন বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করিতে পারে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কারের আলোচনা থাকলেও বাস্তব প্রতিফলন নেই: জোনায়েদ সাকি
অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়ার বাস্তব অগ্রগতি নেই বলে মন্তব্য করে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেছেন, সংস্কারের আলোচনা ও প্রক্রিয়া চলমান থাকলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলনই দেখা যাচ্ছে না। এখনও ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট অব্যাহত রয়েছে। এখনও বৈষম্য ও শোষণ-বঞ্চনা চলছেই।
বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ মেরিনার্স কমিউনিটি আয়োজিত মানববন্ধনে জোনায়েদ সাকি এসব কথা বলেন। ভিসা সমস্যার সমাধান, বেকার ক্যাডেট এবং রেটিংসদের চাকরি নিশ্চিতকরণ এবং ডিপ্লোমাধারীদের সিডিসি প্রদানের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাতিলের ৫ দফা দাবিতে মেরিনারদের এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
জোনায়েদ সাকি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ও তার উপদেষ্টাদের কাছে জানতে চাই- এখনও ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের আস্তানা ধ্বংস করতে না পারলে ক্ষমতায় আছেন কেন? এসব অব্যাহত থাকলে তা হবে জুলাই আন্দোলনের শহীদদের রক্ত ও তাদের আকাঙ্খার প্রতি অবমাননা। মেরিনারদের পাঁচদফা দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে অনতিবিলম্বে এসব দাবি পূরণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মানববন্ধনে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, মেরিন ইঞ্জিনিয়াররা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করে দেশের জন্য রেমিটেন্সের পাশাপাশি সম্মানও বয়ে আনেন। দেশের মানুষের কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে মেরিনারদের দাবি পূরণ করতে পারে।
বাংলাদেশ মেরিনার্স কমিউনিটির মুখ্য সংগঠক ক্যাপ্টেন রেদওয়ান সিকদারের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন গণফোরামের কার্যকরী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের সংগঠক দ্যুতি অরণ্য চৌধুরী প্রীতি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক মোহাম্মদ উল্লাহ মধু, মেরিন ক্যাপ্টেন আতিক ইউ এ খান, মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ রানা, ইঞ্জিনিয়ার গোলাম জিলানী, ইঞ্জিনিয়ার রইচ উদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন সাজ্জাদ, চিফ অফিসার কায়কোবাদ, ইঞ্জিনিয়ার বজলুল রহমান প্রমুখ।
মেরিনারদের পাঁচদফা দাবি তুলে ধরে বক্তারা বলেন, বেকার মেরিন ক্যাডেট এবং রেটিংসদের চাকরি নিশ্চিত করতে দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে ক্যাডেট ও ফ্রেস রেটিং দ্বিগুণ করা হোক। ডিপ্লোমাধারীদের সিডিসি প্রদানের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। ভিসা সমস্যার সমাধান ও বিদেশি চাকরির বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াতে হবে। নাবিক প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সবধরনের অবৈধ লেনদেন বন্ধ করতে হবে। ভেনিজুয়েলাতে বন্দি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানকে অতিদ্রুত মুক্ত করে আনতে হবে।