এই জুলাইয়ের ৩ তারিখে ফ্রানৎস কাফকার বয়স ১৪২ হলো। সব সময় মৃত্যুচিন্তায় তাড়িত মানুষটার জন্য এটা কম কথা নয়। তাঁর অধিকাংশ লেখাই শেষের আগে শেষ করা কিংবা অসমাপ্ত। সেই লেখক ১৪২ বছর বেঁচে গেলেন? শুধু তা-ই না, এ মুহূর্তে পৃথিবীজুড়ে স্বীকৃত ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী’ কথাসাহিত্যিক এই তিনিই? ভাবছি যে কাফকার সম্মানে এবারের ৩ তারিখে একটা বার্থডে পার্টি করলে কেমন হতো? নিজের জন্মদিন উদ্যাপন দেখে তিনি নিশ্চয়ই পরপার থেকে মুখ বাঁকিয়ে কষ্ট করে একটু হাসতেন আর আমার কানে কানে বলতেন, ‘মাসরুর আরেফিন, বৃথাই আমার অনুবাদক তুমি! আমার জন্মদিন তো এভাবে করলে চলবে না।
সেটা হতে হবে আলো-আঁধারি কোনো ঘরে, সেখানে আসা অতিথিরা ঠিক জানবেন না তাঁরা দাওয়াত পেয়েছিলেন কি না, সেই ঘরের কোনায় হাতে একটা বড় সিল ও লম্বা লম্বা কিছু ফর্ম নিয়ে বসে থাকবেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, লোকগুলোকে মাপতে থাকবেন তিনি, আর তুমি ওই ফর্মগুলোর দিকে উঁকি দিয়ে দেখবে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।’ এই দৃশ্যটা নিঃসন্দেহে ‘কাফকায়েস্ক’। কিন্তু আমরা শব্দটা এত বেশি ব্যবহার করে ফেলেছি যে এর পেছনের আসল মানুষটাকে ভুল বুঝে বসেছি।
আজ আমরা যখন কোনো কিছুকে ‘কাফকায়েস্ক’ বলি, টিপিক্যালি আমরা বোঝাতে চাই মুখাবয়বহীন আমলাতন্ত্রের সঙ্গে আমাদের দুঃস্বপ্নময় বোঝাপড়াকে, এক অযৌক্তিক ব্যবস্থাকে, আমাদের অস্তিত্বসংকটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া বিপদগুলোকে, যাদের থেকে পালানোর জো নেই। ধরেন, কত এমন হয় যে, এয়ারপোর্টের ভিসা কাউন্টার আপনার পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলল; আপনি যেখানেই ই–মেইল করছেন, সেখান থেকে একই অটোরিপ্লাই আসছে; কলসেন্টারগুলো আপনি বাঁচুন কি মরুন, বিকার নেই, বলেই যাচ্ছে তিন চাপুন-ছয় চাপুন-আগের মেসেজ শুনতে শূন্য চাপুন; চাকরির ইন্টারভিউ নেওয়া লোকগুলো সব একসঙ্গে মিলে আপনার ওপর সেই দোষ চাপাচ্ছেন, যে দোষ আপনি আদৌ করেছেন কি না, তা আপনার মনে নেই। এগুলোই শর্টহ্যান্ডে লেখা কাফকার উত্তরাধিকার, আমাদের ঘাড়ে বসা ‘কাফকায়েস্ক’ বিষয়–আশয়। কাফকাকে এই প্রিজম দিয়ে দেখার কারণ অবশ্যই আছে। তাঁর প্রধান সৃষ্টিগুলো আসলেই উদ্বেগ, দেরিতে পৌঁছানোর বাতিক, চিনতে ভুল করার অভ্যাস, প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতা এবং অস্বচ্ছ-অস্পষ্ট কর্তৃত্ববাদের স্বাক্ষরে ভরা।
তবে এই গুরুগম্ভীর কাফকার নিচে সময়ের সঙ্গে কীভাবে যেন চাপা পড়ে গেছে আরও আজব, আরও মাথা ঘোরানো সত্যটুকু: ফ্রানৎস কাফকা যথেষ্ট ফানি ছিলেন। অর্থাৎ তাঁর লেখার অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য হলো চাপা কৌতুক, নির্বিকার হাস্যরস, ভাবলেশহীন হাস্যপরিহাস। যে অন্ধকারের অবয়ব দিয়ে তিনি তাঁর লেখা সাজিয়েছেন, তার ভেতর একটা হাসি সব সময়েই আছে—শুষ্ক ও লুকোচুরি-খেলা হাসি, যেমন কিনা নিস্তব্ধ লাইব্রেরি রুমে হঠাৎ কাশির আওয়াজ।
কাফকার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ট্র্যাজেডি শুধু এটা নয় যে তারা রাষ্ট্র ও সমাজের ফাঁদে আটকা। তা এটাও যে, তাঁরা বেদনাতুর ও হাস্যকরভাবে সেখানে আটকা, আবার তাদের পরিস্থিতির অ্যাবসারডিটি নিয়ে সচেতনও। এই যে আত্মসচেতন কমেডি, তাঁর হতাশ ও নিরাশাভাব লম্বা-টানা গদ্যের এই যে খ্যাপামি, সেটাই কাফকাকে বানিয়েছে একই সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক নরকের লিপিকার, আবার মূলত অফিশিয়াল-চেহারার এই পৃথিবীর ‘চিফ কমিক অফিসার’। অফিশিয়াল ভাষায় বললে—সিসিও।
সমাজ ও সাহিত্যে কাফকার প্রভাবের ওজন বুঝতে হলে আপনাকে শুরু করতে হবে তাঁর সাহিত্যকর্মের বুনন দিয়ে। তিনি ছিলেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মহাশিল্পী, বলা যাক সেটার পোয়েট লরিয়েট। কিন্তু কোন সময়ে? সেটা তিনি ছিলেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার এই পৃথিবীতে কোনো ক্লিনিক্যাল ক্যাটাগরি হয়ে ওঠার আগেই। এখন চারদিকে কত স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট ভিডিও, কত টিপস ও বইপুস্তক। যাক!
একটা জীবন কাফকার সঙ্গে কাটিয়ে এটুকু বুঝেছি, তাঁর নায়কেরা হাস্যকর সব পরিস্থিতিতে পড়া হাস্যকর রকম ভৌতিক লোকজন—জোসেফ কে, গেয়র্গ বেনডেমান, কে, গ্রেগর সামসা—সবাই। তাঁরা প্রটোকল, অব্যাখ্যেয় শাস্তি ও মানুষের জানার ঊর্ধ্বে ঘটা কর্তৃপক্ষের দেওয়া রায়ের গোলকধাঁধায় ঘুরছে। তাঁরা অ্যাকটিভ কোনো মানুষ না, সব প্যাসিভ বা অক্রিয় মানুষ, কিন্তু আবার প্রবল রকমের আত্মসচেতন।
এবার এই চেনা কাফকার উপরিতলটার নিচে একটু চোখ রাখুন। ‘বিচার’ উপন্যাসে জোসেফ কে গ্রেপ্তার হলো। সে জানে না যে কেন তার এই গ্রেপ্তার, কিন্তু ঘটনাটা তাকে হতাশও করে না, বিদ্রোহীও বানায় না। সে নিজেই তার ইন্টারোগেশনগুলোর দিন-তারিখ ঠিক করে, আদালতের কর্মচারীদের সঙ্গে রোবোটিক ঝগড়া চালায়, একপর্যায়ে এমনকি যে ক্যাথেড্রালে তার চূড়ান্ত ভাগ্য ঠিক করা হবে, সেখানে সে হাজির হয় তার বান্ধবীকে নিয়ে। হাসি আপনার আসতেই হবে। বুঝতে হবে, কাফকা একটা খেলা খেলছেন আপনার সঙ্গে। আর তা বুঝলেই আপনি পড়তে পড়তে মুচকি হাসবেন।
তাঁর বিখ্যাত ‘রূপান্তর’ গল্প, যেখানে গ্রেগর সামসা ঘুম থেকে উঠে দেখে সে বিছানায় এক দৈত্যাকৃতি পোকা হয়ে পড়ে আছে। সেই গল্পের শুরুটা বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের বাসায় একগাদা লোকের সামনে পড়তে গিয়ে কাফকা হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন, এতটাই যে লেখাটা তিনি ঠিকমতো পড়তেও পারছিলেন না। ম্যাক্স ব্রড এই কথা তাঁর কাফকা-জীবনীতে লিখে গেছেন।আবার তাঁর ‘ডার্ক’ উপন্যাস ‘বিচার’-এর শুরুটা তিনি যখন পড়ছেন প্রাগের এক রেস্তোরাঁয়: ‘কেউ না কেউ জোসেফ কের নামে নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেছে। সে জানত সে কোনোই অন্যায় করেনি, কিন্তু এক সকালে সে গ্রেপ্তার হয়ে গেল’—এটুকু পড়া শেষ করেই কাফকা অতগুলো মানুষের সামনে এমনভাবে হাসতে লাগলেন যে পড়াই বন্ধ করতে হলো। ব্রড লিখছেন, ‘এই উপন্যাস, এর শুরুটা তো বটেই, কাফকার কাছে অসম্ভব হাস্যপরিহাসে ভরা ফানি কিছু বলে মনে হচ্ছিল’ এবং ‘টেবিলে আমরাও হাসতে লাগলাম। আমাদেরটা নার্ভাস এক হাসি, কারণ আমরা পরিহাসের নিচে গভীর ভয়ংকর কিছু টের পাচ্ছিলাম।’
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপন য স আম দ র আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
গণতন্ত্রের পথে সংকট দেখছেন তারেক
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জনমনে সংশয় গণতন্ত্রের পথে সংকট তৈরি করতে পারে। নির্বাচনে অপপ্রচার ও অপকৌশল দৃশ্যমান হচ্ছে। দল ক্ষতিগ্রস্ত হলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে ছাড় দিতে বিএনপি প্রস্তুত। ৩০০ আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রবাসে বিএনপির সদস্যপদ নবায়ন কার্যক্রমের অনলাইন পেমেন্ট গেটওয়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।