মুরাদনগরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে সামাজিক অস্থিরতা
Published: 6th, July 2025 GMT
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হওয়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বাড়িও এই উপজেলায়। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এই দু’জনের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে।
এরই মধ্যে বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) স্থানীয় নেতাকর্মীর পাল্টাপাল্টি মিছিল-বক্তব্য, মামলা, সংবাদ সম্মেলন ঘিরে মুরাদনগরে উত্তাপ বাড়ছে। এই বিরোধ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন পড়েছে বেকায়দায়। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, দুই থানার পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন উপদেষ্টার কথার বাইরে কোনো কাজ করে না। তাই এলাকার মানুষ ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছে। এলাকায় অপরাধ বাড়ছে।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, গত ১১ মাসে এ উপজেলায় ১০টি খুন এবং ৩০টি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ দুইজনের অনুসারীদের বিরোধ প্রভাব ফেলছে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, কিছু দিন পরপর পাল্টাপাল্টি ঘটনা, দোষারোপ রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতাকে উস্কে দিচ্ছে। নৃশংস ঘটনাও বাড়ছে।
সম্প্রতি মুরাদনগরে একজন নারীকে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ ও তাঁর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সপ্তাহ না পেরোতেই অপবাদ দিয়ে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয় দুই সন্তানসহ এক মাকে। ফলে প্রশ্ন জেগেছে, একটি এলাকায় কেন বারবার এমন ঘটনা ঘটছে।
পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
২২টি ইউনিয়ন নিয়ে কুমিল্লার বৃহৎ উপজেলা মুরাদনগর। এর মধ্যে মুরাদনগর থানায় ১২টি ইউনিয়ন এবং বাঙ্গরা বাজার থানায় ১০টি ইউনিয়ন। এ আসনে আওয়ামী লীগ ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন এবং জাহাঙ্গীর আলম সরকার গত ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান। সব মামলায় খালাস পেয়ে ১৩ বছর পর গত ২৮ ডিসেম্বর সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন কায়কোবাদ। তিনি এখন সক্রিয়।
অন্যদিকে, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এনসিপির কোনো পদে নেই। তবে দলটির স্থানীয় নেতারা জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এলাকার বিভিন্ন স্থাপনায় সরকারি অনুদান ও উন্নয়নকাজ করে যাচ্ছেন এ উপদেষ্টা। আগামীতে সংসদ নির্বাচনে আসিফের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা আছে।
থানা পুলিশ জানায়, বিভিন্ন ইস্যুতে উভয় দলের নেতাকর্মীরা প্রায়ই উপজেলা সদরে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ মিছিল করে। নানা ইস্যুতে উত্তেজনা ছড়ায়।
ধর্ষণের ঘটনায় পরস্পরকে দোষারোপ
গত ২৬ জুন এক নারীর ঘরে ঢুকে ধর্ষণ ও পরে তাঁকে মারধরের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হলে তা সারাদেশের মানুষকে স্তম্ভিত করে। এ ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘একজন উপদেষ্টা (আসিফ মাহমুদ) নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুরাদনগরে ক্রমাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছেন। উপদেষ্টা যদি জনসেবার চেয়ে আত্মসেবাতে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে এলাকায় শান্তি বিঘ্নিত হবে। মুরাদনগরের বাসিন্দা উপদেষ্টা হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের এমপিদের মতো এলাকায় আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত রয়েছেন।’
দু’দিন পর গত মঙ্গলবার নির্যাতিত নারীকে সমবেদনা জানাতে যান কায়কোবাদ। স্থানীয় বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘মুরাদনগরে ধর্ষণকাণ্ডের ঘটনাটি বিএনপির ওপর দায় চাপাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত তথ্য এখন বেরিয়ে এসেছে। এ ঘটনায় বিএনপির কোনো কর্মী সম্পৃক্ত নয়। থানার ওসি আর আমাদের উপদেষ্টা (আসিফ মাহমুদ) আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের পুনর্বাসন করছেন।’
পুলিশ হেফাজতে বিএনপি কর্মীর মৃত্যু
গত ১৯ জুন ৭০টি ইয়াবাসহ বাঙ্গরা বাজার থানা পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে শেখ জুয়েল (৪৫) পুলিশ হেফাজতে মারা গেছেন। নিহত জুয়েলের বাড়ি বাঙ্গরা গ্রামে। এলাকায় তাঁর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসা ছিল। তিনি বিএনপি কর্মী ছিলেন বলে জানিয়েছেন মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন অঞ্জন। তাঁর ভাই বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক।
পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে জুয়েলের। পুলিশ দাবি করে, জুয়েল অসুস্থ ছিলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ক্ষেপিয়ে তুলে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকালে বাঙ্গরা বাজার থানার কড়ইবাড়ী গ্রামে একটি মোবাইল ফোন চুরি ও মাদক কারবারের অভিযোগে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হচ্ছেন– ওই গ্রামের জুয়েল মিয়ার স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৮), তাঁর ছেলে মো.
১১ মাসে ১০ খুন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন
মুরাদনগর ও বাঙ্গরা বাজার থানা পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ৫৯৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মুরাদনগর থানায় প্রায় ৪০০ মামলা হয়েছে। এর সাতটি হত্যা, ২০টি ধর্ষণ, পর্নোগ্রাফি ও নারী নির্যাতন আইনের মামলা। আলোচিত ঘটনা ছিল থানায় হামলা, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, নারীকে ধর্ষণ ও ভিডিও ভাইরাল মামলা।
বাঙ্গরা বাজার থানায় ১৯৬ মামলার মধ্যে ১০টি ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও পর্নোগ্রাফি আইনে এবং তিনটি খুনের। সর্বশেষ এ থানা এলাকায় তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
থানায় হামলা ও মামলা
গত ১২ এপ্রিল মুরাদনগরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজির অভিযোগে আবুল কালামকে আটক করে পুলিশ। তিনি নবীপুর ইউনিয়ন শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক। পুলিশের অভিযোগ, কালামকে ছাড়িয়ে নিতে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানার নেতৃত্বে থানায় হামলা হয়। এ সময় থানায় থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীর ওপরও হামলার অভিযোগ করা হয়। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়। কায়কোবাদের কয়েকজন অনুসারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়।
উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘৫ আগস্ট দেবিদ্বার, তিতাস থানা ও ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে থানা আক্রান্ত হয়। তখন কায়কোবাদের নির্দেশে সবাইকে মুরাদনগর থানায় আশ্রয় দিয়ে দল থেকে দুই সপ্তাহ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। পরে আমাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও থানায় হামলার মিথ্যা মামলা এবং নেতাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ আমাদের সেই প্রতিদান দিচ্ছে। মিছিল করতে গেলে পুলিশ আমাদের লোকজনের ব্যানার ছিনিয়ে নেয়।’ তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এখন এনসিপির সঙ্গে মিলেমিশে এলাকায় মাদক, জুয়া ও বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মুরাদনগর শাখার আহ্বায়ক ওবায়দুর রহমান সিদ্দিকী সমকালকে বলেন, মুরাদনগরে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও বালু ব্যবসায় বিএনপির লোকজন জড়িত। কিন্তু উপদেষ্টার (আসিফ) কারণে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিএনপি নেতারা এখন বেসামাল হয়ে গেছেন।
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মোল্লা মজিবুল হক বলেন, কায়কোবাদ ও আমাদের বিরুদ্ধে উপদেষ্টা আসিফ ও তাঁর লোকজন অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা দুই থানার পুলিশকে ব্যবহার করছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ সমকালকে বলেন, ‘মুরাদনগরের প্রশাসন এখন এনসিপিকে খুশি করতে ব্যস্ত; তারা অপরাধ দমনে ব্যস্ত নয়। তাই এলাকায় সব অপরাধ বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে দল বলতে দুটিই আছে– বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। ইনশাআল্লাহ, বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। তাই বিএনপির কেউ দল ছেড়ে এনসিপিতে যাচ্ছে না। এনসিপিতে কোনো কর্মী নেই। তাই তারা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে দলে নিচ্ছে। এলাকার অনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারাই জড়িত, বিএনপি নয়।’
মুরাদনগর থানার ওসি জাহিদুর রহমান বলেন, এনসিপিকে পুলিশ বিশেষ কোনো সুবিধা দিচ্ছে না। বিএনপির অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি বলেন, ধর্ষণ ও ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় জড়িত আসামিদের এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার মোবাইল ফোনে কল করে এবং হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: দ বন দ ব ম র দনগর থ ন গ র প ত র কর ন ত কর ম ব এনপ র য় ব এনপ উপদ ষ ট এল ক য় কর ম র আম দ র এ ঘটন ঘটন য় আওয় ম র ঘটন অপর ধ এনস প উপজ ল ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নিষ্ক্রিয়তার বিপজ্জনক মাশুল
সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগরে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। সেই ক্ষত এখনও শুকায়নি; এর মধ্যেই ভোলা থেকে উঠে আসে আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা– স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ। আক্রান্ত নারী জানান, তাঁর স্বামীকে নির্যাতন করে অর্থ আদায়ের জন্য তাঁকে ডেকে নেওয়া হয় এবং তারপর নৃশংস নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাঁকে।
এসব ঘটনায় যেন সাম্প্রতিক বাংলাদেশে নারীর নিরাপত্তাহীন অবস্থার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৪০১টি। অথচ চলতি বছর ২০২৫-এর প্রথম ছয় মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪১টি। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।
অধিকারকর্মীদের মতে, এসব ঘটনা নিছক অপরাধ নয়– এগুলো নারীর প্রতি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিদ্বেষের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। আইন ও মানবাধিকারের মৌলিক ভিত্তিকে পদদলিত করে এ সহিংসতা। এখনকার পরিস্থিতি বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সংকটজনক– এমনটাই মত মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর।
মুরাদনগরের ঘটনার পর কিছু মানুষ ধর্ষণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, কেউ বলেছে পরকীয়ার কথা। অথচ আক্রান্ত নারীকে তাঁর পরিবারের সামনে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়; যা সরাসরি নাগরিক নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার ভয়াবহ সংকট তুলে ধরে।
এই মানসিকতা নতুন নয়– যখনই কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হন, তখনই শুরু হয় তাঁর চরিত্র হননের এক অশুভ প্রচেষ্টা। কখনও বলা হয়– রাতের বেলা বাইরে বের হয়েছিলেন কেন, কখনও বলা হয়– সে হয়তো রাজি ছিল। ২০১১ সালের ভিকারুননিসার পরিমলকাণ্ড থেকে শুরু করে ২০২১ সালের কলাবাগান কিংবা সিলেটের এমসি কলেজ অথবা সাম্প্রতিক মুনিয়া হত্যাকাণ্ড– প্রতিটি ঘটনায় দেখা গেছে, নারীকে দোষারোপ করার এক ভয়াবহ প্রবণতা।
কথাসাহিত্যিক শাহ্নাজ মুন্নী এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করার এই প্রবণতা নারীর প্রতি আমাদের নেতিবাচক সামাজিক মনোভাবকেই তুলে ধরে। এর পেছনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিকতা অবশ্যই একটি বড় কারণ। সর্বব্যাপী পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো নারীদেরও নারীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। সমাজ নারীকে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় বলে মনে করে। সুরক্ষার নামে নারীকে অধীনতার শিকলে বন্দি করে রাখতে চায়। সমাজ সবসময় নারীকে ভাবতে বাধ্য করে বাইরের দুনিয়ায় সে অনিরাপদ। নারীকে শেখানো হয় তাঁর সম্মান তাঁর শরীর ও যৌনতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে শ্লীলতাহানি হলে সেটি নারীরই লজ্জা।’
প্রতিদিনের এই সহিংসতা কেবল ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, বরং এটি একটি কাঠামোগত সংকটের বহিঃপ্রকাশ। মুরাদনগরের ঘটনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই অপরাধের পেছনে কেবল ব্যক্তি নয়, বরং সরকারের নির্লিপ্ততা ও দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা কাজ করছে। একজন নারী তাঁর নিজ ঘরে, নিজ পরিচয়ে সুরক্ষিত না থাকলে, তা রাষ্ট্রের সীমাহীন ব্যর্থতা ও নিরাপত্তাহীনতা নির্দেশ করে। অতীতে নারীর ওপর হামলা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ঘটনায় বিচার বিলম্বিত বা অপরাধীদের রক্ষা করার যে প্রবণতা দেখা গেছে, এ ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা বলে বিবেচিত হতে পারে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ১১ মাসে ধর্ষণ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৭৮০টি, যার মধ্যে ৫৫৮টি ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৭৩৬ শিশুসহ মোট ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী-কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৮১ জন ধর্ষণের শিকার, ৩২০ জন নারী খুন হয়েছেন এবং শুধু জুন মাসেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন
২০৩ জন।
একই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ছয় মাসে ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৪ কিশোরী। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২৭ জনকে। যৌন নিপীড়নের শিকার ৫১ জন। ৩১ জনকে উত্ত্যক্ত করা হয়েছে। উত্ত্যক্তকরণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন। ২১ নারী ও কন্যাশিশু পাচার হয়েছেন। একজন এসিড সন্ত্রাসের শিকার। ৬১ কন্যাসহ হত্যার শিকার হয়েছেন ৩২০ নারী ও কন্যাশিশু।
এই ভয়াবহ চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে যখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উচ্চপর্যায়ের প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত আসে না, তখন এটিকে কেবল অবহেলা নয়– রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা হিসেবেই দেখা যায়।
ডা. ফওজিয়া মোসলেম যেমনটি বলেন, ‘এ পরিসংখ্যান শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। বাস্তবে সংখ্যাটা আরও বেশি। বিশেষ করে কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা ও দলবদ্ধ ধর্ষণের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এটি সমাজের জন্য অ্যালার্মিং।’ তিনি আরও বলেন, ‘ছয় মাসে হাজারের বেশি নারী-কন্যা নির্যাতনের শিকার হলেও মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় বা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আছিয়া ধর্ষণ মামলায় তড়িঘড়ি করে বিচার হয়েছে, কিন্তু ভালো তদন্ত না হওয়ায় পরিবার সন্তুষ্ট নয়। এ ধরনের বিচারে দ্রুততা নয়, নির্ভুলতা জরুরি।’
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান আরও সরাসরি বলেন, ‘খুবই উদ্বেগজনক ধর্ষণের চিত্র, নারী নির্যাতনের চিত্র। সার্বিকভাবে নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন সার্বিকভাবে বেড়ে চলছে এবং উদ্বেগজনভাবে রাষ্ট্র দায়িত্ব নিচ্ছে না। আমাদের উদ্বেগটা এটিই। রাষ্ট্র ঝাঁপিয়ে পড়ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। সেই জিনিসটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যার ফলে যারা এ জিনিসগুলো করছে, তারা কোনো ভয় পাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, ‘নারীর প্রতি সহিংসতার চার ভাগের এক ভাগও মিডিয়ায় আসে না। শুধু আলোচিত ঘটনাগুলো সামনে আসে। যদি অপরাধীরা প্রভাবশালী হয়, অনেক সময় সেগুলোর খবরও পাওয়া যায় না।’
এ সমাজে নারী হয়ে বেঁচে থাকাই যেন আজ এক সাহসিকতার কাজ। প্রতিদিনের খবরের শিরোনামে পরিণত হওয়া এই নারীদের গল্প কেবল নির্যাতনের নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতার দলিল। রাষ্ট্র যদি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে তা গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের মৌলিক ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এখন সময় সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার, জবাবদিহিতার। নারীর শরীর নয়, তাঁর সম্মান ও অধিকারকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব পুনর্নির্ধারণ করার। v