সাজের অনুষজ্ঞ হিসেবে নারীরা ঠিক কবে থেকে গহনা ব্যবহার করেন তার সঠিক ইতিহাস অজানা। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে গহনার প্রচলন শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব যুগ থেকেই। শুধু সৌন্দর্য বাড়ানো নয়; একসময় সোনা, রুপা, পুঁতি ও মূল্যবান রত্ন দিয়ে তৈরি গহনা নারীর আর্থসামাজিক অবস্থানও জানান দিত। বর্তমানে গহনা শুধু ঐতিহ্য নয়, বরং ফ্যাশনের অংশ। লিখেছেন আশিকা নিগার
আজকালের ফ্যাশনে হালকা ও কম নকশার গহনাগুলোই বেশি ট্রেন্ডি। সোনা-রুপার মতো চকমকে ধাতুর জায়গা দখল করেছে ক্লে, মাটি, কাঠ, সুতা, পুঁতি ও কাপড় দিয়ে তৈরি নতুন ধারার গহনা। বিভিন্ন পোশাকের সঙ্গে এসব গহনা সাজে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
মাটির গহনা
বাংলার মৃৎশিল্পের শিকড় বহু পুরোনো। সেই ধারাবাহিকতাতেই এখন তৈরি হচ্ছে মাটির তৈরি দুল, হার, কানের দুল, বালা কিংবা টিকলি।
রঙিন, হালকা ও অনন্য ডিজাইনের জন্য মাটির গহনা শহরের মেয়েদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ফোক মোটিফ, আলপনা, পাখি, মাটির পাত্র, ফুল-পাতার ছাপ এমন সব ডিজাইন থাকে, যা একবার চোখে পড়লে সহজে ভোলা যায় না।
প্রিয় রঙের শাড়ি অথবা কুর্তির সঙ্গে সহজে মানিয়ে যায়। যাতে আরাম এবং স্টাইল একসঙ্গে ধরা দেয়।
কাঠের গহনা
কাঠের গহনা সাধারণত তৈরি হয় নিমগাছ, আমগাছ, বট কিংবা অন্য হালকা কাঠ দিয়ে। এগুলোকে নানা আকারে কেটে, পলিশ করে, হ্যান্ডপেইন্ট করে গড়া হয় আকর্ষণীয় রূপে। কখনও কখনও কাঠের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় কাপড়, ঝুট কাপড়, পুঁতি কিংবা সুতার কাজ। ফলে আরও বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে গহনার সৌন্দর্য।
এ গহনাগুলো খুব ভালোভাবে মানিয়ে যায় তাঁতের শাড়ি, খদ্দরের কুর্তি, লিনেন কিংবা কটনের পোশাকের সঙ্গে। আবার যারা হ্যান্ডমেড বা ন্যাচারাল স্টাইল পছন্দ করেন, তাদের তো প্রথম পছন্দই এখন কাঠের গহনা।
মেটাল গহনা
পিতল, তামা, অক্সিডাইজড সিলভার– এসব মেটাল দিয়ে তৈরি দুল, নেকপিস, ব্রেসলেট কিংবা নোজপিন এখন শুধু ফ্যাশনের অনুষঙ্গ নয়, বরং একজন নারীর স্টেটমেন্ট হয়ে উঠছে।
মেটালের গহনার একটা বিশেষ দিক হলো– এগুলোর ডিজাইন সাধারণত জিওমেট্রিক, ট্রাইবাল বা ইথনিক ধাঁচে হয়। কখনও চোখ ধাঁধানো বড়সড়, আবার কখনও হয় ছোট অথচ স্টাইলিশ। মেটালের কালচে রং বা পিতলের উজ্জ্বলতা অনেক ক্ষেত্রেই একঘেয়ে গহনার বাইরে নতুন কিছু ভাবতে শেখায়।
আধুনিক নারীরা শাড়ি, স্কার্ট, কুর্তি কিংবা ওয়েস্টার্ন পোশাকের সঙ্গে মানিয়ে মেটালের গহনা পরে স্বচ্ছন্দে পার্টি কিংবা রেগুলার আড্ডায় যাচ্ছেন।
ক্লে দিয়ে তৈরি গহনা
যারা ভিন্নধর্মী সাজ ভালোবাসেন, তাদের কাছে এখন ক্লে দিয়ে বানানো গহনার জনপ্রিয়তা অন্যতম। চলতি ট্রেন্ডে এখন বেশি চলছে ফ্লোরাল ডিজাইন– যা কদম, গোলাপ, সূর্যমুখীর মোটিফে রঙিন দুল ও লকেট। কাস্টম নাম ও লেটার গহনা যাতে নিজের নাম বা প্রিয় শব্দ দিয়ে বানানো হয়। মিনিয়েচার আর্ট যা হাতে আঁকা পাখি, মুখোশ বা লোকশিল্পভিত্তিক দুল। চাঁদ-তারা ও কসমিক থিম যাতে মুনশেপ, তারা, গ্রহের মতো ডিজাইন থাকে। প্যাস্টেল ও ম্যাট রঙের গহনা, যা হালকা ন্যাচারাল শেডে নরম লুক। বোহো ও ফিউশন স্টাইল, যা ক্লের সঙ্গে কাঠ, পুঁতি বা সুতার সংমিশ্রণে বানানো হয়।
সুতার গহনা
রঙিন সুতা দিয়ে বানানো দুল, নেকপিস বা ব্রেসলেট এখন স্টাইল স্টেটমেন্ট। এগুলো সাধারণত তুলা বা উলের সুতা দিয়ে তৈরি হয়, সঙ্গে অনেক সময় কাঠ, ক্লে বা পুঁতির সংমিশ্রণ থাকে। এ গহনাগুলো হালকা ও আরামদায়ক হওয়ায় দৈনন্দিন সাজে যে কোনো পোশাকের সঙ্গেই মানিয়ে যায় সহজে।
চলতি ডিজাইন ট্রেন্ডে এখন চলছে মাল্টি লেয়ার সুতার হার, কানের বড় দুলে সুতা দিয়ে ঝুলন্ত ডিজাইন, রঙিন বোনা ব্রেসলেট বা রিস্টব্যান্ড।
পুঁতির গহনা
পুঁতির গহনা তরুণীদের অন্যতম পছন্দ। ছোট ছোট রঙিন বিডস দিয়ে তৈরি দুল, নাম লেখা ব্রেসলেট কিংবা মাল্টিকালার নেকপিস এখন শহুরে ফ্যাশনে বেশ জনপ্রিয়। এ গহনাগুলো সহজে বানানো যায়। ফলে অনেকেই নিজের মতো করে কাস্টম ডিজাইনও অর্ডার করছেন।
কাপড়ের গহনা
জামদানি, খাদি, বাটিক কিংবা ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরি গহনা এখন শুধু গ্রাম্য মেলায় নয়, বরং শহুরে ফ্যাশনেরও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। আজকাল আবার কাপড়ের গহনায় আরও ভিন্নতা আনতে ফ্যাশনেবল নারীরা গামছা দিয়ে রুচিসম্মত গহনা তৈরি করছেন।
এ গহনায় থাকে হাতের আঁকা, ব্লক প্রিন্ট, প্যাচওয়ার্ক বা এমব্রয়ডারির কারুকাজ; যা পুরো লুককে দেয় এক ধরনের নান্দনিকতা।
ট্রেন্ডে এখন চলছে জামদানির ডিজাইনে তৈরি কাপড়ের দুল, পেইন্টেড বা ব্লক প্রিন্ট করা লকেট, কাপড় ঘষে বানানো ফুল বা পাতা আকৃতির হার, গামছা দিয়ে বানানো হাতের চুড়ি ইত্যাদি।
এ ধরনের গহনা বিশেষ করে এথনিক বা ফিউশন সাজের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে যায়।
গহনাগুলোর বিশেষত্ব কী
হস্তনির্মিত হওয়ায় প্রতিটি পিসেই আলাদা ইউনিকনেস থাকে। পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ দিয়ে তৈরি। দাম তুলনামূলকভাবে কম; তাই রোজকার ব্যবহারেও উপযোগী। ফ্যাশন ও সচেতনতাকে একসঙ্গে ধারণ করে।
বর্তমানের ট্রেন্ডি গহনা নিয়ে রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাস বলেন, ‘এ মুহূর্তে গহনার ট্রেন্ডে কিছু স্পষ্ট ধারা দেখা যাচ্ছে, যা ফ্যাশনের গতিপথ, সেলিব্রেটি প্রভাব, ইনস্টাগ্রাম-টিকটকের স্টাইল ও লাইফস্টাইল ট্রেন্ডের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের ফ্যাশনে এখন হালকা ও নান্দনিক গহনার চাহিদা বেশি। হস্তশিল্প ও দেশীয় মোটিফের গহনায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। নকশিকাঁথা মোটিফ, কাঁথা ও তাঁতের ছাপ, কাঠ, কাপড়, টেরাকোটা, সুতার গহনা, আলপনা, নৌকা, ফুল, পাখি ইত্যাদি দেশজ মোটিফের এসব গহনা দৈনন্দিন ও উৎসব দুটোতেই মানানসই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এসব গহনার দামও নাগালের মধ্যে। বেশির ভাগের দামই ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া অন্যান্য গহনার মধ্যে পাতলা চেইন, ছোট দুল, লেয়ার্ড নেকলেস, পার্ল ও মিনিমাল রিং ছাড়াও আফগানি ও অক্সিডাইজড গহনাও বেশ জনপ্রিয়। সব গহনাই সাধারণত ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে। তবে কাস্টম বা ব্র্যান্ডেড হলে তা আরও বেশি হতে পারে।
কোথায় পাবেন
রঙ বাংলাদেশ, অঞ্জন’স, বিবিয়ানা, আড়ং, বিশ্ব রঙসহ বিভিন্ন শপেই পেয়ে যাবেন এই ভিন্নধর্মী গহনাগুলো। তাছাড়া রাজধানীর নিউমার্কেট, টিএসসি, উত্তরার রাজলক্ষ্মী ইত্যাদি মার্কেটগুলোয় দামাদামি করে সাশ্রয়ী মূল্যে পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দনীয় বিভিন্ন গহনা। ঘরে বসেই অনলাইনে অর্ডার করে বিমূর্ত, কায়রা, কাঠসুতা, কাজলরেখা, ধ্রুবর খেলাঘরসহ বিভিন্ন পেজ থেকে কিনতে পারবেন আপনার প্রিয় গহনা।
মডেল: ইমি; গহনা: রঙ বাংলাদেশ
ছবি: ফয়সাল সিদ্দিক কাব্য
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ফ য শন স ধ রণত জনপ র য় ত র গহন গহন গ ল ড জ ইন এ গহন পছন দ গহন র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত
বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ।
সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।
আরো পড়ুন:
একা বাস করতে পারে যে পাখি
কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?
সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।
তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না।
এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস।
তিনি জানেন, প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।
সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন।
একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।
সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।
চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।
গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা/লিপি